সাধন সরকার

  ১৮ জুলাই, ২০১৮

মতামত

ইটভাটার দূষণ রোধ

নগরায়ণ ও শিল্পায়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নির্মাণকাজ। আর নির্মাণকাজের অন্যতম অনুষঙ্গ ইট। উন্নয়নের সঙ্গে দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ইটের চাহিদা। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশে ইট তৈরিতে প্রচলিত পদ্ধতি অনুসরণ করার ফলে পরিবেশ, কৃষিজমি ও মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। পবার (পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন) এক তথ্য মতে, বাংলাদেশে ইটভাটার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। এসব ইট ভাটায় প্রতি বছর প্রায় দুই হাজার কোটি ইট ও ব্রিকেট উৎপাদিত হয়। এ খাতে ২০ লাখেরও বেশি শ্রমিকের কর্মসংস্থান জড়িত, যাদের বড় একটা অংশই নারী। বহু বছর ধরে এ দেশের ইটভাটাগুলোয় সনাতন পদ্ধতিতে ইট প্রস্তুত হয়ে আসছে। কিন্তু এখন সময় এসেছে উন্নততর, কম দূষণকারী ও আধুনিক প্রযুক্তিতে ইট প্রস্তুত করার। বর্তমানে ইট প্রস্তুত করতে দেশের বিভিন্ন স্থানের কৃষিজমি ও প্লাবন ভূমির মাটি কেটে ফেলা হচ্ছে। আবার ইটভাটাগুলোতে অবৈধ ড্রামচিমনি ও কম উচ্চতার চিমনি ব্যবহার করা হচ্ছে। ‘ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩’-তে বলা হয়েছে, অনুমোদন ছাড়া জলাভূমিসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার এলাকায় ইটভাটা স্থাপন করলে এক বছরের কারাদ- ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা হবে। এ ছাড়া ইটভাটায় কয়লার পরিবর্তে কাঠ ব্যবহার করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষের তিন বছরের কারাদ- এবং তিন লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দ-ে দ-িত হতে পারে। এমন আইন থাকলেও বাস্তবতার কোনো প্রয়োগ হচ্ছে বলে মনে হয় না। মূলত ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় সংশ্লিষ্ট এলাকার পরিবেশ মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়ে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় কৃষিজমির ওপরের জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ মাটি ইটভাটায় ব্যবহৃত হওয়ায় জমির উর্বরতা বিনষ্টের ফলে ফসল উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

ইটভাটা থেকে দূষিত গ্যাস ও তাপ আশপাশের জলাভূমি, জীবজন্তু, গাছপালা ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে থাকে। দেশের শত শত ইটভাটায় কয়লার পরিবর্তে অবৈধভাবে পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। ফলে উজাড় হচ্ছে বন-জঙ্গল-বৃক্ষ। এতে বিনষ্ট হচ্ছে জীববৈচিত্র্য, চিরচেনা প্রকৃতি ও পরিবেশ। পরিবেশদূষণ রোধে সরকার ২০১২ সালে ইটভাটায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের নির্দেশ দিলেও তা কাজে আসেনি। ‘সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা’ অনুযায়ী সরকার ২০২০ সালের মধ্যে ইট তৈরিতে মাটির ব্যবহার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার পরিকল্পনা নির্ধারণ করেছে। অথচ নিয়ম না মেনে পরিবেশ ছাড়পত্র ও লাইসেন্স না নিয়ে যেখানে-সেখানে ইটভাটা গড়ে তোলা হয়েছে এবং হচ্ছে। বলতে গেলে, দেশের অর্ধেক ইটভাটাই অবৈধ! তাই কৃষিজমি নষ্ট, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ এমন প্রক্রিয়ায় ইটভাটাগুলোয় ইট তৈরি বন্ধ করতে হবে। আইনের তোয়াক্কা না করে অতিরিক্ত মাত্রায় কার্বন ও সালফার নিঃসরণ, বসতবাড়ি, কৃষিজমি, টিলাসংলগ্ন সমতলে ইটভাটা স্থাপন ও বন উজাড়কারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি মাটির ইটের বিকল্প হিসেবে যেসব উপকরণ ও পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে, তার ব্যবহার বাড়াতে হবে। ইটভাটার জন্য মাটি তুলতে ‘পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষার’ (ইআইএ) ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে।

তথ্য মতে, ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের জন্য আশপাশের ইটভাটা ৫৮ শতাংশ দায়ী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (উব্লিউএইচও) গবেষণা বলছে, বায়ুদূষণের কারণে শুধু ঢাকা শহরে প্রতি বছর সাড়ে তিন হাজার মানুষ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। তাই রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে পরিবেশবান্ধব ইট বা নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের দিকে নজর দিতে হবে। বাংলাদেশে এখন দুই পদ্ধতিতে ইট উৎপাদন করা হয়ে থাকে : ক. পুড়িয়ে, খ. না পুড়িয়ে। যদিও না পুড়িয়ে ইট উৎপাদন ও ব্যবহার একেবারেই কম। না পোড়ানো ইটের ক্ষেত্রে বালু, সিমেন্ট, ফ্লাইঅ্যাশ, জিপসাম ইত্যাদি মিশ্রিত করে ফোমিং এজেন্টের সাহায্যে জমাট বাধিয়ে ইট প্রস্তুত করা হয়। না পোড়ানো ইট তৈরিতে মাটি ও কয়লা, কাঠ বা অন্য কোনো জ্বালানির ব্যবহার নেই। বাংলাদেশে পোড়ানো ইটের ক্ষেত্রে ড্রামচিমনির ভাটা, ভার্টিক্যালভাটা, টানেলভাটা, জিগজ্যাগ প্রভৃতি ধরনের ভাটা দেখা যায়। এদের মধ্যে ড্রামচিমনি ও জিগজ্যাগভাটায় সবচেয়ে বেশি পরিবেশ দূষণ হয়ে থাকে। টানেলভাটায় আধুনিক মেশিনের সাহায্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইট প্রস্তুতিতে কয়লার ব্যবহার কম হওয়ায় পরিবেশ দূষণ কম হয়। আবার জিগজ্যাগভাটার ক্ষেত্রে ইট বসানো ও পোড়ানোর কৌশল পরিবর্তন করে পরিবেশ দূষণ হ্রাস করা সম্ভব। এ ছাড়া মাটির ইট তৈরিতে ভূমির উপরিভাগের মাটি ব্যবহার না করে বিকল্প হিসেবে নদীর তলদেশের মাটি ব্যবহার করতে পারলে নদ-নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনা যেমন সম্ভব হবে, তেমনি মাটির চাহিদাও মিটবে।

এক কথায় আধুনিক ও টেকসই ইট প্রস্তুত তৈরিতে জোর দিতে পারলে জ্বালানির সীমিত ব্যবহার, পরিবেশদূষণ রোধ, কৃষিজমি, ভূ-উপরিস্থিত মাটিও পানির ব্যবহার কমানো সম্ভব হবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ফাঁপা ও না পোড়ানো ইটের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। গণচীনে থান ইট নিষিদ্ধ করে ফাঁপা ও না পোড়ানো ইটের নানা প্রযুক্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব অনেক নির্মাণসামগ্রী (ফাঁপা ও না পোড়ানো ইটসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রী) উৎপাদন হলেও না জানা ও উৎসাহের অভাবের কারণে এর ব্যবহার করা হচ্ছে না। পরিবেশের দূষণরোধ, শ্রমিকস্বার্থরক্ষা, কৃষিজমিরক্ষাও সর্বোপরি জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় আধুনিক প্রযুক্তিতে পরিবেশবান্ধব ইট প্রস্তুতের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। তাই বিদ্যমান ইটভাটাগুলোর আধুনিকায়ন করতে হবে। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব ফাঁপা ও না পোড়ানো ইটের প্রস্তুত ও এর ব্যবহার বাড়াতে প্রচার ও প্রসারের উদ্যোগ নিতে হবে। ইট তৈরিতে মাটির ব্যবহার কমিয়ে বিকল্প ইটে তৈরি বাড়ি ও স্থাপনা হোক টেকসই, মজবুত, সাশ্রয়ী, পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ। ইলেকট্রনিক মিডিয়া, স্থপতি, প্রকৌশলীরও সর্বস্তরের সচেতন মানুষের যথাযথ ভূমিকা, পরিবেশবান্ধব নির্মাণসামগ্রী তৈরির বিভিন্ন সংস্থা ও সরকারের যথাযথ পরিকল্পনা, উদ্যোগ, প্রচার ও প্রসারই পারে দূষণমুক্ত ও পরিবেশবান্ধব ইট প্রস্তুত ও এর ব্যবহারের মাধ্যমে সমৃদ্ধির সোনার বাংলা গড়তে।

লেখক : কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist