জান্নাতুন নিসা

  ১৬ আগস্ট, ২০২২

ব্যক্তিত্ব

মুক্তচিন্তার প্রতিধ্বনি অধ্যাপক যতীন সরকার

কালের আবর্তে বিচিত্র জন্মান্তরের নিদাঘ ছায়া আলোর পসরা সাজায়। সে আলো একদিকে আমাদের মানবসমাজকে যেমন আলোকিত করে তোলে; তেমনি অন্যদিকে আলোকিত করে তোলে বিশ্বজগৎ। যেখানে আলোর ধারক হয়ে চিরায়ত সত্যের উনুনে আপন মনন আর চিন্তাকে ঝলসে নিতে ব্যস্ত সময় পার করেন কেউ কেউ। বেলা-অবেলার বৈকুণ্ঠে স্রোতের ভাববাদী জীবনকে প্রশ্নের দুয়ারে দ্বার করিয়ে নিমগ্ন হয়ে উঠেন তারা। প্রশ্নের বিপরীতে হয়ে উঠেন মননচর্চায়পূর্ণ অবিনাশী উত্তরের জ্যোতির্ময় এবং অনবদ্য এক পর্বতসম জ্ঞানভা-ার। অন্তর্ভেদী দক্ষতার বিশ্লেষণে সাম্যবাদী সাহিত্যের ভিন্নতম চর্চায় বাঙালির পর্বতসম সেই জ্ঞানভা-ারের অনন্য এক নাম যতীন সরকার। রবীন্দ্র পরবর্তী সময় থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত সত্য সন্ধানী অনেকের সান্নিধ্যে এগিয়ে চলেছে বাঙালির প্রগতিশীলতার চর্চা। তবে সেই চর্চায় আদর্শনিষ্ঠ একজন শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী এবং প্রাকৃতজনের দার্শনিক হিসেবে অধ্যাপক যতীন সরকার হয়ে উঠেছেন মুক্তচিন্তার প্রতিধ্বনি। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার চন্দপাড়া গ্রামের একজন হেমিওপ্যাথি ডাক্তার জ্ঞানেন্দ্র চন্দ্র সরকার এবং গৃহিণী বিমলা বালা সরকারের ঘর আলো করে ১৯৩৬ সালের ১৮ আগস্ট (বাংলা ১৩৪৩ সালের ২ ভাদ্র) জন্মগ্রহণ করেন গুণিজন যতীন সরকার। আমরা জানি, আঁধারি ঘেরাটোপে খচিত বিদীর্ণ সময়ের দৃশ্যপট মানবজীবনকে মধুর করে তোলে। আবার নিভৃত সুজন্যতায় খুঁজে ফিরে ক্লান্ত দেরাজের সপ্রতিভ রামধনু। তাই হয়তো দেশবরেণ্য একজন বুদ্ধিজীবী হয়েও যতীন সরকার নীরবে-নিভৃতে সমগ্র জীবন কাটিয়ে চলেছেন ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনায়।

তথাগত ঐশ্বর্যের স্থির আবহে টইটম্বুর যতীন সরকারের ছেলেবেলাটা প্রথাগতভাবে কাটেনি। অবশ্য কাটেনি না বলে বলা উত্তম যে, তার ছেলেবেলা প্রথাগত খেলাধুলা বা গ্রামের অন্য সবার মতো কাটাতে দেওয়া হয়নি। কারণ একে তো তিনি খুব ভালো ছাত্র ছিলেন বলে তেমন একটা সুনাম ছিল না। অন্যদিকে খেলাধুলা থেকেও তাকে বিরত রাখা হতো বরাবর। কারণ তার ঠাকুরদা রামদয়াল সরকার এবং ঠাকুরমা মুক্তসুন্দরী সরকারের একমাত্র সন্তান ছিলেন তার বাবা। আর তার জন্মের আগে এক বোন হলেও মা-বাবার ঘর শূন্য করে সে পরপারে চলে যায়। এরপর তার জন্ম যেন বংশে আলো জ্বেলে রইল। বংশবিলোপের আশঙ্কায় ‘তোরে মাথায় রাখি না উকুনে খাবে, মাটিতে রাখি না পিঁপড়ায় খাবে’ বুলিতে ঠাকুরমা একেবারে ঘরকোনো করে রাখলেন তাকে। তবে তিনিও শুরুতে স্কুলের পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে নিতান্ত পরীক্ষা পাসের জন্য যেটুকু দরকার, সেটুকু ছাড়া কোনো সম্পর্কই রাখতে আগ্রহী ছিলেন না। অবশ্য পরীক্ষায় ফেলও করেননি একেবারে। গড়পড়তা পাস করে গেছেন। তাই বুঝি শ্রান্ত অন্ধকারে জমে থাকা আলোর ন্যায় যতীন সরকারের ছাত্রজীবন শুরু হয় রামপুর ফ্রি বোর্ড প্রাইমারি স্কুলে। এরপর ১৯৫৪ সালে মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে পাস করেন। ১৯৫৫ সালে নেত্রকোনা কলেজে আইএ ভর্তি হন। নেত্রকোনা কলেজ থেকে আইএ পাসের পর ১৯৫৭ সালে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে বিএ ভর্তি হন। ১৯৫৯ সালে বিএ পাস করার পর ১৯৬১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ ভর্তি হন। ১৯৬৩ সালের নভেম্বরে এমএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

এদিকে শৈশব-কৈশোরের দৌড়ঝাঁপ-খেলাধুলা থেকে ফিরিয়ে রেখে শারীরিকভাবে অসাড় জীবনে পরিবার থেকেই তাকে বইপত্রের মধ্যে একেবারে গুঁজে দেওয়া হয়েছিল মুক্তজীবনের আহ্বানে। তাদের বাড়ি থেকে আধামাইল দূরে কবিরাজ বাড়ির কবিরাজ জগদীশ চন্দ্র নাগ বেশ কয়েকটি পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। অস্থিরতা কাটাতে মুক্ত বেদনার মুখোমুখি হয়ে তিনি সেখানে চলে যেতেন পত্রিকা পড়তে। ‘বসুমতী, ‘প্রবাসী’, সাপ্তাহিক ‘দেশ’সহ বিভিন্ন মাসিক পত্রিকাও পড়তেন। আবার ঠাকুরদা তাকে রামায়ণ, মহাভারত, রামকৃষ্ণ কথামৃত, স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী ইত্যাদি পড়ে শুনাতেন। বাংলার পাশাপাশি সংস্কৃত পাঠেরও শুরুটা তাই পারিবারিক পরিমণ্ডলেই হয়েছে তার। তবে পাথর ডিঙ্গানো অরণ্যের হাত ধরে তার ঘরের আদর-আহ্লাদ খুব বেশিদিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। কারণ দেশভাগের প্রায় পরপরই তার পরিবারকে দরিদ্রতা ঘিরে ফেলে আর প্রচণ্ড দারিদ্র্যের মধ্যে তাকে পড়াশোনা করতে হয়। রামপুর বাজার নেত্রকোনা জেলা সদর থেকে প্রায় দশ মাইল দূরে কেন্দুয়া থানায় অবস্থিত। গৌরীপুর থেকে রামপুরের ভেতর দিয়ে মদন থানা পর্যন্ত একটি রাস্তা চলে গেছে। ময়মনসিংহ থেকে নেত্রকোনা হয়ে রামপুরের ভেতর দিয়ে অপর একটি রাস্তা চলে গেছে কেন্দুয়া থানায়। এই চৌরাস্তার মোড় ঘিরে জমে ওঠা রামপুর বাজারের পৌনে এক মাইলের মধ্যে চন্দপাড়া গ্রাম। এই গ্রামেরই পার্শ্ববর্তী দলপা ও নন্দীগ্রাম ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। পাকিস্তান হওয়ার পর সেখানকার লোকজন ভারতে চলে যায়। ফলে তার বাবার পেশাগত জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। শুরু হয় তার পরিবারের আর্থিক দৈন্যতা। গত্যান্তর না দেখে অষ্টম শ্রেণিতে থাকাকালীনই রামপুর বাজারে তাকে দোকান খুলে বসতে হয়। বাজারে চাটাই বিছিয়ে তিনি ডাল, পান, বিড়ি, বিস্কুট ইত্যাদি বিক্রি করে সংসারের প্রতিদিনের খরচ জোগাতে থাকেন। এখানে থাকতেই তিনি দেখেন দুনিয়ার খবরাখবর প্রথম এ বাজারেই এসে পৌঁছায় এবং পরে ছড়িয়ে পড়ে গ্রামের মানুষের মুখে মুখে। তাইতো ছেলেবেলার যতীন সরকারের কাছে বড়বেলায় এসে এই বাজার খ্যাতি লাভ করেছে ‘দুনিয়ার জানালা’ হিসেবে।

অর্থের সটান চাপায় আটকে থেকে যতীন সরকারের ছাত্রজীবন ফ্যালফ্যালে আলেয়ায় ডুবন্ত রহস্যের ন্যায় যথেষ্ট ঝকঝকে ছিল না। অষ্টম শ্রেণিতে যেই অর্থকষ্ট শুরু হয়েছে তা থেমে থাকেনি। তাইতো মেট্রিক পাস করার পরও আইএ ক্লাসে ভর্তির টাকা জোগাড় করার জন্য তাকে এক বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। টিউশনি করে টাকা জমিয়ে তবেই নেত্রকোনা কলেজে ভর্তি হতে পারেন তিনি। ১৯৫৬ সালে দুর্ভিক্ষের সময় যে পরিবারে লজিং থাকতেন, সে পরিবারের অভাবের সংসারে অর্থের জোগান দেওয়ার পাশাপাশি অনেক দিন সবার সঙ্গে তাকেও থাকতে হয়েছে অনাহারে। ময়মনসিংহ শহরে লজিং থেকেই চলতে থাকে তার বিএ পড়া। কষ্টের ধারাবাহিকতা না থামিয়ে ১৯৫৯ সালে বিএ পরীক্ষা দিয়েই নেত্রকোনার আশুজিয়া হাইস্কুলে শুরু করেন শিক্ষকতা। পরে বারহাট্টা থানা সদরের হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। এই স্কুলেই কবি নির্মলেন্দু গুণ তার ছাত্র ছিলেন। অনেক আশার ভূগর্ভ থেকে আলোর প্রতিবিম্ব হবেন বলেই হয়তো থেমে না থেকে তিনি এমএ ভর্তি হন। ১৯৬১ সালের গোড়া পর্যন্ত প্রায় দুই বছর শিক্ষকতা করে টাকা জমিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ও তাকে কষ্ট করে পড়াশোনার খরচ জোগাতে হয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন ড. মুহম্মদ এনামুল হক, মুস্তফা নূরউল ইসলাম। ১৯৬৩ সালের অক্টোবরেই বাংলার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর হাইস্কুলে। এরপর ১৯৬৪ সালের আগস্টে ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজে বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন তিনি। ১৯৬৭ সালের নভেম্বরে বন্ধু শচীন আইচের বোন কানন আইচকে বিয়ে করেন যতীন সরকার। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি যখন ভারতে, তখন তার স্ত্রী কানন সরকারকে তার বাবার পরিবারের সঙ্গে আত্মরক্ষার তাগিদে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হয়। তাদের ছেলে সুমন সরকার ও মেয়ে সুদীপ্তা সরকার। সৃষ্টির পরতে সৃষ্টির ছায়া মেখে আজন্ম লালিত স্বপ্নে জীবনের বেশির ভাগ সময় শিক্ষকতা করেছেন তিনি। আর গোধূলিলগ্নের আলোকিত শীর্ষ ছুঁয়ে ৪২ বছরের বেশি সময় শিক্ষকতা পেশায় থেকে ২০০২ সালে অবসর গ্রহণ করেছেন।

তীক্ষè কলমের টগবগে স্রোতের দুরন্ত কার্নিশে দাঁড়িয়েও যতীন সরকার প্রথাগতভাবে রাজধানীবাসী হননি। বরং নিজ এলাকার জনমানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে নেত্রকোনায় নিজের বাসভবন ‘বানপ্রস্থ’তে ব্যস্ত সময় পার করছেন শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চায়। সাম্যবাদী রাজনৈতিক দর্শনে অবিচল থেকে মননশীল সাহিত্যচর্চার স্বর্ণরেণু ছড়িয়েছেন তিনি। তাই হয়তো বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দীর্ঘ ১৮ মাস জেল খেটেও থমকে যাননি। বাম রাজনীতি এবং প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। প্রাণরসে হাস্যোজ্জ্বল প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক যতীন সরকার নেত্রকোনা কলেজে থাকাকালীন ছাত্রসংসদে সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হন। শিক্ষা ও পেশাগত জীবনের পাশাপাশি চলে তার রাজনীতি ও লেখালেখির প্রস্তুতি। নেত্রকোনা কলেজে থাকাকালীনই তিনি সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ছাত্রলীগের রাজনীতি দিয়েই শুরু তার ছাত্ররাজনীতি। ময়মনসিংহে আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হওয়ার পর কমিউনিজমে দীক্ষা নেন তিনি। এরপর শৈলেন রায়ের বাসার আড্ডা আর ময়মনসিংহ শহরের চন্দ্রকান্ত ঘোষ (সিকে ঘোষ) রোডের নয়া জামানা পুঁথিঘরের (ময়মনসিংহে কমিউনিস্টদের অলিখিত অফিস) আড্ডায় অবাধ যাতায়াত চলে যতীন সরকারের। এ সময়টাতেই তার হাতে আসে জোসেফ স্তালিনের দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ এবং মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ইসলামের ঐতিহাসিক অবদান গ্রন্থ। এ দুটি গ্রন্থ তার মননের অ্যানাটমি তোলপাড় করে নিয়ে চলে দ্বান্দ্বিকতার বৃষ্টিস্নাত গলিতে।

উন্মুক্ত আরতির সঙ্গ দিয়ে আনন্দমোহন কলেজে বিএ ক্লাসে পড়ার সময় কলেজ বার্ষিকীতে ‘আপনি কি লিখিয়ে?’ শিরোনামে একটি রম্যধর্মী রচনা প্রকাশের মাধ্যমে যতীন সরকারের প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়। এরপর বাংলা একাডেমি ‘পূর্ব পাকিস্তানের উপন্যাসের ধারা’ শীর্ষক প্রবন্ধ আহ্বান করে। সে বিষয়ের ওপর প্রবন্ধ লিখে ১৯৬৭ সালে তিনি ‘ডক্টর এনামুল হক স্বর্ণপদক’ লাভ করেন। লেখাটি তখন বাংলা একাডেমির পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং পরে আহসান হাবীব ‘দৈনিক পাকিস্তান’-এ পুনর্মুদ্রণ করেন। আহসান হাবীব অবশ্য তখন তাকে দিয়ে বেশকিছু প্রবন্ধও লিখিয়ে নেন। তার প্রথম গ্রন্থ ‘সাহিত্যের কাছে প্রত্যাশা’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় ‘বাংলাদেশের কবিগান’, ‘বাঙালির সমাজতান্ত্রিক ঐতিহ্য’, ‘সংস্কৃতির সংগ্রাম’, ‘মানবমন, মানবধর্ম ও সমাজবিপ্লব’। এ প্রবন্ধ গ্রন্থগুলোর পাশাপাশি শিশুদের জন্য সুপাঠ্য একটি ব্যাকরণ গ্রন্থও রচনা করেছেন তিনি। বাংলা একাডেমি থেকে ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত ‘গল্পে গল্পে ব্যাকরণ’ বাংলাদেশের শিশুসাহিত্যে এবং ব্যাকরণ গ্রন্থের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। বাংলা একাডেমির জীবনী গ্রন্থমালার মধ্যে চারটি গ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। যথাক্রমে- ‘কেদারনাথ মজুমদার’, ‘চন্দ্রকুমার দে’, ‘হরিচরণ আচার্য’, ‘সিরাজউদ্দিন কাসিমপুরী’। তার সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী’, ‘প্রসঙ্গ মৌলবাদ’ ও ‘জালাল গীতিকা সমগ্র’। এ ছাড়া তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে আরো রয়েছে ‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু দর্শন’, ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব, নিয়তিবাদ ও বিজ্ঞান-চেতনা’, ‘সংস্কৃতি ও বুদ্ধিজীবী সমাচার’, ‘সাহিত্য নিয়ে নানাকথা’ ইত্যাদি।

সময়ের দর্পণে তীক্ষè জলছাপ আঁকতে কেবল লেখালেখি বা অধ্যাপনার মাধ্যমে মানব মননের প্রগতির মুক্তির জন্য যতীন সরকার লড়াই করেননি। তিনি বরাবরই দক্ষ একজন সংগঠক ছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশে স্ত্রী ও শিশুপুত্রকে রেখে সেপ্টেম্বরে বাধ্য হয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের কাজ করতে থাকেন। বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য তিনি, সম্পৃক্ত রয়েছেন ময়মনসিংহ নাগরিক কমিটি এবং ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সঙ্গে। সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন তিনি, বাংলাদেশ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিরও সহসভাপতি ছিলেন। এতকিছুর মধ্যে নিজের প্রিয় সংগঠন ময়মনসিংহের মুক্ত বাতায়ন পাঠচক্রের সঙ্গ বহমান। এখানেই তার অনেক প্রবন্ধের প্রথম পাঠ অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং সেগুলোর আলোচনা-পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন হয়েছে। সাংগঠনিক ভূমিকার সূত্রেই তিনি ভাষা আন্দোলনের সময় নেত্রকোনার মতো অজপাড়াগাঁয়ে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে মিটিং-মিছিল করেছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে তিনি দাঙ্গাবিরোধী ভূমিকা রাখেন। এ ছাড়া একজন কর্মী, সংগঠক ও অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বহু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের। ঘরকুনো মানুষ যতীন সরকার বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্যাটে সম্পর্কে বলতে ১৯৮১ সালে গিয়েছিলেন বার্লিনে। ২০০১ সালে স্লোভাকিয়ার রাজধানী বাতিসøাভায় গিয়েছিলেন ছেলের কাছে। এ ছাড়া ২০০১ সালে তিনি উদীচী সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন লন্ডনে। ভারতে গিয়েছেন বেশ কয়েকবার। সর্বশেষ ২০০৫ সালে লক্ষেèৗতে ফরোয়ার্ড ব্লকের সম্মেলনে যোগ দেন। এই গুণিজন ২০১০ সালে ‘স্বাধীনতা পদক’ এবং ২০০৮ সালে ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’-এ ভূষিত হন। ২০০৬ সালে ‘ডক্টর মোহাম্মদ এনামুল হক স্বর্ণপদক’, ২০০৪ সালে ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা বই ১৪১১’, এ ছাড়া ‘নারায়ণগঞ্জ শ্রুতি স্বর্ণপদক’, ‘ময়মনসিংহ প্রেস ক্লাব লিটারারি অ্যাওয়ার্ড’, ‘খালেকদাদ চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার’ এবং ‘মনিরুদ্দিন ইউসুফ সাহিত্য অ্যাওয়ার্ড’সহ বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। সবশেষে যে কথাটি না বললেই নয়, বিশ্লেষণের বৈচিত্র্যে বাঙালির মননশীলতায় বিপ্লবাত্মক দর্শনের ঔপনিবেশিক সম্মিলন বহমান। আর তা দূরে ঠেলে প্রান্তিকজনের জ্ঞানতাপস অধ্যাপক যতীন সরকার প্রজন্মের কাছে মুক্তচিন্তার আদর্শ হয়ে থাকবেন তার সপ্তাশীতি জন্মদিন পেরিয়েও- এই প্রত্যাশায়।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও নারীনেত্রী

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close