সুরাইয়া বানু ডলি

  ৩১ জানুয়ারি, ২০২৪

শিক্ষার নতুন কারিকুলাম

স্বকীয়তা বজায় রেখে শিখরে যেতে হবে

শিক্ষার নতুন কারিকুলাম নিয়ে অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন। উদ্বিগ্ন আমার মতো সাধারণ শিক্ষক, যারা দীর্ঘদিন শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। জীবন ও সমাজ পরিবর্তনশীল। সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চাওয়া-পাওয়া দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হচ্ছে। শিক্ষা একটি চলমান প্রক্রিয়া। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে কয়েক ধাপে আমাদের দেশে শিক্ষার মানোন্নয়ন ও শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন উন্নত বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা অনুকরণে করা হয়। তবে কখনো কখনো আমার কাছে এটা পরীক্ষামূলক বলে মনে হয়েছে। এবারের কারিকুলামে শুধু পাঠ্যপুস্তকের পরিবর্তন নয়- শিক্ষাকাঠামো থেকে শুরু করে শেখার প্রক্রিয়া, মূল্যায়ন সবকিছুর পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। এত বড় একটা পরিবর্তন সবার কাছে নতুন মনে হবে এটাই স্বাভাবিক।

একটু পেছন ফিরে দেখা যাক। একটা সময় শিশুর প্রথম পাঠ ছিল বর্ণপরিচয়, বাক্যপরিচয়, আদর্শলিপি। প্রতিটি বইতে ছিল বানান শেখার পদ্ধতি। ছিল নীতিনৈতিকতার কথা, যা শিক্ষকের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীরা সুর করে উচ্চারণ করত। সুর করে নামতা পড়ত। ফলে কানে শোনার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মনের ভেতর দাগ পড়ত। প্রতি বৃহস্পতিবার শ্রুতিলিখন এবং পুরোনো পড়া শেখার প্রচলন ছিল। ধাপে ধাপে এলো নৈর্ব্যক্তিক অভীক্ষা, সৃজনশীল পদ্ধতি। অনেক প্রশিক্ষণের পর শিক্ষকরা কি হতে পেরেছেন সৃজনশীল? নোট বা গাইড বইয়ের ব্যবহার কি বন্ধ হয়েছে? গাইড বই থেকে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন সৃজনশীল পদ্ধতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। আর একটা বিষয় লক্ষণীয়, সেই প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত আমরা জানি এবং মানি শিক্ষক হলেন দ্বিতীয় জন্মদাতা। বিশেষ করে মাধ্যমিক স্তরে অর্থাৎ বয়ঃসন্ধিকালে শিক্ষার্থীদের জীবন গড়তে শিক্ষকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে। কিন্তু কিছু দিন আগে To spare the rod is to spoil the child. অর্থাৎ বেত মারলে শিশু গোল্লায় যায়- এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে আইন করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বেতের ব্যবহার Gfs প্রহার বন্ধ করা হয়েছে। যে কারণে শিক্ষকদের প্রতি ভয় কমে গেছে, সঙ্গে সঙ্গে কমতে শুরু করেছে শ্রদ্ধা, ভক্তি এবং সম্মান। কমেছে লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ। শিক্ষকরাও নিরুপায়।

জীবন গড়তে হলে শিক্ষার্থীদের অবশ্যই শাসনের প্রয়োজন। তবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত শাসন অর্থাৎ নির্যাতনের ঘটনা যে ঘটেনি তা নয়, সেটা Exception. আর Exception কখনো Instance হতে পারে না। আবার অতিরিক্ত সবকিছুই সব সময়েই খারাপ বা বিষ। হোক সেটা ক্ষমতা, সম্পদ, ক্ষুধা, অহংকার, ভালোবাসা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা, অলসতা, ঘৃণা বা ভক্তি যেকোনো কিছু। সব ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করাটাই যুক্তিযুক্ত। এই তো সেদিন যখন ছাত্রছাত্রীদের ৩-এ, ৪-এ, ৫-এ-এর সঙ্গে পরিচয় ছিল না। ছিল মাতাজি, পিতাজি, গুরুজি, মাস্টারজি। তাদের অনুশাসনেই ফুল নেটওয়ার্ক চলে আসত। কিন্তু এখন তারা না মানে শাসন, না মানে বারণ। এ দায় কার?

যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কারিকুলাম প্রণয়ন করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে সরকার শিক্ষকদেরও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। অনেক চিন্তাভাবনা করে উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদদের সঙ্গে আলোচনা, পর্যালোচনা শেষে সরকার আগামী প্রজন্মের আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়তে যখন অনেকটা পথ অগ্রসর হয়েছে, ঠিক তখনই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো ২০২০ সালের প্রথম দিকে চীনের উহান শহর থেকে করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। রেহাই পায়নি আমাদের দেশও। করোনার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রে জনজীবন বিপর্যস্ত এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এ সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে শিক্ষার্থীদের। সময়ের ব্যবধানে আর্থিক ও বাণিজ্যিক ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হলেও আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের যে ক্ষতি হয়েছে তা কত দিনে পূরণ হবে সেটা এখনো অনিশ্চিত। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য শিক্ষাবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, সরকার চিন্তাভাবনা করছে। অতি সম্প্রতি উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার নতুন করে বিশ্বমানের শিক্ষার জন্য উন্নত বিশ্বের অনুকরণে কারিকুলাম প্রণয়ন করেছে। আগেই বলেছি, এবারের কারিকুলাম বড় ধরনের একটি রূপান্তর প্রক্রিয়া। নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে কারিকুলাম প্রণয়ন করলে তবেই ফলপ্রসূ হতো বলে ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি। তা ছাড়া নতুন কিছু করতে গিয়ে পুরোনো কারিকুলাম একেবারে বাদ না দিয়ে পরিমার্জন করা যেতে পারে। উন্নত দেশের ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত, আমাদের দেশের ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত এক নয়। অন্যদিকে উন্নতবিশ্বের মতো আমাদের দেশের শিক্ষার হারও বেশি নয়, অভিভাবক সচেতনতাও নেই তেমন। দো-আঁশ মাটিতে যে ফসল ভালো হয় এঁটেল বা বেলে মটিতে তা হয় না।

যেকোনো উন্নয়নের মূল হচ্ছে শিক্ষা। স্কুল একটি ফুলবাগান। শিক্ষার্থী ফুল, শিক্ষক মালি। ফুলবাগানে নানা রকমের ফুলের পরিচর্যা করে সুশোভিত ও সুবাসিত করে তোলাই শিক্ষকের মহান দায়িত্ব। শ্রেণিকক্ষে পাঠদান আকর্ষণীয় করে তুলতে হলে দক্ষ ও মেধাবী শিক্ষক প্রয়োজন। দক্ষতা অর্জনে প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। নতুন কারিকুলাম সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের শেখানোর আগে শিক্ষককে পরিপূর্ণভাবে শিখে আত্মস্থ করতে হবে। মাত্র এক বা দুই সপ্তাহ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করলে সে ক্ষেত্রে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে শেখাতে পারবেন না এবং এ ঘাটতি থেকেই যাবে। যতক্ষণ শিক্ষকদের মাইন্ড সেট না হবে অর্থাৎ আত্মস্থ করতে না পারবেন ততক্ষণ তারা শিক্ষার্থীদের ভালোভাবে শেখাতে পারবেন না। ধাপে ধাপে দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই শিক্ষকদের মাইন্ড সেট হবে এবং শ্রেণিকক্ষে পাঠদানও আনন্দদায়ক হবে। নতুন কারিকুলাম শহর এবং গ্রামে সমানভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জনবল কম রয়েছে এবং ভৌত অবকাঠামোর সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ফলে সেখানে এই কারিকুলাম বাস্তবায়ন দুরূহ ব্যাপার। তা ছাড়া শিক্ষককে যদি একই সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান এবং দাপ্তরিক কাজের দায়িত্ব পালন করতে হয়, সে ক্ষেত্রে কারিকুলাম প্রণয়নের উদ্দেশ্যও ব্যাহত হবে। সমাজজীবন তথা জাতীয় জীবনে শিক্ষকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। শ্রেণিকক্ষে স্বতঃস্ফূর্ত শিক্ষা দরকার, দক্ষ ও ভালো শিক্ষক দরকার। তা না হলে কোনো পদ্ধতিই কার্যকর হবে না। শিক্ষক তার জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য দিয়ে জাতিকে আলোকিত করতে পারেন। আবহমান বিশ্ববাসীর শিক্ষক সক্রেটিসের জীবনে থেকে এর যথার্থ প্রমাণ মেলে। নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন সরকারের একটি মহতী উদ্যোগ। সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বলতে পারি, শেকড় ঠিক রেখে, স্বকীয়তা বজায় রেখে শেকড় থেকে শিখরে যেতে হবে এবং কারিকুলাম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে উচ্চপর্যায়ের শিক্ষকের পাশাপাশি মাধ্যমিক পর্যায়ের দক্ষ ও অভিজ্ঞ শিক্ষকের সম্পৃক্ত থাকাটাও প্রয়োজন বলে মনে করি।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও সভাপতি

শিক্ষা সাহিত্য অঙ্গন ও সমাজকলাণ সংস্থা

পাইকগাছা, খুলনা

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close