মুসাহিদ উদ্দিন আহমদ

  ৩১ জানুয়ারি, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

পরিবেশ রক্ষায় চাই চটের ব্যাগ

পলিথিনের তৈরি পণ্য মোড়ক আজও রাজধানীসহ দেশের সর্বত্র হাটে-বাজারে সয়লাব হয়ে আছে। পলিব্যাগে করে চলছে নিয়মিত হাটবাজার সদায়। ব্যবহার শেষে পলিথিনের মতো সম্পূর্ণ অপচনশীল প্লাস্টিকজাতীয় দ্রব্য যত্রতত্র ফেলার কারণে রাস্তাঘাট, নালা-নর্দমা, নদী-খাল ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পলিথিন ব্যাগ স্যুয়ারেজ লাইনে আটকে গিয়ে তরল বর্জ্য প্রবাহ বন্ধ করে এক নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। বিশেষ করে, বর্ষাকালে ড্রেন উপচানো বর্জ্য মেশানো দূষিত পানি রাস্তাঘাটে ছড়িয়ে পড়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করছে। পলিথিন ব্যাগ ভূ-অভ্যন্তরে জমা হয়ে মাটির উর্বরতা শক্তি হ্রাস করে, যা কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এমনকি মাটির নিচে জমাকৃত পলিথিনের স্তর মাটির ভারবহন ক্ষমতা কমিয়ে নগর অবকাঠামো স্থায়িত্বের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

তথ্য মতে, প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ৪০ কোটি টন প্লাস্টিক উৎপাদিত হয়, যার এক-তৃতীয়াংশ মাত্র একবার ব্যবহৃত হয় এবং প্রতিদিন ২০ হাজারের বেশি আবর্জনাবাহী ট্রাকের সমপরিমাণ প্লাস্টিক সমুদ্র, নদী ও হ্রদে ফেলে দেওয়া হয়। নীরব ঘাতক প্লাস্টিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের পরিণতি অত্যন্ত বিপর্যয়কর। একটি পতিত প্লাস্টিক পচে যেতে ৪০০ বছর সময় লাগে। পলিপ্রোপাইলিন জাতীয় পদার্থের তৈরি এসব ব্যাগ বা পণ্য মোড়ক পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কেননা পরিবেশকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়। ইতিপূর্বে বুড়িগঙ্গায় নিচে জমা পলিথিনের স্তর প্রায় ১০-১২ ফুট গভীরতায় পৌঁছে, ঘটে ভয়াবহ পানিদূষণ। এ অবস্থায় নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিথিন ব্যাগের অবাধ উৎপাদন ও যথেচ্ছ ব্যবহাররোধে বুড়িগঙ্গায় বর্জ্য নিক্ষেপ বন্ধের নির্দেশনা বাস্তবায়নে বুড়িগঙ্গা থেকে পলিথিন বর্জ্য উত্তোলনে সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করার পরও যথাযথ কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে তা তেমন ফলপ্রসূ হয়নি। কিছু পলিবর্জ্য বুড়িগঙ্গা থেকে তুলে তা নদীর পাড়েই স্তূপ করে রাখায় উত্তোলিত বর্জ্য আবার এসে পড়ে বুড়িগঙ্গায়। নতুন পলিথিন বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় ফেলাও থেমে থাকেনি।

আশির দশকে বাংলাদেশে পলিব্যাগের বিস্তার উদ্বেগজনকপর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায়। সারা দেশে ১৯৮২ সালে দৈনিক মাত্র ০.২৫ টন উৎপাদন মাত্রা থেকে শুরু করে কয়েক বছরের মধ্যে এর পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পায়। শুধু ঢাকা শহরেই প্রতিদিন ৫০ থেকে ৬০ লাখের বেশি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার হতে থাকে। ১৯৯০ সালে যেখানে দিনে ৬ হাজার ৫০০ টন প্লাস্টিক ব্যবহৃত হতো, সেখানে ২০১৪ সালে তা দাঁড়ায় ২৭ হাজার টনে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০২৫ সালে বাংলাদেশে প্লাস্টিকের ব্যবহার দাঁড়াবে প্রতিদিন ৫০ হাজার টন বা তারও বেশি। একটি সূত্র বলছে, ঢাকায় একটি পরিবার প্রতিদিন ৪টি করে পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করছে। সে হিসাবে শুধু রাজধানীতেই প্রতিদিন ২ কোটির বেশি পলিথিন ব্যাগ বর্জ্য হিসেবে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। শুধু তা-ই নয়, বল্গাহীনভাবে শপিং ব্যাগের পাশাপাশি নানা ধরনের আসবাবপত্র, গৃহস্থালি এবং বাণিজ্যিক কাজে প্লাস্টিকের ব্যবহার যোগ হয়েছে। খাবারের মোড়ক হিসেবে প্লাস্টিকের এখন একচ্ছত্র আধিপত্য। খাবার পানি, কোমলপানীয়, জুস, তেল, চাল, আটা, ময়দা- সবই এখন প্লাস্টিকের মোড়কে বন্দি। এসবই ব্যবহার শেষে প্লাস্টিকবর্জ্য হিসেবে জীববৈচিত্র্যের ঝুঁকি বাড়িয়ে চলেছে।

ফুটগ্রেড প্লাস্টিকের দ্রব্য ব্যবহারেরও একটা নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে। কিন্তু বোতলের জুস বা পানি রেখে দীর্ঘদিন ব্যবহার করা জনস্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক। প্লাস্টিকের পাত্র বা মোড়কে কোনো ধরনের খাদ্য বা পানীয় ফ্রিজে রেখে সংরক্ষণও স্বাস্থ্যহানিকর। প্লাস্টিকের পাত্রে রাখা খাবার ব্যবহারে ক্যানসার, কিডনি রোগসহ নানা দুরারোগ্য ব্যাধির বিস্তার ঘটে এবং প্লাস্টিকের দীর্ঘমেয়াদি বিষক্রিয়ার শিশুর বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত বা বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হতে পারে। এমনকি প্লাস্টিকমিশ্রিত মাটিতে ছড়িয়ে পড়া বিষ খেলে পশুর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে। বন্য পশুপাখির জীবনচক্রেও এর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। প্লাস্টিকদ্রব্য পুড়িয়ে ফেললেও গোটা বায়ুমণ্ডল দূষিত হয়ে প্রাণী ও উদ্ভিদবৈচিত্র্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে।

সূত্র মতে, সারা দেশে গড়ে ওঠে প্রায় ২ হাজার পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন কারখানা। এসব কারখানা থেকে প্রতিদিন প্রায় ১ দশমিক ৫ কোটি পলিথিন ব্যাগ উৎপন্ন হতো। পলিথিন ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করতে ২০০২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ঢাকা শহরে এবং একই বছরের ১ মার্চ থেকে সারা দেশে পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বিপণন এবং ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। প্রথমে এই নিষেধাজ্ঞা শুধু ২০ মাইক্রনের কম পুরু পলিব্যাগের জন্য প্রযোজ্য হলেও পরে সব ধরনের পলিব্যাগের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হয়। পাশাপাশি পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে নানা ধরনের প্রচার-প্রচারণা চলতে থাকে। এমনকি নিষিদ্ধ ঘোষিত পলিথিন ব্যবহার মনিটরিং করার লক্ষ্যে রাজধানীতে একটি স্ট্রাইকিং ফোর্স কাজ করে। মাঝেমধ্যে বাজার থেকে পলিব্যাগ জব্দ করা হয় এবং পলিব্যাগ উৎপাদনে ও বিপণনে নিষেধাজ্ঞা অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও গৃহীত হয়। ফলে কিছুদিনের জন্য পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার হ্রাস পেলেও তা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কেননা পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হিসেবে সস্তা দামে চটের ব্যাগ সরবরাহের কথা থাকলেও বাস্তবে তা হয়নি।

অসাধু পলিথিন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান নতুন কৌশলে তাদের বাণিজ্য চালিয়ে যেতে তৎপর হয়। রঙিন পলিথিনের বদলে স্বচ্ছ পলিব্যাগ বাজারে নতুন রূপে আবির্ভূত হয়। সয়লাব হয়ে যায় রাজধানীসহ দেশের সব হাটেবাজারে। বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানাগুলো আবার সচল হয়ে ওঠে। স্বচ্ছ পলিথিনের ব্যাগ এবং পলি-প্রোপাইলিনের তৈরি নেটের ব্যাগে বাজার সয়লাব হয়ে যায়। পলিথিন তৈরি কাঁচামাল পলি-ইথাইলিন ও পলি-প্রোপাইলিন ১২০ থেকে ১৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় গলনাঙ্কে কার্বন-ডাইঅক্সাইড এবং কার্বন-মনোক্সাইড গ্যাস ছড়িয়ে বাতাসকে মারাত্মকভাবে দূষিত করে। পলিথিন ব্যাগের মতো পলিথিন জাতীয় কাঁচামাল দিয়ে তৈরি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অপচনশীল প্যাকেট ও মোড়ক যত্রতত্র নিক্ষিপ্ত হচ্ছে এবং মাটি, পানি ও বাতাসকে দূষিত করাসহ পরিবেশ ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। পলিথিন ব্যাগসহ সব অপচনশীল কঠিন বর্জ্যরে ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ এবং নিরাপদ অপসারণের ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ সমানভাবে জরুরি। পলিথিনের মতো অপচনশীল প্লাস্টিক বর্জ্যকে সংগ্রহ, পৃথকীকরণ ও প্রক্রিয়াজাত করার জন্য আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা প্রবর্তন করা প্রয়োজন। পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্যরে রিসাইক্লিং বা পুনরাবর্তনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে অপচনশীল পলিথিন বর্জ্যরে পরিমাণ সীমিত রাখা সম্ভব। বাংলাদেশে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার স্থায়ীভাবে বন্ধ করতে হলে পরিবেশ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত অন্যান্য শাখা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কঠোর নজরদারি প্রয়োজন। পলিব্যাগের উৎপাদন ও বিপণন রোধ না করা হলে এর ব্যবহার বন্ধ করা যাবে না। পরিবেশের জন্য পলিথিনের নেতিবাচক প্রভাব সম্বন্ধে দেশের আপামর জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। পাশাপাশি পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হিসেবে কমমূল্যে চটের ব্যাগকে জনগণের কাছে সহজলভ্য করতে হবে।

বর্তমান সরকার পাট ও পাটজাত পণ্যকে দেশের সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাতে পরিণত করতে পাটের বহুমুখী ব্যবহার ও আধুনিক পাটশিল্প স্থাপনে উৎসাহ দিচ্ছে। এ কথা সত্য, দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে পূর্বের চেয়ে কৃষিজমি অনেক কমে গেছে। বিগত বছরগুলোতে কম জমিতে অধিক পরিমাণ ধান উৎপাদনের জন্য উদ্ভাবন করা হয়েছে উচ্চ ফলনশীল ধানবীজ। তেমনি পাটের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যেও বিজ্ঞানীদের কঠোর পরিশ্রমের ফসল হিসেবে উদ্ভাবিত হয়েছে উচ্চ ফলনশীল পাট ও পাটবীজ। তাই পাটের উৎপাদনও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে গড়ে প্রায় ১৪ লাখ একর জমিতে পাট চাষ হচ্ছে। এসব জমি থেকে উৎপাদিত পাটের পরিমাণ প্রায় ৭৫ লাখ বেল। কিন্তু পাট উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় পাটবীজের মাত্র ৩০-৪০ ভাগ পাটবীজ সরকারি ব্যবস্থাপনায় উৎপাদিত হওয়ায় বাকি বীজ অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ও বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। অনেক সময় আামদানি করা পাটবীজের মানও অশানুরূপ হয় না। তাই সরকার যথেষ্ট পরিমাণ উন্নতমানের পাটবীজ উৎপাদনের লক্ষ্যে ‘উচ্চ ফলনশীল পাট ও পাটবীজ উৎপাদন ও উন্নত পাট পচন’ প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এ প্রকল্পের আওতায় ২০ হাজারের অধিক নির্বাচিত কৃষককে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে। দেশের অনুকূল আবহাওয়া ও উর্বর মাটিতে পাটের জাতীয় ঐতিহ্যকে টেকসই করতে সরকার ইতোপূর্বে ১৬৯ কোটি টাকার প্রকল্পের আওতায় কৃষকের কাছে বিনামূল্যে সার, কীটনাশক এবং অন্যান্য কৃষি উপকরণসহ উন্নতজাতের পাটবীজ সরবরাহ করেছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলো ২০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। আগামী দিনে নতুন পাটবীজকে কৃষকের দ্বারে নির্বিঘ্নে পৌঁছে দিয়ে উন্নত কৃষি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অধিক পাট উৎপাদনের লক্ষ্যে দেশ এগিয়ে চলেছে। পাটকলগুলোতে পূর্ণমাত্রায় উৎপাদন শুরু হবে। পাটচাষি ও পাটশ্রমিকদের মুখে দেখা দেবে হাসি। দেশে পাট উৎপাদন বৃদ্ধি এবং পাটশিল্পকে রক্ষায় নতুন কিছু উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে। ইদানীং পাটজাত অনেক শৌখিন পণ্য উৎপাদন করে বিদেশে রপ্তানিও হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে বসছে পাটজাত পণ্যমেলা। এর পাশাপাশি হাটবাজারে পণ্য বিক্রিতে ও উৎপাদিত প্যাকেটজাত পণ্যের মোড়ক হিসেবে পাটের ব্যাগ ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হলে যেমন পলিব্যাগের ব্যবহার বন্ধ হবে, তেমনি পলিথিনজনিত বর্জ্যরে প্রভাবে পরিবেশ বিপর্যয় থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সোলালি আঁশের সোনালি দিন আবার ফিরে আসবে।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও প্রকৌশলী

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close