জি. কে. সাদিক

  ৩০ মে, ২০১৮

বিশ্লেষণ

রক্তাক্ত ফিলিস্তিন ও নির্বাক বিশ্ব

স্বাধীন মাতৃভূমির স্বপ্ন নিয়ে ফিলিস্তিনিরা অপেক্ষায় ছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও মার্কিন প্রশাসনের নিরপেক্ষ সিদ্ধান্তের জন্য। কিন্তু বাস্তব সত্যকে ফিলিস্তিনিরা বুঝেছে গত ৬ ডিসেম্বর (২০১৭)। মুসলিম বিশ্বও এ আশার-ছলনা বুঝেছে। ট্রাম্প ৬ ডিসেম্বরের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে ১৪ মে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের মাধ্যমে ইসরায়েলের ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে শান্তির চমকপ্রদ ও সেরা উপহার দিয়েছেন। আনন্দিত ও উৎফুল্ল চিত্তে নেচেগেয়ে শান্তি উদ্যাপন করেছে ইহুদিবাদীরা। অন্যদিকে মাত্র ৭৫ কিলোমিটার ব্যবধানে ইটপাথরধারী ৬৫ জন ফিলিস্তিনি প্রাণ দিয়েছেন। আহত ও পঙ্গু হয়েছে প্রায় তিন হাজার। নিহতদের মধ্যে ২০ জন ছিলেন নারী ও শিশু। লায়লা আনোয়ার নামের আট মাসের এক মেয়ে শিশুও গ্যাসের আক্রমণে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়। কিন্তু তাতে কী? ৭০ বছর ধরেই তো এমনভাবে হত্যা-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনিরা। বিনিময়ে পেয়েছে সন্ত্রাসী অভিধা।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ফিলিস্তিনিদের এই রক্তদান কবে সার্থক হবে? সফলতার সম্ভাবনা বিচার করতে হলে আগে দেখাতে হবে অতীত ইতিহাস কী বলে। বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে ভবিষ্যৎ সফলতার সম্ভাবনা কতটুকু। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর চারবার আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ হয়েছে। কোনো যুদ্ধের ফল ফিলিস্তিনিদের অনুকূলে আসেনি। ক্রমাগত আরব ভূমি হাতছাড়া হয়েছে, এখনো হচ্ছে। ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে গোলান দখলের পর ফিরিয়ে দেওয়ার চুক্তি হলেও এখনো ইসরায়েল তা সিরিয়াকে ফিরিয়ে দেয়নি। সম্প্রতি গোলানে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ইসরায়েল প্রশাসন ওয়াশিংটনের সঙ্গে জোর তৎপরতা চাচ্ছে। যদি সফল হয় তাহলে প্রতিবাদ করার মতো শক্তি সিরিয়ার নেই। এ দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বা আন্তর্জাতিক কোনো সংস্থা কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না। কোনো মুসলিম দেশও সিরিয়ার পাশে দাঁড়াবে বা দাঁড়াতে পারবে এমন সম্ভাবনাও নেই। এটা দিবালোকের মতো সত্য। ফিলিস্তিনের পশ্চিমতীর দখলের পর সেখানে ২০ লাখ মানুষ আশ্রয় শিবিরে অবস্থান করছে। অন্যদিকে ২০১৭ সালে পশ্চিমতীরে ১৪ হাজার নতুন বসতি গড়ার জন্য ট্রাম্প জামাতা জ্যারেড কুশনার অর্থ সহযোগিতা দিয়েছে। নতুন সহায়তার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। ভূমি দখলের প্রক্রিয়াও থেমে নেই। আর এভাবে বসতি স্থাপন নতুন নয়; ১৯৪৮ সালে ৭ লাখ ফিলিস্তিনিকে বিতাড়ন ও ৫০০ বসতি গুঁড়িয়ে দিয়ে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। সে থেকে আজ অবধি ৫১ লাখ ফিলিস্তিনি বাস্তুহারা হয়েছে। হতাহতের নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। প্রত্যেক দিন নিহতের তালিকায় নতুন নাম যুক্ত হচ্ছে। ৩০ মার্চ থেকে এ পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা শতাধিক। শুধু ১৪ মে ‘নাকবা’ দিবসেই ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে প্রাণ হারিয়েছে ৬৫ জন ফিলিস্তিনি।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কেবলই নিন্দা প্রস্তাব পাস ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না। মাত্র ৩১ শতাংশ ইহুদিদের জন্য অর্ধেক ফিলিস্তিন নিয়ে ১৯৪৮ সালে যুক্তরাজ্যের সুপারিশের ভিত্তিতে ‘পার্টিশন প্ল্যান অব ফিলিস্তিন ১৮১-২’ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়। প্রতিষ্ঠাকালেই সাত লাখ মানুষ বাস্তুহারা হয়। ৫০০ ঘরবাড়ি উচ্ছেদ করে। একই বছর জাতিসঙ্ঘ কর্তৃক গৃহীত হয় বিশ্বমানবাধিকারের দলিল ‘জাতিসঙ্ঘ হিইউম্যান রাইটস কাউন্সিল’। তথাপি ফিলিস্তিনিদের কোনো মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ইউএইচসিআর ইসরায়েলের হত্যাকা-ের তদন্ত করতে চাইলে ইসরায়েল তদন্ত করতে দেবে না এবং এ কাজে কোনো ধরনের সাহায্য করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশ সদস্য হলেও ইসরায়েল ইউএইচসিআরের সদস্য নয়। সম্প্রতি ইসরায়েলের ডিফেন্স মিনিস্টর লিবারম্যান যুক্তরাষ্ট্রকে ইউএইচসিআর থেকে বের হয়ে আসতে চাপ দিচ্ছে ইসরায়েল। নিকি হ্যালিও সংগঠনটিকে ‘একহাত’ দেখিয়েছে। ৬ ডিসেম্বরের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে সাধারণ পরিষদে আইন পাস হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র জাতিসঙ্ঘে তাদের অনুদান কমিয়ে দিয়েছে এবং যে দেশগুলো বিপক্ষে গিয়ে ভোট দিয়েছে সে দেশগুলোকে আর্থিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়ার হুমকিও দিয়েছে। ইউএইচসিআর সদস্যভুক্ত ৪৭টি দেশের ভোটে অস্টেলিয়া ও আমেরিকা বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। যুক্তরাজ্যসহ ৯টি ইউরোপীয় দেশ ভোটদানে বিরত ছিল। মানবাধিকার সংস্থার তদন্তের সম্ভাবনা সহজেই অনুমেয়।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে জাতিসঙ্ঘের ব্যর্থতার ঝুড়ি বেশ বড়। জাতিসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠার পরই শুরু হয় বিশ্বব্যাপী অস্ত্র প্রতিযোগিতা। বিশেষ করে পরমাণু অস্ত্র। রাশিয়া তৈরি করে হাইড্রোজেন বোমা। ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত, পাকিস্তান একের পর এক পরমাণু শক্তিধর হয়ে ওঠে। জাতিসঙ্ঘ বিশ্বব্যাপী মরণাস্ত্রের প্রসার রোধ করতে পারেনি। আরব-ইসরায়েল যুদ্ধসহ ফিলিস্তিন নিয়ে যে সমস্যাগুলো হয়েছে, তা জাতিসঙ্ঘের জন্মের পরই। ২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে ছয় জাতির পরমাণু চুক্তি (পি৫+১) থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে প্রত্যাহার করে (৮ মে) ইরানের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করল, এখানেও জাতিসঙ্ঘ অসহায়। ১৯৫৩ সাল থেকে চলমান কাশ্মীর সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারেনি জাতিসঙ্ঘ। গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর যে গণহত্যা শুরু করেছে, সে দেশের সেনাবাহিনী জাতিসঙ্ঘ সে ব্যাপারে কোনো সফল পদক্ষেপ নিতে পারেনি। জাতিসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা সম্পূর্ণ সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে। নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য সাম্রাজ্যবাদীরা সংস্থাটিকে বৈধতা দানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবহার করেছে, এখনো করছে। যদি অন্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করি, তাহলে অবস্থা এর চেয়ে মন্দ বৈ ভালো না। ফিলিস্তিনিদের ওপর এমন হত্যাযজ্ঞের পরও বিশ্বব্যাংক ইসরায়েলের ওপর কোনো আর্থিক শাস্তি প্রয়োগ করবে না। যেমন করেনি মিয়ানমারে। কারণ এ প্রতিষ্ঠানটিও উন্নয়নশীল, স্বল্পোন্নত ও দরিদ্র দেশগুলো শোষণের হাতিয়ার। উন্নয়নের নামে ঋণ দিয়ে দরিদ্র দেশগুলোর সঙ্গে চরম প্রহসনে নাটক করছে। প্রায় সব কয়টি আন্তর্জাতিক সংগঠন সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে জিম্মি। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এখন এ চুক্তির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। হোয়াইট হাউসের পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা সব সময় ইসরায়েলের হাতে থাকে। নিজের স্বার্থে আঘাত পড়বে আর ইসরায়েল মার্কিন প্রশাসনকে ব্যবহার করবে নাÑএমন বিশ্বাস বা আসা করা যায় না। ২০১৪ সাল থেকে ইসরায়েল নতুন উদ্যোমে হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে। অন্যদিকে ইসরায়েল-ব্রিটেন অস্ত্রবাণিজ্যও রমরমা চলছে। ২০১৭ সালে গত তিন বছরের চেয়ে অস্ত্রবাণিজ্য তিন গুণ বেড়ে ২২ লাখ ১০ কোটি ডলারে উন্নীত হয়েছে। তাহলে সমাধনের আশা করা কি অবান্তর নয়? যদিও সমাধান হয় সেটা বরাবরের মতো একচেটিয়া লাভের মাধ্যমে সম্ভব।

মুসলিম দেশগুলোর ঐক্যের নামে সৃষ্টি ওআইসির (অরগানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স) এখন অস্তিত্ব হুমকির শিকার। ফিলিস্তিন ইস্যুতে ১৯ মে তুরস্কে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে সৌদি, মিসর, বাহরাইন, আরব আমিরাত উচ্চপর্যায়ের কোনো প্রতিনিধি পাঠায়নি। আর সম্মেলনে কার্যত কোনো সিদ্ধান্তও হয়নি। গতানুগতিক নিন্দা প্রস্তাবেই সম্মেলন মুলতবি। আমেরিকার অনুসারী ও মদদে পালিত গুয়েতেমালা তাদের দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তর করার কারণে আরব লীগ গুয়েতেমালার সঙ্গে অর্থনৈতিক চুক্তি বাতিল করেছে। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়, আরব লীগ গুয়েতেমালার সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করল, কিন্তু আরব একটা রাষ্ট্রও ইসরায়েলের সঙ্গে বা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈকিত চুক্তি বাতিল করল না। ১৪ মে’র পর মুসলিম বিশ্বের মধ্যে তুরস্ক, ইরান, পাকিস্তান ছাড়া অন্য কোনো রাষ্ট্র ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জোরালো কোনো অবস্থান নেয়নি। চারবার আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে আরবরা শুধুই খরচ করছে। কোনো মুনাফা পায়নি। ১৯৭৮ সালে ক্যাম্প ডেবিড চুক্তির পর আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আর কোনো ঐক্য পরিলক্ষিত হয়নি। বর্তমানে আরব দেশগুলোর মধ্যে কিছু দেশ নাম ও মানচিত্রসর্বস্ব রাষ্ট্র হিসেবে আছে। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো নিজেদের মধ্যেই যুদ্ধ করছে। সেখানে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ২০০ পারমাণবিক বোমাধারী ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়ার ক্ষমতা রাখে না। অনৈক্য এতটাই, সম্মিলিত অর্থনৈতিক বা কূটনৈতিক অবরোধ আরোপও সম্ভব নয়। সৌদি, মিসর, আরব আমিরা, কুয়েত, বাহরাইনসহ সমৃদ্ধ অর্থনীতের দেশগুলো ইসরায়েলের পরমবন্ধু। ট্রাম্প জামাতা কুশনারের পরমপ্রীতি ভাজন হচ্ছে সৌদি যুবরাজ, আরব আমিরাতের রাজপরিবার, অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরশাসক সিসি। যাদের হাতে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বৃহৎ মুসলিম দেশগুলো। আর এ কারণেই মুসলিম দেশগুলো একতাবদ্ধ হয়ে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন ভূমির জন্য লড়বে সে সম্ভাবনা অবান্তর।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist