আহমেদ রিয়াজ

  ২৯ নভেম্বর, ২০২২

দৃষ্টিপাত

ফিলিস্তিনের জন্য ভালোবাসা

অনেক আগে থেকেই ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি দেখিয়ে আসছে বাংলাদেশ। ১৯৭২-এর ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশকে তৃতীয় দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল ইসরায়েল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেই স্বীকৃতি প্রত্যাখ্যান করে ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানায়। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ফিলিস্তিনের সমর্থনে বাংলাদেশ মেডিকেল টিম ও ত্রাণ পাঠিয়েছিল। ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীতে সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছিলেন ইয়াসির আরাফাত।

পৃথিবীর ইতিহাসে ইংরেজদের বেঈমানির অগণিত উদাহরণ আছে। তবে সবচেয়ে মর্মান্তিক ও দুঃখজনক উদাহরণ হচ্ছে ফিলিস্তিন। ইংরেজরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের (১৯১৪-১৮) সময় ফিলিস্তিনি আরবদের কথা দিয়েছিল- তোমরা যদি তুর্কিদের সঙ্গে যোগ দিয়ে লড়াই না করো, তবে তোমাদের (সেলফ ডিটারমিনেশন) স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র দেব। ওদিকে আরবদের অগোচরে ইহুদিদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যদি তোমরা জার্মানিকে অর্থ সাহায্য বন্ধ কর সে অর্থ ইংরেজকে দাও, তবে যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনে তোমাদের ‘ন্যাশনাল হোম’ নির্মাণ করতে দেওয়া হবে।

ইংরেজদের এই দুমুখো নীতি প্রকাশ পেল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে। এই যুদ্ধের আগে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন ছিল তুরস্কের উসমানিয়া সাম্রাজ্যের অধীন। ইংরেজদের ষড়যন্ত্রে তুরস্কের মুসলিম খেলাফত ভেঙে যায় এবং একটি গুলিও খরচ না করে ইরাক, সিনাই উপত্যকা, ফিলিস্তিন ও জেরুজালেম দখল করে নেয় ব্রিটিশ বাহিনী। ইসরায়েল, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, জর্ডান ও লেবানন চলে যায় ইংল্যান্ড-ফ্রান্সের দখলে। ১৯১৭-এর ২ নভেম্বর সে সময়ের ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফোর একটি চিঠিতে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন, যেটা বেলফোর ঘোষণা নামে পরিচিত।

ইউরোপের নানা দেশে ইহুদিরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। তবে এই বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা তৈরি হতেই দলে দলে ইহুদি আসতে শুরু করল ফিলিস্তিনে। ওদিকে বেইমান ইংরেজ ক্ষমতালিপ্সু ও আরেক বেঈমান জাতি ইহুদিদের ইউরোপে রাষ্ট্র তৈরির পক্ষে কখনো সমর্থন দেয়নি। বরং ঝামেলাবাজ ইহুদিদের ঠেলে দিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। রোমান সময় থেকে ইহুদিদের ছোট্ট একটি ধর্মীয় গোষ্ঠী সেখানে বাস করত। তাদের সংখ্যা ছিল মাত্র কয়েক হাজার। নিজেদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হওয়ায় বিপুলসংখ্যক ইহুদি ইউরোপ থেকে পাড়ি জমায় ফিলিস্তিনে। ব্রিটিশদের সহায়তায় ১৯১৮ সালের মধ্যে ইহুদিদের সংখ্যা হয়ে যায় ২০ হাজার, যা ১৯২৩ সালে দাঁড়ায় ৩৫ হাজার এবং ১৯৩১ সালে ১ লাখ ৮০ হাজারে।

এর মধ্যেই ব্রিটিশদের সহযোগিতায় ১৯১৮ সালে তৈরি হয় গুপ্ত ইহুদি বাহিনী ‘হাগানাহ’। এই বাহিনী প্রথম দিকে ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ইহুদিবাদীদের সহায়তা করত। পরবর্তী সময়ে তারা সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী বাহিনীতে পরিণত হয়। শুধু ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর ও খেত-খামার দখল করেই তারা ক্ষান্ত থাকেনি, জোর করে বিতাড়িতও করত। বাজার ও রাস্তাঘাটে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করা ছিল তাদের নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। ইউরোপে ইহুদিদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও হিটলারের কঠোরতায় ১৯৪৮ সালেই ফিলিস্তিনে ইহুদিদের সংখ্যা হয়ে যায় ৬ লাখ। টনক নড়ে আরবদের। ততদিনে দেরি হয়ে গেছে। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ফিলিস্তিনি আরবরা বিদ্রোহ শুরু করে। ব্রিটিশ সৈন্যরা ভয়ংকর দমন-পীড়নের মাধ্যমে সে বিদ্রোহ দমন করে কঠোরভাবে। এ সময় ৩২ হাজার ইহুদি ব্রিটিশ বাহিনীতে যোগ দিয়ে রণকুশলী হয়ে ওঠে।

ইহুদিরা সেই রণকৌশল প্রথমে প্রয়োগ করে আরবদের বিরুদ্ধে। এরপর ইহুদি রাষ্ট্র তৈরিতে চাপ সৃষ্টি করে ব্রিটিশ সৈন্যদের ওপর। ওদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইসরায়েল রাষ্ট্রের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান। হিটলারের কবল থেকে বেঁচে যাওয়া এক লাখ ইহুদিকে অতিদ্রুত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে জায়গা দেওয়ার জন্য চাপাচাপি করতে থাকেন। যদিও ব্রিটেন বুঝে গিয়েছিল এত ইহুদিকে তাদের উপনিবেশ ফিলিস্তিনে নিয়ে গেলে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। অর্থাৎ ইংরেজ তখন গৃহস্থকে ঘর পাহারা দেওয়ার কথা বলে চোরকে চুরি করার অনুমতি দিল।

জাহাজবোঝাই করে পঙ্গপালের মতো হাজার হাজার ইহুদি এসে আস্তানা গাড়তে থাকে ফিলিস্তিনে। ধীরে ধীরে দখলদার ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে পরিস্থিতি। এবার জাতিসংঘের মাথায় কাঁঠাল ভাঙতে শুরু করে ইংরেজরা। ১৯৪৭-এর নভেম্বরে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে দুটি রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘ। একটি ইহুদিদের, অন্যটি আরবদের জন্য। এই আরব কিন্তু শুধু মুসলিম নয়। এখানে মুসলমানদের সঙ্গে খ্রিস্টানসহ অন্য ধর্মের অনুসারীও ছিল।

এটি ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডকে দ্বিখণ্ডিতকরণ সংক্রান্ত ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ১৮১ নম্বর প্রস্তাব ছিল। এ প্রস্তাব অনুসারে ফিলিস্তিনের ৪৫ শতাংশ জমি ফিলিস্তিনি এবং ৫৫ শতাংশ জমি ইহুদিদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। অথচ তখন অবধি জোরজবরদস্তি ও সন্ত্রাসী কায়দায় দখল করার পরও ইহুদিরা ছিল মাত্র ১০ শতাংশ জমির মালিক। স্বাভাবিকভাবে এই চক্রান্তকে মেনে নেয়নি ফিলিস্তিন ও অন্যান্য আরব দেশ। জাতিসংঘে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোকে চাপ দিতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। এই সুযোগে আরবদের মাঝে বিষফোড়া ইহুদি ঢুকিয়ে ফিলিস্তিন থেকে ইংরেজরা সটকে পড়ে ১৯৪৮-এর ১৪ মে। সেদিনই পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী গঠিত হয় ইসরায়েল রাষ্ট্র। পৃথিবী অবাক হয়ে দেখল, কার জমিতে কারা রাষ্ট্র গঠন করেছে! সাম্রাজ্যবাদী শক্তির তোড়ে ভেসে গেল সব নীতিনৈতিকতা। যদিও আরব দেশগুলো এটা মোটেই মেনে নিতে পারেনি। সে কারণে রাষ্ট্র ঘোষিত হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে মিসর, ইরাক, লেবানন, জর্ডান ও সিরিয়া সম্মিলিতভাবে ইসরায়েল আক্রমণ করে।

তীব্র লড়াইয়ে ইসরায়েলের পরাজয় তখন ছিল সময়ের ব্যাপার। ইহুদিদের অস্ত্রের মজুদও ফুরিয়ে যায়। আর কিছুটা এগোলেই মিসরীয় বাহিনী তেলআবিব কব্জা করে ফেলতে পারত। কিন্তু তখনই ইসরায়েলের সৃষ্টিদাতার মতো ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয় জাতিসংঘ। ইহুদি ও আরব দেশগুলোকে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয় সংস্থাটি। তবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির এই যুদ্ধবিরতির ফাঁদে পা দেয় আরব বাহিনী। যুদ্ধবিরতির সুযোগে চেকোস্লোভাকিয়ার কাছ থেকে আধুনিক অস্ত্রের চালান এসে পৌঁছায় ইসরায়েলে। ফাঁদটা কাজে লাগিয়ে আরবদের ওপর নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ে ইহুদিরা। আরবদের হটিয়ে নতুন কিছু জায়গাও কবজা করে নেয়। আরব দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা না থাকার কারণেই নতুন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে মাথা তোলার সুযোগ পায় ইহুদিরা।

পরের জায়গা পরের জমিতে ঘর বানিয়ে থাকলেও উদ্বাস্তু ইহুদিরা কখনোই সে ঘরের মালিক ছিল না। ওদিকে নিজেদের জায়গাজমি-ঘর ও ঠিকানা হারিয়ে আসল মালিক ফিলিস্তিনিরা এখন উদ্বাস্তু হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দুনিয়ার নানা দেশে। একসময় ইহুদিরা যে রকম ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল। সময় গড়ানোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ইহুদি-ফিলিস্তিন সমস্যা প্রকট থেকে প্রকটতর হয়ে উঠেছে। পরজমি দখলকারী ইহুদিদের নৃশংসতার শিকার হচ্ছে অসংখ্য ফিলিস্তিনি নাগরিক। ফিলিস্তিনি ইস্যুতে ১৯৫৬, ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে আরো তিনবার আরব-ইহুদি যুদ্ধ হয় এবং প্রতিটা যুদ্ধই আরবদের জন্য দুর্ভোগ বয়ে এনেছে। আরো অপ্রতিরোধ্য ও সাম্রাজ্যবাদী হয়ে উঠেছে ইসরায়েল। নিরীহ আরবদের করুণ আর্তনাদ আর হাহাকারে গুমোট হয়েছে ইহুদি অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলগুলো।

গায়ের জোরে টিকে আছে ইসরায়েল। আর তাদের এই গায়ের জোরের ইন্ধন জুগিয়েছে বিশ্বের দুই সাম্রাজ্যবাদী শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। গত শতাব্দীর ষাটের দশকেই পারমাণবিক শক্তি অর্জন করে গায়ের জোর বাড়িয়েছে ইসরায়েল। অস্ত্র ও অর্থের জোর এতটাই হয়েছে যে, ইসরায়েল এখন দুনিয়াকেই গনায় ধরে না। যাচ্ছেতাই কাণ্ড ঘটাচ্ছে যখন তখন। ইচ্ছেমতো নতুন অস্ত্রের কার্যকারিতার পরীক্ষা চালাচ্ছে নিরীহ ফিলিস্তিনি জনগণকে গিনিপিগ বানিয়ে। কৃত্রিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত কত আরবের রক্ত ঝরিয়েছে, সে হিসেব নেই। যতই দিন গড়াচ্ছে, ততই মার খাচ্ছে জায়গাজমি ও ঘরের বৈধ মালিক ফিলিস্তিনিরা।

১৯৭৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ২৯ নভেম্বরকে ফিলিস্তিনি জনগণের সঙ্গে সংহতি প্রদর্শন হিসেবে ‘আর্ন্তজাতিক ফিলিস্তিন সংহতি দিবস’ হিসেবে গ্রহণ করে। এর ১০ বছর পরে ১৯৮৭ সালের ২৯ নভেম্বর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ‘ইউনাইটেড নেশনস পার্টিশন প্ল্যান ফর প্যালেস্টাইন’ প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। এরপর থেকে এ দিনটি ‘আন্তর্জাতিক ফিলিস্তিনি সংহতি দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। এরই ধারাবহিকতায় ২০১২ সালে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ফিলিস্তিনকে পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা দেওয়া হয়। আর ২০১৫-এর ৩০ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সদর দপ্তরে ফিলিস্তিনের জাতীয় পতাকা স্থান পায়।

সংহতি দিবসে জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ইউনেসকোর আশা ফিলিস্তিনি জনগণ যেন শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান এবং স্বাধীনতাকে প্রকাশ করার সুযোগ পায়। দেশের নারী ও শিশুসহ সব মানুষ যেন সব ধরনের ঘৃণা, হিংসা ও বিদ্বেষমুক্ত হয়ে স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারে। নিরাপদে ও শান্তিতে থাকতে পারে। যদিও জাতিসংঘের ঘোষণার অনেক আগে থেকেই ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি দেখিয়ে আসছে বাংলাদেশ। এমনকি রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলকে এখন অবধি স্বীকৃতিও দেয়নি। কারণ বাংলাদেশ কখনোই সাম্রাজ্যবাদে বিশ্বাস করে না।

লেখক: শিশুসাহিত্যিক, প্রবন্ধকার

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close