reporterঅনলাইন ডেস্ক
  ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২

দাসত্বের দাদন প্রথা আর কত দিন

দাদন শব্দটি ফারসি দাদন (প্রদান করা) শব্দ থেকে উদ্ভূত। কোনো ব্যক্তি কোনো ব্যবসায়িক চুক্তি হিসেবে কোনো কিছু অগ্রিম দিলে তাকে দাদনদার বলা হয়। আঠারো শতকে বাংলায় ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসা-ব্যবস্থাপনায় দাদন কথাটি একটি বাণিজ্যিক পরিভাষা হিসেবে চালু হয়। কোম্পানি বাজার থেকে পণ্য সংগ্রহের জন্য যে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের নিযুক্ত করত, তাদের দাদন ব্যবসায়ী বলা হতো। তারা কিছু নির্ধারিত শর্তে পণ্য সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতিতে কোম্পানির কাছ থেকে আগাম অর্থ গ্রহণ করত। স্থানীয় বাজারে গিয়ে নির্ধারিত সময় ও বর্ণনা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহের শর্তে প্রকৃত উৎপাদক বা চাষিকে আগাম হস্তান্তর করার জন্যই তাদের এ অর্থ প্রদান করা হতো। দাদন ব্যবসায়ীরা সরাসরি প্রকৃত উৎপাদককে কিংবা দালাল বা পাইকার (স্থানীয় আড়তদার) নামে অভিহিত দ্বিতীয় পর্যায়ের মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে ওই দাদন হস্তান্তর করতেন। দাদন ব্যবসায়ী এ কাজ করতেন একটি নির্ধারিত কমিশনের বিনিময়ে; যার একটা অংশ অন্যান্য মধ্যস্থতাকারী তথা দালালরাও পেতেন। বহু দাদন ব্যবসায়ী যথাসময়ে পণ্য সরবরাহে ব্যর্থ হতেন এমনকি তাদের অনেকে আগাম দেওয়া কোম্পানির অর্থ নিয়ে গা-ঢাকা দিতেন। এসব কারণে ১৭৫৩ সালে দাদন প্রথা রহিত করা হয়। তবে গ্রামবাংলায় এই দাদন ব্যবসা আজও অব্যাহত এবং তা সুদভিত্তিক। সুদের কারবারি মহাজনরা গ্রামের গরিব চাষিদের সুদে ঋণ বা দাদন দেন এবং নির্ধারিত সময়ে সুদাসলে তা আদায় করেন। বর্তমানে বিভিন্ন এনজিওর ব্যানারে ঋণ কর্মসূচির নামে চলছে চড়া সুদে দাদন ব্যবসা। এমনকি ইসলামি শরিয়াহ ভিত্তিক পরিচালিত সংস্থার নামেও চলছে দাদনের কারবার। এর বাইরে ব্যক্তিপর্যায়েও চলছে। চলছে সামাজিক লুণ্ঠন। অদৃশ্য শোষণ ও নির্যাতন।

বাংলাদেশে জেলে ও সামুদ্রিক খাদ্য সেক্টরে দাসত্বের দাদন প্রথার যেন রমরমা অবস্থা। অনেক দেনদরবার হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। নিপীড়িত হয়েছে জেলে সম্প্রদায়। স্ফীত হয়েছে মহাজনের সুখের ভা-ার। বিষয়টি আইনসিদ্ধ না হলেও এখনো চলছে। বন্ধ হওয়ার কোনো লক্ষণও নেই। আসলে রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগ ব্যতীত পরিবর্তন সম্ভব নয়। তবে থেমে থেমে আন্দোলনের খবর ভেসে আসে। এ রকম একটি সংবাদ সাউথ এশিয়ান অ্যালায়েন্স ফর প্রভার্টি ইরাডিকেশন (স্যাপি), বিএনএসপি, টেক্সটাইল গার্মেন্টস ওয়ার্কার ফেডারেশন, ইনসিডিন বাংলাদেশ ও জন-উদ্যোগের হাত ধরে একটি প্রতিবেদন আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়।

প্রতিবেদনে মৎস্য খাতে দাসত্বের দাদন প্রথা বন্ধের সুপারিশ করা হয়। একই সঙ্গে সামুদ্রিক খাদ্য সেক্টরের বৈশ্বিক ভ্যালু চেইনে ন্যায্যমূল্যে ও ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত এবং আইনের ব্যবহার নিশ্চিত করাসহ শ্রমিকদের শোষণ বন্ধ করার সুপারিশও করা হয়। প্রতিবেদনের তথ্য মতে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মুনাফাতাড়িত রপ্তানিনির্ভর সামুদ্রিক খাদ্যের ভ্যালু চেইনে মানবাধিকার লঙ্ঘন, ঋণগ্রস্ততা ও বৈষম্য রয়েছে। বিশেষভাবে জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্য অনেক বেশি। রপ্তানিকারক ও প্রক্রিয়াজাতকরণে নিয়োজিতরা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী হওয়ায় শ্রমজীবী মানুষের দুর্দশা পাকাপোক্ত হচ্ছে।

অধিকাংশ মৎস্যজীবী দরিদ্র, নিজেদের কোনো নৌকা নেই। কাজ করেন দৈনিক মজুর ভিত্তিতে। নৌকার মালিক বা মহাজনের কাছ থেকে আগাম দাদন বা ঋণ নিয়ে থাকেন। আনুষ্ঠানিক কোনো চুক্তিপত্র থাকে না। আগাম ঋণ বা দাদনের বিপরীতে শ্রম বিক্রি করে তা পরিশোধ করেন। অলিখিত চুক্তি এবং বর্তমান বর্বর বাস্তবতায় এ ঋণ কখনো শোধ হওয়ার নয়। ক্রমশ তারা মহাজনের কাছে দাসত্বের শৃঙ্খলে বাধা পড়েন। সভ্যতার নামাবলি গায়ে এ যেন সেই দাস ও সামন্ত যুগের নো ম্যান্স ল্যান্ডে বসবাস। কিন্তু এভাবে আর কত দিন! কবে এসব মানুষ রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রতিফলন দেখবে!! এটিই জিজ্ঞাসা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close