ইফতেখার আহমেদ টিপু

  ২৪ জুন, ২০১৮

মতামত

রোহিঙ্গা ও বিশ্ব সমাজ

বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ক্ষুদ্র আয়তনের এই দেশের ১৭ কোটি মানুষ নিজেদের বাসস্থান ও খাদ্য জোগাতে প্রতিনিয়তই হিমশিম খাচ্ছে। অথচ, বাংলাদেশকে এখন বইতে হচ্ছে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর বোঝা। আশঙ্কা করা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের একাংশ নানা কৌশলে দেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে মিশে যাওয়ায় শরণার্থীর সংখ্যা আরো বেশি হতে পারে। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। উচ্ছৃঙ্খল ও অপরাধপ্রবণ এ জনগোষ্ঠীর বোঝা কবে বাংলাদেশের ঘাড় থেকে নামবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। মিয়ানমার তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নেওয়ার আশ্বাস দিলেও তা শুধু কথামালার মধ্যে সীমাবদ্ধ।

রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ বাংলাদেশের পর্যটনের প্রধান কেন্দ্র কক্সবাজারের পরিবেশকে ইতোমধ্যে নিষ্প্রভ করে দিয়েছে। পাহাড়, টিলা, বনাঞ্চল নিধনের ঘটনা পরিবেশগত বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশে মাদক ও অবৈধ অস্ত্র অনুপ্রবেশের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে রোহিঙ্গারা। এ জনগোষ্ঠীর সদস্যরা গত ১০ মাসে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১৬টি হত্যাকান্ড ঘটিয়েছেন। অন্তত দেড় শতাধিক বড় ধরনের অপরাধ সংঘটিত করেছে তারা; যার মধ্যে খুন ছাড়াও চোরাচালান, মাদক ব্যবসা, ডাকাতির মতো ঘটনাও রয়েছে। এসব ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায় আসামি করা হয়েছে প্রায় ৪০০ রোহিঙ্গাকে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতে, অপরাধের এ মাত্রা আতঙ্কিত হওয়ার মতো। অপরাধকর্মের কারণে এ পর্যন্ত সহস্রাধিক রোহিঙ্গাকে সাজা দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করে জেলে দিয়েছে আরো শতাধিক রোহিঙ্গা নারী-পুরুষকে। মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের শিকার রোহিঙ্গারা মনোবৈকল্যের কারণে যথেচ্ছভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন মনোবিজ্ঞানীরা। জাতিসংঘ এবং পশ্চিমা বিশ্বের আহ্বানে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক কারণে আশ্রয় দিলেও তাদের ব্যাপারে দায়দায়িত্ব পালনে বাদবাকি বিশ্ব কার্যত ততটা আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাংলাদেশকে ভয়াবহ মানবিক সমস্যায় পড়তে হবে। রোহিঙ্গাদের আশ্রুয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের ঢালাও প্রশংসা করে দায় এড়িয়ে চলার যে মনোভাব তারা দেখাচ্ছেন তা দুর্ভাগ্যজনক। এ প্রবণতার অবসান কাম্য।

২০১৭ সালে সবচেয়ে বীভৎস জুলুম ও হত্যাকান্ড সংঘটিত হয় মিয়ানমারে। বর্মী সামরিক বাহিনী এবং রাখাইন বৌদ্ধের সম্মিলিত হামলায় আহত ও নিহত হওয়া ছাড়াও লাখ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান তাদের অভিন্ন প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। শতাব্দীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর নির্যাতনের কারণে বাংলাদেশের তদানীন্তন সরকার মানবিক বিবেচনায় এসব বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দান করে। সেই থেকে কক্সবাজারে বান্দরবানসহ পার্বত্য জেলাগুলোয় এবং চট্টগ্রামে তারা আশ্রয় গ্রহণ করে। আজও এসব ছিন্নমূল শরণার্থী তাদের পূর্ব পুরুষের ভিটামাটিতে ফিরে যেতে পারেনি। বর্মী সেনাবাহিনী এবং রাখাইন বৌদ্ধের হামলা আজও অব্যাহত আছে।

সভ্য দুনিয়ায় কোনো দেশ তাদের নাগরিকদের ওপর কথায় কথায় চড়াও হবে তা মেনে নেওয়া যায় না। রোহিঙ্গাদের ওপর সাম্প্রতিক নিপীড়নমূলক অভিযানের পেছনে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর জঙ্গিদের হামলাকে অজুহাত হিসেবে খাড়া করা হচ্ছে। তথ্য প্রবাহের স্বাধীনতা না থাকায় এ অভিযোগ কতটা সত্যি তা প্রমাণ করা কঠিন। অভিযোগটি সত্যি হলেও সে অজুহাতে সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর চড়াও হওয়া কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের কুম্ভকর্ণের ঘুম থেকে জেগে উঠবে এমনটিই প্রত্যাশিত। এ কথা বলতেই হয়, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধ গোষ্ঠী যেকোনো ছুঁতোয় দেশটির রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর বর্বর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে দ্বিধা করে না। জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও মানবাধিকার সংস্থা রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর এমন নৃশংস ও অমানবিক হত্যা এবং নির্যাতনের প্রতিবাদ করলেও মিয়ানমার সরকার তা থোড়াই কেয়ার করে চলছে। দেশটির সরকারের আচরণে এটাই প্রতীয়মান হয়, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশের নাগরিক হিসেবে গণ্য করা দূরে থাক মানুষ বলেই মনে করে না সরকার। তার সর্বশেষ জনসংখ্যা জরিপে রোহিঙ্গাদের মূল নাগরিকের বাইরে ‘আদারস’ বা ‘অন্যান্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়, তারা উদ্বাস্তু ও ভাসমান। অবশ্য দেশটির সরকার সবসময়ই মনে করে আসছে, রোহিঙ্গারা নাকি বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ করেছে। তারা বাঙালি। এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মিয়ানমার সরকার ও উগ্রবৌদ্ধ গোষ্ঠী যুগের পর যুগ রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের উৎখাতে অভিযান চালিয়ে এসেছে। এতে নিজেদের ভিটেমাটি ও সহায়-সম্বল ফেলে জীবন বাঁচাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছে।

মানবিক দিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকার তাদের কক্সবাজারসহ অন্যান্য স্থানে আশ্রয় দিয়েছে। তাদের ভরণপোষণেরও দায়িত্ব নিয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে বহুবার কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া হলেও মিয়ানমারের আচরণে অনেকটা উদাসীনতা ও অনীহা ফুটে উঠেছে। অথচ, ঐতিহাসিকভাবেই রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের আদি বাসিন্দা। তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। দুঃখের বিষয়, মিয়ানমারের সামরিক জান্তা রোহিঙ্গা মুসলমানদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য অস্বীকার করে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে। নারী ও শিশুসহ হাজার হাজার রোহিঙ্গা হত্যা করে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় উগ্রবাদী বৌদ্ধগোষ্ঠী। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সরকার ও উগ্র বৌদ্ধ গোষ্ঠী স্টিম রোলার চালাতে থাকে এবং এখনো চালাচ্ছে। এই নিপীড়ন, বিতাড়ন ও হত্যাযজ্ঞ বিশ্ববিবেককে নাড়া দিলেও তাতে কর্ণপাত করেনি মিয়ানমার সরকার।

লেখক : চেয়ারম্যান, ইফাদ গ্রুপ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist