সাহাদাৎ রানা

  ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১

মতামত

সঞ্চয়পত্রে মুনাফা কমানো সমীচীন হবে না

সঞ্চয়পত্র, এখন অনেকের কাছে স্বপ্নের নাম। নিশ্চিত জীবনের নামও। অথচ এমন একটা সময় ছিল যখন মানুষ সঞ্চয়পত্রের প্রতি খুব একটা আগ্রহী ছিল না। তবে সময়ের স্রোতে এখন মানুষ কিছু টাকা জমিয়ে সঞ্চয়পত্রে টাকা রাখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এর মূল কারণ সবদিক দিয়েই লাভবান হন সঞ্চয়পত্রের গ্রাহক। আর অর্থের হিসেবে এটা গ্রাহকের কাছে অনেক বেশি নিরাপদও। কারণ, অল্প টাকা বিনিয়োগ করে ব্যবসায় খুব একটা লাভের আশা করা যায় না। বরং ক্ষতির আশঙ্কাই থাকে বেশি। সঙ্গে থাকে দুশ্চিন্তাও। এসব কারণে দুই দশক ধরে মানুষ সঞ্চয়পত্রের দিকে ক্রমশ বেশি আগ্রহী হচ্ছে। বিশেষত মধ্যবিত্ত আর অবসরে যাওয়া মানুষদের ক্ষেত্রে এ হার সবচেয়ে বেশি। কারণ এমন নিশ্চিন্ত বিনিয়োগই তাদের সংসার চালনায় সঞ্চয়পত্রের মুনাফা অতি কাছের বন্ধুর ভূমিকা পালন করছে। যে বন্ধুর কাছ থেকে শুধু নিশ্চিতে লাভের অঙ্কটা পাওয়া যায়। যেখানে থাকে না কোনো দুশ্চিন্তা। এতে মানুষজন নিশ্চিতে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে লাভের অঙ্কটা ঘরে তুলতে পারছে।

তবে একটি খবর, সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের কিছুটা হতাশ করেছে। সম্প্রতি সঞ্চয়পত্রে লাভের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগে পাঁচ বছরমেয়াদি সঞ্চয়পত্রে বর্তমানে মেয়াদ শেষে ১১.২৮ শতাংশ মুনাফা পাওয়া যেত। নতুন নিয়মে এই সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ যারা করবেন, তারা মেয়াদ শেষে মুনাফা পাবেন ১০.৩০ শতাংশ হারে। আর ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ করলে মুনাফার হার হবে সাড়ে ৯ শতাংশ। তবে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত মুনাফার হার আগের মতোই থাকবে। বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করতে সঞ্চয়পত্রে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগে মুনাফা কাটছাঁট করা হয়েছে। আর ৩০ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগ করলে লাভ কমবে সবচেয়ে বেশি। তবে এক্ষেত্রে এই নিয়ম পুরোনো বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। পুরনোরা আগের হারে মুনাফা পাবেন। তবে যারা সঞ্চয়পত্রে নতুন বিনিয়োগ করবেন, তাদের ক্ষেত্রে মুনাফার নতুন হার প্রযোজ্য হবে। এমন খবরে নতুন যারা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে আগ্রহী তারা হতাশ হয়েছেন।

সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার কমানোর বিষয়টি অবশ্য নতুন নয়। এর আগেও সঞ্চয়পত্রে মুনাফা কমানো হয়েছিল, এবারও হলো। কিন্তু এখন মুনাফার পরিমাণ কমানোর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তারা, যারা আমাদের দেশে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারী, তাদের অধিকাংশ নিরুপায় হয়ে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে থাকেন। মূলত তারাই সঞ্চয়পত্রে বেশি বিনিয়োগ করেন, যারা মধ্যবিত্তের সীমিত সঞ্চয় আর অবসরভোগীরা চাকরি শেষে পাওয়া এককালীন টাকা নির্ভরযোগ্য জায়গা হিসেবে বেছে নেন। তারা মাসের শেষে পারিবারিক ব্যয়ের সিংহভাগই মেটান সঞ্চয়পত্র থেকে পাওয়া মুনাফায়। সঞ্চয়পত্রে রাখা অর্থের ওপর একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর মুনাফা দেয় সরকার। সবচেয়ে নিরাপদ বিষয় হলো- মেয়াদ পূর্তির পর বিনিয়োগ করা পুরো অর্থও ফেরত দেওয়া হয় গ্রাহককে। এটাই মধ্যবিত্তের সীমিত সঞ্চয় আর অবসরভোগীর জন্য সবচেয়ে সুবিধার বিষয়। কারণ একদিকে জমানো অর্থের বা সারা জীবনের সঞ্চিত অর্থের নিরাপত্তা আবার জীবন চালানোর জন্য সেই অর্থের মুনাফা সমান্তরালের এই প্রত্যাশা পূরণ কেবল সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগেই সম্ভব; আর তা নিশ্চিতে জীবন ব্যবস্থায় হচ্ছেও। এ ক্ষেত্রে সরকার প্রশংসা পেতেই পারে। কারণ অসহায় নারী, প্রবীণ, অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী বা একেবারেই সাধারণ মানুষ যারা কোনো মতে কিছু টাকা জমিয়েছেন; তারাই আসলে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগকারী। ফলে এদের সিংহভাগই এই সঞ্চয়পত্রের মুনাফার টাকায় পরিবার চালিয়ে থাকেন। মেটান চিকিৎসাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ব্যয়ও। এ ছাড়া তাদের সামনে অনেক সময় অন্য কোনো বিকল্পও থাকে না। এটাই একমাত্র বিকল্প হিসেবে সামনে থাকে। কিন্তু সেই বিকল্পে মুনাফা কমিয়ে দেওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তারা, যারা স্বপ্ন দেখেন কিছু টাকা রেখে মুনাফা নেওয়ার।

সঞ্চয়পত্রে টাকা রেখে মধ্যবিত্তের সীমিত সঞ্চয় আর অবসরভোগীরা সুবিধা পাচ্ছেন, এটা সত্য। তবে বিপরীতে সঞ্চয়পত্র নিয়ে কিছু অভিযোগও রয়েছে। এখন অনেক বিত্তশালী নামে-বেনামে কাছের দূরের আত্মীয়স্বজনদের নামে কোটি কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র কিনছেন। অধিক সম্পদ থাকার পরও লাভবান হচ্ছেন তারা। সম্পদ নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য বিত্তশালীদের সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের হার দিনকে দিন কেবল বাড়ছেই তা নয়, বরং বিরূপ প্রভাব ফেলছে সঞ্চয়পত্রের বাজারে। জটিলতা এবং সংকট সৃষ্টির এটাই মূল কারণ। আর সরকার সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার কমিয়ে দেওয়ার এটা একটা বড় কারণ। এসব বিত্তশালী যদি এটা না করে, বরং অন্য খাতে বিনিয়োগ করে আখেরে লাভ হবে দেশের; সৃষ্টি হবে অনেকের কর্মসংস্থানের। তাহলে সরকারকেও সঞ্চয়পত্রে মুনাফা কমিয়ে দেওয়ার দিকে মনোযোগ দিতে হতো না। এ ক্ষেত্রে বিত্তশালীরা যাতে সঞ্চয়পত্র কিনতে না পারে, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে সরকারকে। এজন্যই এটা বন্ধ করা প্রয়োজন। আর সরকার যথাযথ উদ্যোগ নিলে তা সম্ভবও। এ ক্ষেত্রে বিত্তশালীদের কাছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি না করে প্রকৃত উপকারভোগী মানুষের কাছেই সঞ্চয়পত্র বিক্রির কার্যকর উদ্যোগই হতে পারে সঠিক এবং সময়োপযোগী সমাধান। তবে সরকার এখন থেকে সঞ্চয়পত্র কেনার ক্ষেত্রে টিন সার্টিফিকেট বাধ্যতামূলক করেছে। এই উদ্যোগ ছদ্মনামে সঞ্চয়পত্র কেনা অনেকাংশে বন্ধ করা সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে লাভবান হবেন সত্যিকারের প্রয়োজন যাদের তারা।

অর্থনীতিবিদের অভিমত, সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমানোর ফলে সরকারের ওপর অর্থনৈতিক চাপ অনেকটা কমবে। এখন প্রশ্ন হলো- শুধু সঞ্চয়পত্রের সুদের হারই কি সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। অথচ অন্য অনেক বিষয়ে সরকারের ওপর চাপ রয়েছে। বিশেষ করে দেশে খেলাপি ঋণ আর মানি লন্ডারিংয়ের মতো বিষয় সরকারকে চাপে রেখেছে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার চেয়ে অনেক বেশি। সারা বিশ্বে যেখানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমছে, সেখানে বাংলাদেশে এর চিত্র একেবারেই বিপরীত। এখন সঞ্চয়পত্রে মুনাফা কমিয়ে চাপ কমানোর উদ্যোগ কতটা সফল হবে, সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। কেননা, সঞ্চয়পত্রে মধ্যবিত্তের সীমিত সঞ্চয় আর অবসরভোগীরা বেশি টাকা রাখেন। তাই সরকারের অর্থনৈতিক চাপ কমিয়ে মধ্যবিত্তের সীমিত সঞ্চয় আর অবসরভোগীদের বঞ্চিত করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। বরং যেসব বিত্তশালী নামে-বেনামে কাছের দূরের আত্মীয়স্বজনদের নামে কোটি কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র কিনছেন, তা বন্ধ করার উদ্যোগ নেওয়া হবে সঠিক সিদ্ধান্ত। এসব বিত্তশালীকে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ না করে অন্য খাতে বিনিয়োগ করার বিষয়ে উৎসাহিত করতে হবে। এতে লাভ হবে দেশের; সৃষ্টি হবে অনেকের কর্মসংস্থানের। দেশের অর্থনীতিতেও আরো গতি আসবে।

যখন দেশে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সঞ্চয়পত্র চালু করা হয়, তখন এর উদ্দেশ্যই ছিল স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষের বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা। যাতে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে লাভবান হতে পারেন তারা। সঞ্চয় প্রকল্পের মাধ্যমে শুধু বিনিয়োগকারীরা এককভাবে লাভবান হন না, সরকারও লাভবান হয়। এখন সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমিয়ে মধ্যবিত্তের সীমিত সঞ্চয় আর অবসরভোগীদের আরো বিপদের ফেলা কোনোভাবেই কাম্য নয়। মধ্যবিত্তের সীমিত সঞ্চয় আর অবসরভোগীদের সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ এই বৃত্তের মানুষের কেবল আয়ের উৎস নয়, বরং এটা মানবজীবনে সামাজিক নিরাপত্তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িতও করেছে বৈকি। বিশেষ করে আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে তাদের নিরাপত্তার প্রশ্নও এর সঙ্গে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। তাই এখন সাধারণ মানুষের কথা ভেবে সঞ্চয়পত্রে মুনাফা কমিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হোক। কেননা, এতে লাভবান হবে সাধারণ মানুষ। যারা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেন, কিছুটা ভালো থাকার আশায়। যদি এই প্রস্তাবটা প্রত্যাহার না করা হয়, তবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ওইসব সাধারণ মানুষ, যারা মাস শেষে চেয়ে থাকেন মুনাফার দিকে। তাই সঞ্চয়পত্রে মুনাফা কমানো কোনোভাবেই সমীচীন হবে না।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close