মো. জাহিদুল ইসলাম

  ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

পরিবেশে ক্লাউড সিডিং প্রযুক্তির প্রভাব

আকাশে কৃত্রিমভাবে মেঘ সৃষ্টি করে তা থেকে বৃষ্টি ঘটানোর জন্য যে পদ্ধতি তাকে ক্লাউড সিডিং বলে। কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের অর্থ কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট মেঘ থেকে বৃষ্টিপাত নয়। আকাশে ভেসে থাকা বৃষ্টির অনুপযোগী মেঘগুলোকে জোরপূর্বক বৃষ্টি হিসেবে মাটিতে নামিয়ে আনাই হলো কৃত্রিম বৃষ্টিপাত। বস্তুত কৃত্রিম বৃষ্টিপাত হলো একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে একটি বিশেষ ধরনের মেঘকে কৃত্রিমভাবে সম্পৃক্ত করে বৃষ্টিপাত ঘটানো হয়। তাই একে মেঘের ‘কৃত্রিম রূপান্তর’-ও বলা হয়ে থাকে। ক্লাউড সিডিং (কৃত্রিম বৃষ্টিপাত) হলো প্রকৃতির ওপর বৈজ্ঞানিক প্রভাব খাটিয়ে সংঘটিত জোর করে বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া।

অন্যদিকে এটি আবার মেঘের বীজ বপন নামেও পরিচিত। এ ক্ষেত্রে প্রথম ধাপে মেঘ সৃষ্টি করতে হয়। দ্বিতীয় ধাপে এই মেঘকে ঘনীভূত করে বৃষ্টিপাতের উপযোগী অবস্থায় নিয়ে আসতে হয়। তৃতীয় অর্থাৎ সবশেষে ধাপে বৃষ্টি ঝরানো হয়। তবে সচরাচর আকাশে ভাসমান মেঘকে পানির ফোঁটায় পরিণত করেই কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানো হয়। বৃষ্টির মূলমন্ত্র হচ্ছে মেঘের ঘনীভবন। এই প্রক্রিয়াটি সাধারণত প্রাকৃতিকভাবে ঘটে থাকে। বৃষ্টিপাতের ব্যাপারটি সম্পূর্ণই প্রাকৃতিক। প্রকৃতির খেয়াল খুশিমতোই বৃষ্টিপাত হওয়ার কারণেই অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টির মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। প্রাকৃতিকভাবে সূর্যের প্রখর তাপে সমুদ্র, নদ-নদী বা জলাধারের পানি বাষ্পীভূত হয়ে ওপরে উঠে যায়। অতঃপর বাতাসে ভেসে থাকা অসংখ্য ধূলিকণার সঙ্গে মিশে জমাটবদ্ধ হয়ে এই জলীয় বাষ্পগুলোই মেঘে পরিণত হয়। আকাশের ট্রপোস্ফিয়ার স্তরে ভেসে থাকা এই মেঘগুলো যখন সময়ের পরিক্রমায় ঘনীভূত হতে হতে ভারী হয়ে ওঠে, তখনই পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বলের টানে বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে ভূপৃষ্ঠে নেমে আসে।

এখন যদি এই ট্রপোস্ফিয়ারে থাকা মেঘগুলোকে যদি সময়ের আগেই কৃত্রিমভাবে ঘনীভূত করা যায়, তবেই তৎক্ষণাৎ বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে যাবে। ‘ক্লাউড সিডিং’ মূলত এই কাজই করে থাকে। ক্লাউড সিডিং করা হয় এমন পদার্থগুলোকে বাতাসে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রকৃত অর্থে যা মেঘ ঘনীভূত বা বরফের নিউক্লিয়াস হিসেবে কাজ করে। ক্লাউড সিডিং প্রযুক্তিতে অতিসাধারণ রাসায়নিক পদার্থসমূহ যেমন- শুষ্ক বরফ, কঠিন কার্বন-ডাইঅক্সাইড, সিলভার আয়োডাইড, পটাশিয়াম আয়োডাইড ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া তরল প্রোপেন গ্যাসও ব্যবহার করা হয় এই প্রযুক্তিতে। এই গ্যাস সিলভার আয়োডাইডের চেয়ে অধিক তাপমাত্রায় বরফের স্ফটিক তৈরি করতে সক্ষম। এতে মেঘের দ্রুত ঘনীভবন হয় এবং তা পতনশীল অবস্থায় পৌঁছায়। তবে অনেক সস্তা ও বেশ কার্যকর প্রমাণিত হওয়ায় এই প্রযুক্তিতে এখন সোডিয়াম ক্লোরাইড বা খাওয়ার লবণের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে।

ক্লাউড সিডিংয়ের সময় মেঘের ভেতরের তাপমাত্রা ৭ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে আসে। সে সময় তুষারপাতের আশঙ্কা তৈরি হয়। আর তাই এ রকম পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে ব্যবহার করা হয় সিলভার আয়োডাইডের মতো রাসায়নিক পদার্থ। উড়োজাহাজ অথবা রকেটের মাধ্যমে মেঘের চারপাশে ছড়িয়ে দেওয়া হয় ক্লাউড সিডিংয়ের উপাদানগুলো। মেঘের ওপর দিয়ে যখন উড়োজাহাজটি অগ্রসর হয়, তখন সিলভার আয়োডাইডও ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এই রাসায়নিকের ক্ষুদ্র স্ফটিক দানাগুলোই মূলত মেঘের সিড হিসেবে কাজ করে। এসব দানায় ভাসমান জলীয়বাষ্পে পানির কণাগুলো জড়ো হয়ে বড় ফোঁটায় পরিণত হয়। এর জন্য প্রথমে মেঘ সৃষ্টি করতে হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে এই মেঘকে ঘনীভূত করে বৃষ্টিপাতের উপযোগী অবস্থায় নিয়ে আসতে হয়। ঘনীভূত মেঘ একসময় ওজন বেড়ে গিয়ে মহাকর্ষের টানে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। তবে সচরাচর আকাশে ভাসমান মেঘকেই পানির ফোঁটায় পরিণত করে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানো হয়। যার ফলে কৃত্রিমভাবে বৃষ্টিপাতে ঘটে। একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বৃষ্টির পাশাপাশি কৃত্রিম তুষারপাত ঘটানো হয়।

বর্তমানে ক্লাউড সিডিং করার জন্য সিলভার আয়োডাইডই সবচেয়ে বেশি কার্যকর ও জনপ্রিয়। দীর্ঘদিনব্যাপী খরাপ্রবণ অবস্থা বর্তমান শতাব্দীর জলসমস্যা দিন দিন তীব্রতর হয়ে উঠেছে। বিশ্বের প্রায় ৪৫ শতাংশ জনসংখ্যা প্রচণ্ড জলসংকটে ভুগছে এবং জলসেচের জন্য পর্যাপ্ত জলের অভাব দেখা যাচ্ছে। আগামী ২০-২৫ বছরের মধ্যে বিশ্বের সব কটি দেশই তীব্র জলসংকটে ভোগার এক বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। এমন অবস্থায় তীব্র জলসমস্যার সমাধানে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানো হয়ে থাকে। প্রযুক্তি চলমান এবং গতিশীল। প্রযুক্তি কখনোই থেমে থাকে না। দিন দিন এর প্রভূত উন্নয়ন হয়। আবার সম্পূর্ণ নতুন কোনো প্রযুক্তির উদ্ভাবনে আগের সব ধারণা ভেঙে যায়। ক্লাউড সিডিং প্রযুক্তি এখনো যথেষ্ট ব্যয়বহুল। বিজ্ঞানীরা বর্তমানে গবেষণা করছেন স্বল্পব্যয়ে লেজার প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রক্রিয়াটি ঘটানোর জন্য। বিমান বা রকেটের পরিবর্তে লেজার রশ্মির ব্যবহার করে ক্লাউড সিডিংয়ের বিষয়ে আধুনিক গবেষণা চলছে।

নতুন এই লেজার রশ্মির ব্যবহার আবিষ্কৃত হলে কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের প্রযুক্তিকে সহজ ও সুলভ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। অনাবৃষ্টি ও মরু অঞ্চলে অঞ্চলের পাশাপাশি যেসব স্থানে ভূগর্ভস্থ পানি লবণাক্ত, সেসব স্থানের জন্য কৃত্রিম বৃষ্টিপাত খুবই প্রয়োজনীয়। সেসব স্থানে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটানোর জন্য সার্বক্ষণিক মেঘ পর্যবেক্ষণ করা হয়ে থাকে। বৃষ্টিপাত ঘটাতে পারে এমন মেঘ খুঁজে পেলেই ক্লাউড সিডিং অপারেশন শুরু করা হয়। ক্লাউড সিডিংয়ের মাধ্যমে বৃষ্টি বৃদ্ধির লক্ষ্যে বৃহৎ পরিসরে গবেষণা, ক্লাউড সিডিং প্রযুক্তির উন্নয়ন, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য কৃত্রিম হ্রদ ও বাঁধ নির্মাণ অত্যাবশ্যকীয়। মানুষ এবং অসংখ্য প্রাণীর টিকে থাকার অন্যতম প্রধান উপাদান সুস্বাদু পানি। যার একমাত্র প্রাকৃতিক উৎস বৃষ্টিপাত। কিন্তু এই বৃষ্টির ওপর কারো নিয়ন্ত্রণ নেই। প্রাণিকুলের প্রয়োজন অনুযায়ী সময় ধরে বৃষ্টি নামবে- এমনটাও সব সময় আশা করা যায় না। স্বল্প মেয়াদে বা তাৎক্ষণিক প্রয়োজনে ক্লাউড সিডিংয়ের কার্যকারিতা সফলভাবে প্রমাণিত। তবে এই পদ্ধতিতে ঘটানো কৃত্রিম বৃষ্টিপাত দীর্ঘ মেয়াদে খুব সামান্যই কাজে আসে। এ ছাড়া অতিরিক্ত ক্লাউড সিডিংয়ের ফলে পরিবেশের স্বাভাবিক ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। এতে ব্যবহৃত কেমিক্যাল স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে।

ক্লাউড সিডিংয়ের পদ্ধতি খুব জটিল কিছু নয়। আকাশে বৃষ্টির অনুপযোগী মেঘগুলোর ওপর কেমিক্যাল ছড়িয়ে দিয়ে সময়ের আগেই বৃষ্টি ঝরিয়ে ফেলা হয়। বর্তমানে বহু দেশ তাদের বৃষ্টিনির্ভর শস্য উৎপাদনে ক্লাউড সিডিং প্রযুক্তি কাজে লাগাচ্ছে। কৃষিক্ষেত্রে ক্লাউড সিডিং প্রযুক্তি ব্যবহারের গুরুত্ব অনেক। কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে প্রধানত বৃষ্টিনির্ভর শস্যগুলো রক্ষায় কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে ক্লাউড সিডিং প্রযুক্তি। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রাও বাড়ছে সমানুপাতে। আর তাই মরূকরণ রোধে বিশ্বের অন্যান্য দেশও এই প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল থাকে। এদিকে গরমের দেশ ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার দেশগুলোর কাছেও ক্লাউড সিডিং প্রযুক্তির ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কৃত্রিম বৃষ্টিপাত প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভারী বর্ষণ, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও হারিকেনের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার বেশ ফলপ্রসূ। শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করাই নয়। অধিক পরিমাণ বৃষ্টি বর্ষণের এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অধিক পরিমাণে ফসল ফলাতে সক্ষমতা দেখিয়েছে। মানুষ নিজের বিবেক-বুদ্ধি, বিচার-বিশ্লেষণ, মেধা ও প্রায়োগিক দক্ষতা কাজে লাগিয়ে মানুষ প্রকৃতির বৈরী পরিস্থিতিকে ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ করতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি আবিষ্কার করার পাশাপাশি এর ব্যবহারের দিকে প্রতিনিয়ত অগ্রসর হচ্ছে। প্রতিটি ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এক জায়গায় কৃত্রিম বৃষ্টিপাত করা হলে অন্য জায়গায় এর প্রভাব পড়ে। অর্থাৎ অন্য এলাকায় সৃষ্টি হবে বৃষ্টির তীব্র অভাব।

অতিরিক্ত ক্লাউড সিডিংয়ের মাধ্যমে আগেই বৃষ্টিপাত ঘটিয়ে ফেলায় একদিকে যেমন বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে শীতল মেঘের সারি এক দেশ থেকে অন্য দেশের আকাশে ঢোকার ফলে সে দেশ থেকে সেগুলো অর্থাৎ শীতল মেঘের সারি নিঃশেষ হয়ে যায়। ফলে এক দেশে কৃত্রিমভাবে বৃষ্টিপাত ঘটানোর ফলে অন্য দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর পাশাপাশি অন্য দেশের জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। অন্যদিকে সিলভার আয়োডাইডের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার দূষিত করে মাটির গুণগত মান। এর ফলে প্রাণিকুল এবং উদ্ভিদকুলের পাশাপাশি বাস্তুসংস্থানেও ওপরেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে। তাই খুবই সাবধানে এবং সতর্কতার সঙ্গে এই প্রযুক্তির কর্মযজ্ঞ পরিচালনা করা অত্যাবশ্যকীয়। সভ্যতার শুরু থেকেই মানুষ চেষ্টা করে এসেছে প্রকৃতির ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার। প্রকৃতি শাসনের ফল কখনো হয়েছে আশীর্বাদ। পক্ষান্তরে আবার কখনো বা ডেকে এনেছে চরম বিপর্যয়। তবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যে গতিতে এগোচ্ছে, তাতে ধারণা করা যায় যে ভবিষ্যতে প্রকৃতির মৌলিক কাঠামোগুলোয় মানুষের নিয়ন্ত্রণ দিন দিন আরো বহুলাংশে বাড়বে।

লেখক : শিক্ষার্থী, আইসিটি সেল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close