মো. রাশেদ আহমেদ

  ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১

দৃষ্টিপাত

ভূ-রাজনীতিতে আফগান ও তালেবান শাসন

বিশ্ব রাজনীতিকে যদি রসায়ন বিজ্ঞানের সালফারের যোজনীর সঙ্গে তুলনা করা হয় তাহলে মোটেই অতিরঞ্জিত বলা হবে না। অর্থাৎ সালফারের যোজনী যেমন ঘন ঘন পরিবর্তনশীল, ঠিক তেমনি বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তন লক্ষণীয়। এই তো মাত্র কয়েক দিন আগেও মার্কিন সেনারা তালেবান-বধে কাবুলের আনাচে-কানাচে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। অথচ ৩১ আগস্ট রাতে আমেরিকার সর্বশেষ সেনা সদস্য ক্রিস ডোনাহুই কাবুল বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। এরই মধ্য দিয়ে দীর্ঘ দুই দশক আফগান যুদ্ধে পরিসমাপ্ত ঘটাল বিশ্বের সুপার পাওয়ার হিসেবে পরিচিতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

সন্দেহ নেই, বর্তমান বিশ্ব রাজনীতিতে আলোচনার খোরাক জোগাচ্ছে তালেবান ইস্যু। সবার সামনে একটিই প্রশ্ন; কেমন হবে তালেবান শাসন। কার্যত, ২০০১ সালে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় বিধ্বংস্ত হয় টুইন টাওয়ার, ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর পেন্টাগনসহ বেশ কিছু স্থাপনা। ওয়াশিংটন এই কাপুরুষচিত হামলার জন্য দায়ী করে আল-কায়েদাকে। শুরু হয় সন্ত্রাসবিরোধী নতুন অভিযান। যে ঢেউ আছড়ে পড়ে আফগান থেকে মধ্যপ্রাচ্য। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জুনিয়র বুশ কাবুল থেকে অভিযান পরিচালনার নির্দেশনা দেন। শুরু হয় ভয়াবহ নারকীয় যুদ্ধ। বুশ হয়তো এই যুদ্ধে মার্কিনিদের কবর রচিত হবে এমন ভবিষ্যৎ বার্তা পেতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। কিংবা সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেনি।

স্মরণযোগ্য, তখন ক্ষমতায় (১৯৯৬-২০০১) তালেবান গোষ্ঠী। মূলত তালেবানদের সঙ্গে আল-কায়েদার সখ্যতা শুরু সোভিয়েত যুদ্ধের সময় থেকে। প্রসঙ্গত ওই হামলার সঙ্গে আল-কায়েদ যে জড়িত তার অথেনটিক দলিল চায় তালেবান। কিন্তু তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে ওয়াশিংটন। টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে আল-কায়েদা সম্পৃক্ত আছে কি না নিয়ে বির্তক হয়তো চলতে থাকবে অনন্তকাল। কিন্তু সন্ত্রাসবাদ নির্মূল নামে লক্ষাধিক মানুষের প্রাণহানি। কিংবা বাস্তুচ্যুত সরকার পরিবর্তন করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থতার দায়ভার কখনো এড়িয়ে যেতে পারে না মার্কিন প্রশাসন। কার্যত আল-কায়েদাকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগে তালেবানকে জঙ্গি হিসেবে অভিহিত করে মূল উৎপাটনে বদ্ধপরিকর ছিল যুক্তরাষ্ট্র। অথচ দীর্ঘ দুই দশক পরে সেই তালবানদের সঙ্গে শর্তহীন চুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্র। এসে যায় ৩১ আগস্ট। রাতে দেশ ছাড়তে বাধ্য হলো মার্কিন বহর।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা ওই ঘটনাকে ১৯৭৫ সালে এপ্রিলে ভিয়েতনাম যুদ্ধে অপারেশন ফ্রিকোয়েন্ট উইন্ডের অংশ হিসেবে সর্বশেষ মার্কিন হেলিকপ্টারগুলো সায়গান থেকে তাদের দূতাবাসের কর্মীদের অতিদ্রুত সরিয়ে নেওয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন। দীর্ঘ ৪৬ বছর পর আবারও কাবুল থেকে কর্মীদের সরিয়ে নিতে দূতাবাসের ছাদে হেলিকপ্টার অবতরণ করে যুক্তরাষ্ট্র। এ যেন অতীত স্মৃতির পুনরাবৃত্তি। শুধু তাই নয়, তাদের শেষ বিদায় কালেও আইএসের ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়। যেখানে নিমিষেই প্রাণ হারায় ১২ জন মার্কিন সেনা। নিউইয়র্ক টাইমস এ যুদ্ধকে বিবর্ণ সমাপ্তি হিসেবে উল্লেখ করেছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম এক ধাপ এগিয়ে বলেছেন, আফগানিস্তানে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া ওয়াশিংটনের জন্য মস্ত বড় ভুল ছিল। এ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যয় হয়েছে ২ দশমিক ২৪ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থ। যুদ্ধের খরচের ওপর প্রায় ৪৫ লাখ কোটি টাকা সুদ দিতে হয়েছে।

ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের cost of war তথ্যানুযায়ী, এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ২ লাখ ৪১ হাজার লোক মারা গেছে। ৩ হাজার ৯৩৬ জন মার্কিন নাগরিক এবং ৩ হাজার ৫৮৬ জন মার্কিন সেনাসদস্য প্রাণ হারিয়েছে। এ যুদ্ধে আফগান বাহিনী ৭১ হাজার ৩১৪ সেনা নিহত হয়েছে। এ ছাড়া আহত সেনার সংখ্যা অনেক। জো বাইডেন তো বলেই দিয়েছেন কাবুলে আরো ১০ বছর মার্কিন সেনা থাকলেও অবস্থার কোনো উন্নতি আশা করা যায় না। অর্থাৎ পরোক্ষভাবে তিনি এ যুদ্ধের বাস্তবতা পরিসমাপ্তি এবং পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সেখানেও চরম ব্যর্থ হয়েছে ওয়াশিংটন। ব্রাউন ইউনিভার্সিটির cost of war নামক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘ দুই দশক সন্ত্রাসবাদ যুদ্ধে মারা গেছে ৯ লাখের অধিক মানুষ, প্রায় ৮০টি দেশে বোমা হামলা, গোলা বর্ষণ কিংবা সরাসরি যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে ওয়াশিংটন। এতে ব্যয় হয়েছে আট ট্রিলিয়ন ডলার। এই গবেষণার সহকারী পরিচালক ক্যাথরিকক লুস বলেন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আমেরিকার যুদ্ধ ছিল দীর্ঘ, জটিল এবং সর্বোপরি ব্যর্থ। যেখানে উত্থান হয়েছে আইএসের মতো নতুন ভয়ংকর জঙ্গিগোষ্ঠীর। আপাতত দৃষ্টিতে আফগানিস্তানে দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের ইতি টানা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় স্বস্তির খবর। এতে যুদ্ধের পেছনে বিলিয়ন ডলারের খরচ সাশ্রয় হবে। তবে তালেবান আবার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন কোনো আঁতাত আছে কি না তা এই মুহূর্তে পরিষ্কার নয়। বলা যায়, নিকট ভবিষ্যতের সময় বলে দিবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তালেবানের সম্পর্ক কেমন হবে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্থনি ব্লাংকেট উল্লেখ্য করেন মার্কিন দূতাবাস কাতারে হস্তান্তর করলেও তালেবানদের সঙ্গে কূটনীতিক তৎপরতা অব্যাহত থাকবে। মোদ্দা কথা, দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র প্রভাব বিস্তারে প্রয়াস চালালে কাবুলের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে বাধ্য ওয়াশিংটন।

বর্তমান তালেবান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। তাদের এ দীর্ঘ পথচলা মোটেও মসৃণ ছিল না। পশ্চিমাদের দেওয়া জঙ্গিবাদের ট্যাগ থেকে সাহসী যোদ্ধা। এ যেন হলিউডের মুভির গল্পকেও হার মানায়। সত্যি আফগানরা কখনোই বিদেশি কর্তৃত্ব মেনে নেয়নি। যার সর্বশেষ জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে থাকবে রাতের আঁধারে বাগরাম বিমান ঘাঁটি ত্যাগ কিংবা মার্কিনিদের লেজ গুটিয়ে পলায়ন। সঙ্গত যে, তালেবানরা অনেকটা ইরানি মডেল অনুযায়ী সরকার গঠন করেছে। এরই মধ্যে তালেবান স্পষ্ট করেছে, তাদের শাসনকাল গণতন্ত্রের কোনো লেজ থাকবে না। অর্থাৎ ইসলামি শরিয়া আইন অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করা হবে। যেখানে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতার দায়িত্ব পেয়েছেন হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা। সেইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন মোল্লা মোহাম্মদ হাসান। সোজা কথা, তাদের সরকারের পরীক্ষিতরা সুযোগ পেয়েছে। এখন পর্যন্ত তালেবানের বাইরে কিংবা নারীদের কোনো রকম সুযোগ দেওয়া হয়নি।

বলতে দ্বিধা নেই, বর্তামান তালেবান গোষ্ঠীকে অগণিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে কাবুলকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে। প্রথমত, আফগানবাসীকে বিভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে এবং সেইসঙ্গে নারীদের অগ্রাধিকার দিয়ে সরকার পরিচালনার করার বিকল্প নেই। এতে নারীদের ভয়ভীতি কিংবা কর্মক্ষেত্রে কাজের স্বাধীনতা অনেকাংশ নিশ্চিত হবে। যদিও শুরু থেকে তালেবানরা নারীদের ইসলামি দৃষ্টিতে পূর্ণ অধিকারের কথা ব্যক্ত করেছেন। দ্বিতীয়, সন্ত্রাসী কোনো গোষ্ঠীকে যেমন আল-কায়েদা, আইএসকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। সেইসঙ্গে সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে পরস্পরের সঙ্গে এক হয়ে কাজ করতে হবে তালেবান সরকারকে। আফগানিস্তানে যেন নতুন করে সন্ত্রাসবাদের নেটওয়ার্কে রূপান্তর না হয় সেই দিকে মনোনিবেশ করা অতি জরুরি। তৃতীয়ত, তালেবান কাবুল দখল করার পর অসংখ্য আফগান উৎকণ্ঠায় বিভিন্ন দেশে আশ্রয় গ্রহণ করছে। প্রায় ২২ লাখ আফগান প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। সেইসঙ্গে ৩৫ লাখ আফগান নিজ দেশের মধ্যে বাস্তুচ্যুত। তালেবান ভীতি দূর করে নাগরিকদের দেশে ফেরার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। চতুর্থ, একটি দেশের প্রাণশক্তি হচ্ছে অর্থনীতি। বর্তমান কাবুলে অর্থনীতির পরিমাণ ২২ বিলিয়ন ডলার। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর আফগানিস্তানে অর্থনীতি উন্নয়নে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা মূল টার্গেট। এ ছাড়া তালেবান সরকারকে আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃতি আদায় করে নেওয়াও অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

এশিয়া অঞ্চলে ভূ-রাজনীতে কাবুল বরাবরই অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। আর সে কারণেই বারবার বিদেশিদের নগ্ন হস্তক্ষেপের বলি হয়েছে আফগানবাসী। সঙ্গত যে, তালেবান ক্ষমতায় আসার পর এই অঞ্চলের রাজনীতির পরিবর্তন লক্ষণীয়। তালেবানের পরীক্ষিত বন্ধু পাকিস্তান। এরই মধ্যে পাকিস্তান পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশি স্পষ্ট করেছেন ইসলামাবাদ তালেবানের সঙ্গে সহাবস্থান ভিত্তিতে কাজ করতে চায়। তবে ভূ-রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়তে পারে ভারত। তালেবান ক্ষমতায় আসীন নয়াদিল্লী যে বেজায় অখুশি তা অনুমেয়। বলে রাখা ভালো, কাবুলে নয়াদিল্লীর বিনিয়োগ রয়েছে ১১ হাজার কোটি ডলার। এমন বড় বিনিয়োগ জলে ভেসে যাওয়ার উপক্রম। কার্যত, এখন পর্যন্ত তালেবানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কেমন হবে তা নিশ্চিত করেননি নয়াদিল্লি। তবে তালেবান ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করায় চীনের কাছে মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মতো। এরই মধ্যে চীনের সঙ্গে উচ্চপর্যায়ে বৈঠক করেছে তালেবান। তারা স্পষ্ট করেছে, চীন হবে তালেবানের প্রধান অংশীদার। প্রাকৃতিক সম্পদ তথা আফগানিস্তানে বিলিয়ন ডলারে বিনিয়োগে আগ্রহী বেইজিং। এমনকি চীনের বহুল প্রতীক্ষিত প্রকল্প ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড কর্মসূচিতে যুক্ত হওয়ার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেছে তালেবান। রাশিয়া তালেবান ক্ষমতা গ্রহণকে বাস্তবতা এবং এক যুগে কাজ করার আগ্রহ দেখিয়েছে। তুরস্ক, কাতার তালেবানকে সার্বিক সহযোগিতার প্রস্তুত। পশ্চিমা বিশ্ব তালেবান ব্যাপার তাদের নীতি স্পষ্ট করেনি। সহজ কথা, এশিয়া অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার, নিজেদের পাল্লা ভারী করার লক্ষ্যে কিংবা সন্ত্রাসবাদ রোধে তালেবানের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলতে বাধ্য বিশ্বের পরাশক্তি দেশগুলো। যেখানে এগিয়ে বেইজিং।

আফগানিস্তানে তালেবানের শাসন কাল কেমন হবে তা এই মুহূর্তে বলা দুরূহ ও কঠিন। তবে, তারা অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে বাস্তবতার নিরিখে উদার মানসিকতা পরিচয় দিবে বলে আশা করা যায়। আজকের তালেবান আর ২০ বছর আগের তালেবানের চিন্তাধারা এক করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। কার্যত, তারা ইসলামের বাইরে কোনো আইন যে বাস্তবায়ন করবে না সে কথা হলফ করে বলা যায়। সঙ্গত যে, তালেবানরা যত উদার নীতি গ্রহণ করবে ততই তাদের জন্য মঙ্গলজনক।

লেখক : শিক্ষার্থী, ব্যবস্থাপনা বিভাগ

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close