হামিদা রহমান

  ২৮ নভেম্বর, ২০২২

মুক্তমত

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিকারের উপায়

মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয়ে থাকে সুষম খাদ্যের। সুষ্ঠুভাবে জীবনযাপনের জন্য কতিপয় নিত্যপ্রয়োজনীয় এবং বিভিন্ন বিলাসী পণ্যের জায়গা হয় ক্রয়দ্রব্যের। ফলে বাংলাদেশে আকস্মিক দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে চাহিদাভেদে মানুষ বিলাসী পণ্যগুলোকে বাজারের ফর্দ থেকে বাদ দিতে পারলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলোকে বাদ দিতে পারছে না। এতে জনজীবনে সৃষ্টি হচ্ছে মানসিক চাপ। বর্তমানে যে হারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে তাতে মানুষকে সুষম খাদ্য তো দূর, প্রতিদিন বেঁচে থাকার জন্যও করতে হচ্ছে লড়াই।

বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণগুলো তাহলে কী? সম্প্রতি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মতো ক্ষমতাধর দেশগুলো ইউক্রেনের পক্ষ নেয় এবং যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানি তেল উৎপাদনে বিশ্বেরঅন্যতমশীর্ষ দেশ রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে রাশিয়ার তেল রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ইউরোপজুড়ে জ্বালানি সংকট দেখা দেয়। এতে করে জ্বালানির দাম বেড়ে যায় এবং বৃদ্ধি পায় নিত্যপণ্যের দামও।

বর্তমানের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটকে বিশেষজ্ঞরা ৭০ দশকের বিশ্ব অর্থনীতির মন্দার সঙ্গে তুলনা করেছেন, যার মূল কারণ ছিল তেলের সরবরাহ কমে যাওয়া। আর বর্তমানের অর্থনৈতিক মন্দার কারণ হচ্ছে প্রাকৃতিক গ্যাসের অসহনীয় মূল্যবৃদ্ধি। বাংলাদেশও এইমন্দ অর্থনীতির স্বীকার। তবে বাংলাদেশে তেল না থাকলেও গ্যাসের মজুদ রয়েছে। অথচ সেই গ্যাস উত্তোলনে যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় জ্বালানির সিংহভাগ অংশই আমদানিনির্ভর। গ্যাসের চাহিদার এক-তৃতীয়াংশ মেটানো হয় স্থানীয় উৎপাদন দিয়ে বাকিটা আমদানি করতে হয়। যার ফলে সরকারকে এই জ্বালানি খাতে বছরে ৫১হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১-২২ অর্থবছরে ১১ মাসে তেলজাতীয় পণ্যে আমদানিতে পরিশোধ করতে হয়েছে ৭ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলার যা ২০১৯-২০ অর্থবছরে ছিল ৩ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন। সে হিসাবে ব্যয় বেড়েছে ১০৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ।ফলে কমেছে তেলভিত্তিক জ্বালানি আমদানি এবং দেশের জ্বালানি ঘাটতি প্রতিনিয়ত বাড়ছে। অন্যদিকে বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হচ্ছে।নতুন সমন্বয়কৃত তেলের দামের কারণে পরিবহন ও বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। সর্বশেষ আপডেট অনুযায়ী পাইকারি বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ।পণ্য পরিবহন ও শিল্প-কারখানার উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য, কাঁচামাল এমনকি এই শীতে শাক-সবজির দামও বেড়েছে অতিমাত্রায়। ফলে যেসব মানুষের আয় সীমিত তারা বিলাসীপণ্যের ব্যয় কমাচ্ছে। অন্য দিকে একদমই নিম্নপর্যায়ের মানুষজন তাদের বাজারের তালিকা থেকে কম চাহিদার নিত্যপণ্যগুলোও বাদ দিতে বাধ্য হচ্ছে।

দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধির কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ যে হিমশিম খাচ্ছে, টিসিবির লাইনের দিকে তাকালেই তার সত্যতা মেলে। নিম্নবিত্তের পাশাপাশি মধ্যবিত্ত মানুষেরও উপস্থিতি দেখা যায় সেখানে। কিন্তু এসব ট্রাকের পণ্য সীমিত থাকায় লাইনে দাঁড়িয়েও শেষ পর্যন্ত সবাই পণ্য পান না। আবার পণ্য প্রদানেও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। যার মধ্যে স্থানীয় প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণ ও তাদের স্বজনদের প্রাধান্য দেওয়া, কোথাও কোথাও এই পণ্য ডিলার কর্তৃক বাজারে বিক্রি হওয়া এগুলো হলো উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আবার টিসিবির এই কার্যক্রমে প্যাকেজ সিস্টেমে তেল, আটা, চিনির সঙ্গে বাধ্যতামূলকভাবে পেঁয়াজ দেওয়া হচ্ছে, এখন অনেকের পেঁয়াজ তো নাও লাগতে পারে, সেক্ষেত্রে তাকে বিপাকে পড়তে হচ্ছে।

২০২০ থেকে ২০২২ পর্যন্ত মোটা চাল ৫৩ শতাংশ, সরু চাল ৪৪ শতাংশ, খোলা আটা ৯৬ শতাংশ, খোলা ময়দা ৫৮ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়েছে।সর্বশেষ আপডেট অনুযায়ী সয়াবিন তেল লিটারে ১২ টাকা বেড়ে ১৯০ টাকা,চিনি ১৩ টাকা বেড়ে ১০৮ টাকা হয়েছে। এমনকি শ্যাম্পু,টুথপেস্টে বেড়েছে ৫-১০ টাকা, শিক্ষা উপকরণও বাদ যায়নি। শুধু পণ্যের দামের ক্ষেত্রেই নয়, বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য সার্ভিস চার্জ বাড়ায় আগের তুলনায় বাসা-ভাড়াও বেড়ে গেছে। দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষদের মাসিক প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যয় হচ্ছে খাদ্যক্রয়ে, তাও শুধু শাক-সবজি, ডাল-ভাত, মাছ-মাংসতাদের খাদ্যতালিকায় এখন আর স্থান পায় না। এটি যেন এখন বিলাসী পণ্য হয়ে উঠছে তাদের নিকট।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই ঊর্ধ্ব মূল্যের কারণ কি শুধু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নাকি আরো কিছু? উত্তর হলো যুদ্ধের পাশাপাশি রয়েছে দুর্নীতি, দায়িত্বশীলদের গাফিলতি, অনিয়ম, ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট যা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ক্ষেত্রে আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করেছে।এখন প্রশ্ন উঠতে পারে অন্যান্য দেশেও তো মূল্যবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি ঘটেছে তা কেন? উত্তর হলো যুদ্ধের জন্যসব দেশেই কমবেশি নাকানিচুবানি খাচ্ছে এটা যেমন সত্য, তেমনি দুর্নীতি না হলে সংকট মোকাবিলায় আমরা একটু হলেও উপকৃত হতাম এটাও নিরেট সত্য।

বিশ্ব খাদ্য সংস্থা বলেছে,বর্তমানে খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ে যে সংকট চলছে তা ২০২৩ সালে খাবার না পাওয়ার সংকটে পরিণত হবে।জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউ এফপি) নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বেসলি এক সতর্কবার্তায় বলেছেন, বিশ্বের সাড়ে ৩৪ কোটি মানুষ অনাহারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি এক জরিপের তথ্যে জানা যায়, যুক্তরাজ্যের ২৫ শতাংশ মানুষ তাদের এক বেলার খাবার খাওয়া বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে যুদ্ধজনিত মূল্যস্ফীতির কারণে। অতএব বলা যায়, বিশ্ব আগামী বছরের মধ্যে খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে যদি না যুদ্ধের অবসান হয়।

এরইমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাস দিয়েছেন এবং তা মোকাবিলায় দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটিতে ফসল ফলানো ও মিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বান করেছেন। সর্বোপরি, সম্ভাব্য খাদ্য সংকট বা দুর্ভিক্ষকে মোকাবিলা করতে সবাইকে আরো সতর্ক হতে হবে এবং অর্থ ব্যয় ও প্রকল্প গ্রহণে সাবধান হতে হবে। এক্ষেত্রে কারো পৌষ মাস কারো সর্বনাশ এমনটি যাতে না ঘটে, তারই প্রত্যাশা করে সাধারণ জনগণ।

লেখক : শিক্ষার্থী ও কলাম লেখক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close