অলোক আচার্য

  ১৫ জানুয়ারি, ২০২২

ফিরে দেখা

বাংলার পিঠা উৎসব ও পৌষসংক্রান্তি

বাংলার সংস্কৃতি বৈচিত্র্যময়। পিঠার কথা উঠতেই বাংলা মুলুকে পৌষ কথা আসে। পৌষের শীতে জমে ওঠে পিঠাপুলির আয়োজন। এ মাস এলেই সবাই যেন নস্টালজিক হয়ে ওঠে। এ আয়োজনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় পৌষসংক্রান্তিতে। পৌষসংক্রান্তি আবহমান বাংলার এক চিরায়ত সংস্কৃতি। পিঠা উৎসবের সঙ্গে এর ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র রয়েছে। এর আরেক নাম মকরসংক্রান্তি। পৌষ মাসের শেষ দিনে এই সংক্রান্তি পালন করা হয়। বিশেষ করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ দিনেই আনুষ্ঠানিকভাবে খোলা পুড়িয়ে (চিতই পিঠা বানানোর মাটির পাত্র) পিঠা তৈরি শুরু করে। অনেকেই আজও এই দিনের আগে পিঠা খান না। আর তাই এই সংক্রান্তি পিঠা উৎসবে পরিণত হয়েছে।

বাংলা পৌষ মাসের শেষের দিনে এই উৎসব হয়ে থাকে। শেষের দিন হলেও সাধারণত দুই-তিন দিন ধরে হরেক রকম পিঠা বানানোর কাজ চলে প্রতিটি হিন্দু বাড়িতেই। চলে জামাইকে নিমন্ত্রণ অথবা জামাইয়ের বাড়িতে তৈরি পিঠা পৌঁছে দেওয়ার পালা। একসময় গ্রাম বাংলায় বেশ ঘটা করে এই দিন পালনের রেওয়াজ ছিল। তবে কালের বিবর্তনের সঙ্গে হারিয়ে গেছে সেসব রীতিনীতি। এই বিশেষ দিনকে কেন্দ্র করে ঘুড়ি ওড়ানো উৎসবের আয়োজন করা হতো। তা ছাড়া বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলেই বাজি ফুটানো, ফানুস ওড়ানো এসব আনন্দ উৎসবের ভেতর দিয়ে আনন্দমুখর এ উৎসবের সমাপ্তি ঘটত। পিঠা যে শুধু খাওয়া নয় বরং সবাই মিলে আনন্দ করার এক অনুষঙ্গ সেটাও টের পাওয়া যায় এই উৎসব থেকে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষত দক্ষিণ এশিায়ায় এই দিবস বা ক্ষণকে ঘিরে উদযাপিত হয় উৎসব। নেপালে এই দিবস মাঘি নামে, থাইল্যান্ডে সংক্রান, লাওসে পি মা লাও, মিয়ানমারে থিং ইয়ান এবং কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান নামে উদযাপিত হয়। আবশ্যিকভাবে দেশ ভেদে এর নামের মতোই উৎসবের ধরনে থাকে পার্থক্য। জানা গেছে, প্রাচীন মহাকাব্য মহাভারতেও এই দিনের তাৎপর্য সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। পৌষসংক্রান্তিতে মূলত নতুন ফসলের উৎসব ‘পৌষ পার্বণ’ উদযাপিত হয়। নতুন ধান, খেজুরের গুড় এবং পাটালি দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ঐতিহ্যবাহী পিঠা তৈরি করা হয়, যার জন্য প্রয়োজন হয় চালের গুঁড়া, নারিকেল, দুধ আর খেজুরের গুড়। পৌষ সংক্রান্তির মাধ্যমে আমরা পৌষ মাসকে বিদায় জানাই ও মাঘ মাসকে আলিঙ্গন করি। সংক্রান্তির দিনে বাংলার বধূরা নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী বিভিন্ন নকশা ও সুস্বাদু পিঠা তৈরি করেন। পঞ্জিকা মতে, পৌষ সংক্রান্তি পালিত হয় পৌষ মাসের শেষ দিন। জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে শুরু হয় এই দিন।

মকরসংক্রান্তির দিন সূর্য নিজ কক্ষপথ থেকে মকর রাশিতে প্রবেশ করে। তাই দিনটিকে মকর সংক্রান্তিও বলা হয়। প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্র অনুসারে ’সংক্রান্তি’ একটি সংস্কৃত শব্দ, এর দ্বারা সূর্যের এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে প্রবেশ করাকে বোঝানো হয়। বাংলাদেশ ও ভারত কৃষিপ্রধান দেশ। ফলে এই দুই দেশেই পৌষসংক্রান্তি বেশ উৎসবের সঙ্গে পালন করা হয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এই দিনে বাড়ির উঠানে দৃষ্টিনন্দন আলপনা দেয়। বাংলাদেশে পুরান ঢাকায় এই দিনকে কেন্দ্র করে ঘুড়ি উড়ানোর আয়োজন করা হয়। বিভিন্ন স্থানে পিঠাণ্ডপুলির মেলার আয়োজন করা হয়। পৌষ সংক্রান্তিতে অতিথিরা বেড়াতে আসেন। চলে পিঠা দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন। ধনী-গরিব প্রতিটি ঘরে ঘরে সাধ্যমতো পিঠা বানানোর তোড়জোড় চলে। হাজার বছর ধরে বাঙালির ঘরে ঘরে এই সংস্কৃতি চলে আসছে। এটা যতটা না খাওয়ার উৎসব তার থেকে বেশি বাংলার প্রাণের উৎসব। উৎসবের মতো করেই আয়োজন করে পিঠা খাওয়ার আয়োজন চলে আসছে।

পিঠা খাওয়ার জন্য পৌষ-মাঘ বেছে নেওয়ার কারণ হলো ঋতুর হিসেবে এ সময় শীতকাল চলে। পিঠা তৈরির নানা রকমের গুড় এ সময় বাজারে আসে। মিষ্টি খেজুরের রস থেকে খেজুরের গুড়, পাটালি গুড়, নলেন গুড়- এসব এ সময়েই পাওয়া যায়। গুড়ের মিষ্টি গন্ধে চারদিকে মণ্ডম করে। এইসব গুড় থেকে তৈরি পিঠা খেতে অত্যন্ত মজাদার। এসব গুড় শীতকাল ছাড়া দেখা পাওয়া যায় না। তাই পিঠা তৈরির জন্য শীতকালই উপযুক্ত। তা ছাড়া শীতের সকালের পিঠার স্বাদ অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে আলাদা। ঋতুর বৈচিত্র্যময়তা যে এক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে তা বলাই বাহুল্য। তাইতো বাঙালি পিঠা প্রিয় সেইসঙ্গে অতিথিপ্রিয়ও বটে।

‘পিঠে’ শব্দটি সংস্কৃত ‘পিষ্ঠক’ থেকেই এসেছে। পিঠে-পুলি খাওয়ার চল গ্রামবাংলার অস্থিমজ্জায় মিশে আছে। এমনভাবে মিশেছে যেন পিঠে নিজেই এক উৎসবের নাম। পিঠা আর আমরা বাঙালিকে আলাদা করার কোনো সুযোগ নেই। বাঙালি কতটা অতিথি পরায়ন তা এই সময় বেশ ভালোভাবেই বলা যায়। এই সময় নতুন ধান ওঠে, খেজুর গাছের হাঁড়ি বাঁধার দৃশ্য নিয়মিত। এই খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধার দৃশ্যও দেখার মতো। রস থেকে গুড় বানানোর পদ্ধতিও এক দেখার মতো বিষয়। দুই ধরনের খেজুর গুড় সংগ্রহ করার পদ্ধতি আছে । এক হলো প্রতিদিনের সন্ধ্যায় নতুন হাঁড়ি লাগিয়ে রাখা থাকে, পরদিন সূর্যোদয়ের আগেই তা সংগ্রহ করে ফের নতুন হাঁড়ি লাগিয়ে দিয়ে যায় গাছিরা। গাছের রস একদিন জিরিয়ে নিলে, তার থেকে আরো ভালো মানের রস পাওয়া যায়, মধুর মতো মোলায়েম ও পাতলা । এই নতুন গুড় মেশানো দুধের মধ্যে নারকেল পুরের সাদা সাদা পুলিপিঠের সোহাগি সাঁতার চোখ আর মনকে তৃপ্তি তো করেই, তার সঙ্গে জিভের জন্য যে অসাধারণ স্বাদের জোগান দেয় তার সঠিক বর্ণনা বোধহয় শুধুমাত্র জিভের স্বাদকোরকগুলোর কাছেই লুকিয়ে থাকে। বাংলাদেশের বিশেষ কিছু পিঠার মধ্যে অন্যতম হলো বিনি পিঠা, মালপোয়া পিঠা, সিমুই পিঠা, সূর্যমুখী পিঠা, ঝিনুক পিঠা চিতা পিঠা, খেজুর পিঠা, বিনুনীর মতো গড়া বেনি পিঠা, ঝাল কুশ পিঠা, মিঠে নকশায় সাজানো নকশই পিঠে, পাঁপড়ের আকারের মলকো পিঠা, করলা পিঠা, চঙ্গা পিঠা, মুঠা পিঠা ও রস চিতই পিঠা।

আজ বাজারে কেক, প্যাটিস পিৎজাসহ বাজারজুড়ে ফাস্টফুডের দাপট। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা পিঠে-পুলির স্বাদ ভুলতে বসেছে। বাজারে গিয়েই দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তেলে ভাজা চপ, বেগুনি খাওয়ার দৃশ্যই এখন পরিচিত। পিঠা বিষয়টা যেন বেশির ভাগ সময়ই অপরিচিত থাকে নতুন প্রজন্মের কাছে। আজকাল অনেক তরুণী ও বধূদের অনেকেই পিঠে-পুলি ও পাটিসাপটা কীভাবে তৈরি করতে হয় তা শেখেইনি । তবে বিষয়টা হলো পিঠা হলো আমাদের সংস্কৃতির একটা অংশ। আমরা চাইলেও সে অংশকে আলাদা করতে পারব না।

লেখক : শিক্ষক ও মুক্তগদ্য লেখক

পাবনা

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close