কে এম মাসুম বিল্লাহ

  ২৩ জানুয়ারি, ২০২৩

দৃষ্টিপাত

শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন কি ফলপ্রসূ হচ্ছে

সম্প্রতি কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে নিজের হতাশার কথা তুলে ধরেন। বিশেষ করে গত কয়েক বছর যাবত যেভাবে শিক্ষাব্যবস্থায় বারবার পরিবর্তন আনা হচ্ছে, তাতে এর প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের ওপর। তার মতে, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ বানানো হচ্ছে। নতুন নতুন পদ্ধতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হচ্ছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বারবার। ২০১০ সালের এসএসসি পরীক্ষার মাধ্যমে আংশিকভাব প্রথম সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে এইচএসসি পর্যন্ত সব সাবজেক্টে সৃজনশীল প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এছাড়া ২০০৬ সালে পঞ্চম শ্রেণিতে পিএসসি ও ২০১০ সালে অষ্টম শ্রেণিতে জেএসসি পরীক্ষা নেওয়া শুরু হয়। অর্থাৎ এসএসসি পরীক্ষার আগেই দুটি পাবলিক পরীক্ষায় বসতে হতো শিক্ষার্থীদের। যেখানে ঢালাওভাবে জিপিএ-৫ পাওয়ার নজিরও আছে। তবে বর্তমানে পিএসসি ও জেএসসি পরীক্ষা বাতিল করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া ক্লাস নাইনে চলমান সিস্টেম অনুযায়ী তিনটি বিভাগ (বিজ্ঞান, কলা ও ব্যবসা) প্রচলিত থাকলেও আগামীতে তা একটি বিভাগ করার উদ্যোগের কথা শোনা যাচ্ছে।

গাইড বইয়ের নির্ভরতা, কোচিং, নোটবই ইত্যাদি বিলুপ্ত করার জন্য সৃজনশীল প্রশ্নপত্রের আবির্ভাব ঘটে। মূলত শিক্ষার্থীদের নিজস্ব সৃজনশীল মেধা ব্যবহার করে পড়াশোনা ও পরীক্ষায় উত্তর করানো ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। তবে উদ্দেশ্য ভালো থাকলেও শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না দিয়ে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু করায় সৃজনশীল পদ্ধতি বাস্তবায়নে প্রথম দিকেই সমস্যা মুখে পড়তে হয়। অবশ্য সৃজনশীল পদ্ধতির মূল চেতনা এখনো ছাত্রছাত্রীরা ধারণ করতে পারেনি বলেই অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন। বিশেষ করে সৃজনশীল পদ্ধতির জন্য ছাত্রছাত্রীরা আগের থেকে বেশি গাইড, নোট কিংবা কোচিংনির্ভর হয়ে পড়ায় এই পদ্ধতির বাস্তবিকতা যাচাই এখন পুনর্বিবেচনা করা উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া এইচএসসি শেষ করে যখন উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া হচ্ছে তখন এই পদ্ধতি আর থাকছে না। অর্থাৎ মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের সঙ্গে উচ্চশিক্ষা পদ্ধতির সামঞ্জস্যতা নেই বললেই চলে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের মতো করে কোর্স কারিকুলাম তৈরি করছে, সে অনুযায়ী পরীক্ষা নিচ্ছে। সেখানে কিছু কিছু সাবজেক্টে অ্যাপ্লাইড প্রশ্ন হলেও অধিকাংশ বিষয়ে এমন পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে না। আর তাই এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনার পদ্ধতির সঙ্গে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পদ্ধতির সামঞ্জস্য না থাকাটাও চিন্তার বিষয়!

২০০১ সালে পাবলিক পরীক্ষা পদ্ধতিতে প্রথম গ্রেডিং সিস্টেম চালু হয়। প্রথম বছর এসএসসি পরীক্ষায় মাত্র ৭৬ জন ছাত্রছাত্রী জিপিএ-৫ অর্জন করে। তবে ২০১০ সালে এসে জিপিএ-৫ পায় ৫২ হাজার ১৩৪ শিক্ষার্থী। মাত্র চার বছর ব্যবধানে ২০১৪ সালে ১ লাখ ৪২ হাজার ২৭৬ শিক্ষার্থী এসএসসিতে জিপিএ-৫ অর্জন করে! এরপর থেকেই শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে! গত বছর দেখা যায়, মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষায় এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন, যা রীতিমতো অবিশ্বাস্য! অথচ উচ্চশিক্ষার জন্য বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেলে আসন রয়েছে এর এক-তৃতীয়াংশ! অর্থাৎ জিপিএ-৫ পাওয়া বড় একটি অংশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, অনার্স-পাস কোর্সে ভর্তি হতে হবে! অথচ কয়েক বছর আগেও জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের চূড়ান্ত মেধাবী হিসেবে ধরা হতো। আর বর্তমানে জিপিএ-৫ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও ট্রল করতে দেখা যায়! গত বছরের একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল থেকে কয়েকজন এসএসসি উত্তীর্ণ মেধাবী ছাত্রদের নিয়ে এক সাংবাদিকের করা সহজ কিছু প্রশ্নের উত্তর শুনে হতবাক হয়েছে দেশের প্রতিটি সচেতন মানুষ! যেসব ছাত্রের মধ্যে অধিকাংশই এসএসসিতে জিপিএ-৫ কিংবা ৪ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছে! অথচ ভালো ফলাফল করার পরও তারা জানে না স্বাধীনতা দিবস কত তারিখ কিংবা আমাদের রণসংগীতের রচয়িতা কে। এমনকি ‘আমি জিপিএ-৫ পেয়েছি’ এর ইংরেজি অনুবাদ করতে দিলে উত্তর আসে ‘আই অ্যাম জিপিএ ফাইভ’। ভালো ফলাফল করা এসব শিক্ষার্থীর ধারণা নেই অপারেশন সার্চলাইট সম্পর্কেও! অথচ গ্রেডিং সিস্টেম চালুর আগে প্রচলিত স্টার মার্কস পেলে এলাকায় ওই শিক্ষার্থীর সুনাম ছড়িয়ে পড়ত! সামাজিকভাবে তার মর্যাদা বৃদ্ধি পেত। মানুষ তাকে মূল্যায়ন করত! আর বর্তমানে জিপিএ-৫ পেয়েও ট্রলের শিকার হতে হচ্ছে!

দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিভিন্ন পরিবর্তন আনলেও তা কতটুকু ফলপ্রসূ হয়েছে? কয়েক বছর আগের কথা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)-এর একটি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় মাত্র দুই শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করতে সক্ষম হয়। যেটা বেশ আলোচনার জন্ম দেয় দেশজুড়ে। দেশে যখন এসএসসি, এইচএসসিতে জিপিএ-৫ এর মহোৎসব চলছে, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিপরীক্ষায় সেসব শিক্ষার্থীর ভরাডুবি হচ্ছে কেন? আমাদের দেশে দেখা যায়, অনার্স মাস্টার্স করে দীর্ঘদিন বেকার থাকতে হচ্ছে শিক্ষিতদের একটি বড় অংশকে। জেনারেল সাবজেক্টগুলোতে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে চাকরি পাওয়া দুরূহ হয়ে পড়ছে! কর্মসংস্থানের সুযোগ কম থাকার পাশাপাশি প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাও কিছুটা দায়ী এ অবস্থার জন্য! প্রতি বছর তাই লাখ লাখ বেকার যুক্ত হচ্ছে এই তালিকায়। অথচ উন্নত দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যায় তারা কারিগরি শিক্ষায় জোর দিচ্ছে, বিশেষ করে অনেক দেশেই প্রায় ৪০ শতাংশ কারিগরি শিক্ষা চালু আছে। আর কারিগরি শিক্ষায় জোর দিয়ে এগিয়ে যাওয়া চীন সব দেশের জন্যই মডেল হতে পারে! সেদিক থেকে আমাদের কারিগরি শিক্ষার দিক কিছুটা জোর দিলেও মূলত এই কারিগরি শিক্ষার অবস্থা কিছুটা নাজুক। আমাদের দেশে বিজ্ঞানের গ্র্যাজুয়েটদের ব্যাংকের চাকরির জন্য অনার্স শেষ করে ব্যাংকিং টার্ম পড়তে হচ্ছে! বুয়েট কিংবা মেডিকেল কলেজে পড়ে বিসিএস দিয়ে জেনারেল ক্যাডারে চলে যাচ্ছে! এমন সংখ্যাই এখন বেশি!

গত বছর অনুমোদন পেয়েছে নতুন শিক্ষা পদ্ধতি। যেটা ধাপে ধাপে বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত করা হবে। নতুন শিক্ষা পদ্ধতিতে দশম শ্রেণিতে হবে এসএসসি পরীক্ষা, যেখানে থাকছে না বিজ্ঞান, ব্যবসা কিংবা মানবিকের বিভাজন। নতুন শিক্ষাক্রমে এখনকার মতো এইচএসসি পরীক্ষা হবে না। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি পাবলিক পরীক্ষা হবে। প্রতি বর্ষ শেষে বোর্ডের অধীনে এই পরীক্ষা হবে। এরপর এই দুই পরীক্ষার ফলের সমন্বয়ে এইচএসসির চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হবে। নীতি নির্ধারকরা হয়তো অনেক পরিকল্পনা করেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে শিক্ষার তিনটি স্তরের মাঝে যেন সামঞ্জস্যতা থাকে, সেটা নিয়ে কাজ করা উচিত। সব সাবজেক্টে সৃজনশীলতার প্রয়োজনীয়তা পুনর্বিবেচনা করা যায় কি না, সেটাও ভেবে দেখা উচিত। ঢালাওভাবে জিপিএ-৫ না বাড়িয়ে শিক্ষার মানোন্নয়নের দিক নজর দেওয়া উচিত। নতুন পদ্ধতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিক্ষকদের জন্য পর্যাপ্ত ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

লেখক : ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close