এস এম মুকুল

  ২৭ মে, ২০১৮

স্বপ্নভুখ

আশার আলোয় বাংলাদেশ

সাধনায় অসাধ্য সাধন সম্ভব। মঙ্গলকামী চিন্তায় যারা নিমগ্ন থেকেছেন, তারাই সমাজকে দিয়েছেন নতুন পথের দিশা। সময় ও স্বার্থের ঊর্ধ্বে থেকে তারা এমন কিছু করেন, যা মানুষের জন্য হয়ে ওঠে সমৃদ্ধ সংগ্রামের হাতিয়ার। এবার একজন কৃষকের কথা বলব। ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার রুকনাকান্দা গ্রামের নিরক্ষর কৃষক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। কেনু মিস্ত্রি নামে তার ব্যাপক পরিচিতি। এই নিরক্ষর কৃষক কেনু মিস্ত্রি কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য স্বল্পমূল্যে ৩২টি কৃষিযন্ত্র আবিষ্কার করে কৃষকদের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছেন। তার তৈরি যন্ত্র দিয়ে কম সময়ে অধিক পরিমাণ জমিতে সহজে কাজ করা যায়। কৃষিকাজের সহায়ক এসব যন্ত্র ব্যবহার করে এলাকার কৃষকরা উপকৃত হচ্ছেন। তাই শুধু যন্ত্র ব্যবহারের তাগিদে নয়, কৃষিজ জমির চাষ পদ্ধতি, ফলন বৃদ্ধি ও বালাই দমনের জন্য কেনু মিস্ত্রির কাছে পরামর্শ নিতে আসেন প্রতিবেশী কৃষকরা। পেশায় কাঠমিস্ত্রি হলেও সৃজনশীল কৃষক হিসেবে তার রয়েছে গভীর মনোনিবেশ। তাই নিজের জমি চাষাবাদে শ্রম আর খরচ বাঁচানোর ভাবনা তাকে পেয়ে বসে উদ্ভাবনের সাধনে। এই নেশা থেকেই প্রায় দুই যুগ আগে তৈরি করেন নিড়ানি যন্ত্র।

তার তৈরি নিড়ানি যন্ত্রে ১০ জনের কাজ একজনই করতে পারে। তাই এ যন্ত্র কৃষকের জন্য হয়ে ওঠে আশীর্বাদের বস্তু। একসময় কেনু মিস্ত্রি চিন্তা করে দেখলেন মুলা চাষের জন্য গর্ত করতে ১০০ টাকার মজুরির একজন শ্রমিক দিনে গর্ত করতে পারে ২০০টি। এ ভাবনা থেকে তিনি তৈরি করলেন গর্ত করার যন্ত্র। এই যন্ত্র দিয়ে একই সময়ে একজন শ্রমিক ৫০০ গর্ত করতে পারে। এভাবে কৃষিকাজের যন্ত্র তৈরি করার সাশ্রয়ী চিন্তায় ৩২টি যন্ত্র এখন কৃষকের হাতে হাতে। কেনু মিস্ত্রি যন্ত্রগুলোর মধ্যে রয়েছেÑগুটি ইউরিয়া প্রয়োগ যন্ত্র, কৃষি জমিতে চারা ও মাটি নিড়ানি যন্ত্র, গোল আলু রোপণ, শাকসবজির বীজবপন, ফুট পাম্প ঠেলাগাড়ি, ডগাকাটা যন্ত্র, সেনিউটার, চারা ওঠানোর যন্ত্র, প্রেস কোদাল, আগর, রশি প্যাঁচানোর যন্ত্রসহ আরো কৃষি সহায়ক যন্ত্র।

কেনু মিস্ত্রি শুধু যন্ত্র আবিষ্কার করে থেমে থাকেননি। প্রতিবেশী কৃষকদের মধ্যে তিনি প্রায় চার হাজার যন্ত্র তৈরি করে বিনামূল্যে বিতরণ করেছেন। কৃষকরা কাজ শেষে যন্ত্র আবার তার কাছে জমা দিয়ে যান। আবার প্রয়োজনের সময় যন্ত্র নিয়ে কাজ সারেন। এভাবেই চলছে সৃজনশীল কৃষক কেনু মিস্ত্রির কৃষিসেবা কার্যক্রম। তিনি নিজের ফসলের জমিতে কীটনাশক ব্যবহার করেন না। প্রয়োজনের অতিরিক্ত তো নয়ই বরং পরিমিত জৈব সার ব্যবহার করেন। অন্য কৃষকদেরও তিনি কীটনাশক ও অতিরিক্ত সার প্রয়োগ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন। কৃষিজ কলাকৌশল সম্পর্কে কৃষকদের পরামর্শ দেন। এসব কারণে তাকে এলাকার কৃষকরা ‘কৃষি ডাক্তার’ বলেও ডাকেন। সফল এই কৃষক, আবিষ্কারক নিজের পাঁচ একর জমিতে ধান, করলা, লাউ, শিম, বরবটি, কুমড়াসহ নানা রকম শাকসবজির চাষ করছেন। আবিষ্কৃত যন্ত্রগুলোকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাপকভাবে তৈরি করে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার দাবিও জানিয়েছেন তিনি। সৃজনশীল, মুক্তমনা এবং উদ্ভাবনী চিন্তার এই কৃষক প্রমাণ করলেন মাথা খাটানো সাধনায় মানুষের কল্যাণে অনেক কাজই করা যায়।

যশোরের হান্টু একজন দরিদ্র মানুষ। হান্টুর শিক্ষাজ্ঞান অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। অভাবের সংসার। পেশায় তিনি আম ব্যবসায়ী। কয়েক বছর আগে মাছের পোনা উৎপাদনের কাজ করতেন। দেশের প্রচলিত পোনা উৎপাদন পদ্ধতি অনুযায়ী পুকুরে অক্সিজেন সরবরাহের জন্য শ্যালো মেশিনের সাহায্যে পুকুরের পানি আবার পুকুরেই ফেলা হয়। এই ব্যবস্থায় শ্যালো মেশিনের সাহায্যে পুকুরের উপরস্থ বায়ুম-লের সংস্পর্শে থেকে অক্সিজেনমিশ্রিত হয়ে সেই পানি আবার পুকুরে পড়ে। এভাবে আড়াই ফুট গভীর ৫০ শতক আয়তনের জলাশয়ে চাহিদা অনুযায়ী আট মিলিগ্রাম অক্সিজেন সরবরাহের জন্য ২৪ ঘণ্টা মেশিন চালাতে হয়। এতে প্রায় ৫০০ টাকার ডিজেল অথবা ১০০ টাকার বিদ্যুৎ খরচ হয়। এই খরচের হাত থেকে বাঁচার জন্য তিনি নতুন কোনো পথ খুঁজতে থাকেন। অবশেষে ছয় বছর একক প্রচেষ্টায় সাফল্যের মুখ দেখেন হান্টু। মাছের নার্সারি পুকুরে সাশ্রয়ী খরচে অক্সিজেন সরবরাহের যন্ত্র আবিষ্কার করে যশোরে ব্যাপক আলোচিত হন তিনি। তার আবিষ্কৃত যন্ত্রে প্রচলিত ব্যবস্থার চেয়ে ৯২ শতাংশ কম সময়ে সমপরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ সম্ভব। প্রচলিত ব্যবস্থার চেয়ে ৮৫ শতাংশ কম ডিজেল বা বিদ্যুৎ খরচ বাঁচিয়ে এই যন্ত্রের মাধ্যমে অক্সিজেন সরবরাহ করা যাবে। মাছচাষি বা পোনা উৎপাদনকারী নার্সারি ব্যবসার ক্ষেত্রে এই যন্ত্র নতুন দিগন্তের উন্মোচন করল।

সাশ্রয়ী এই যন্ত্রটি তৈরি করতে হান্টুর খরচ হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা। বায়ু সঞ্চালন যন্ত্র হিসেবে তার আবিষ্কারের নামডাক ছড়িয়ে পড়েছে সংশ্লিষ্ট মহলে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট বায়ু সঞ্চালক এই যন্ত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এর সাশ্রয়ী গুণের কথা স্বীকৃতি দিয়েছে বলেও জানা গেছে। হান্টুর বায়ু সঞ্চালক যন্ত্রটি এখন যশোরের চাঁচড়ার সোনালি মৎস্য হ্যাচারিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। তার এই যন্ত্রের সাহায্যে বায়ুম-ল থেকে বাতাস সংগ্রহ করে তা হ্যাচারির পুকুরে ওভারহেড ট্যাংকের পানির মধ্য দিয়ে সঞ্চালিত হয়। সে সময় সংগৃহীত বাতাসের অক্সিজেন পুকুরের পানিতে মিশে যায়। হান্টু একজন সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ হলেও তার সাশ্রয়ী উদ্ভাবনী চিন্তার ফসল দেশের পোনা উৎপাদন ও মৎস্য চাষের ক্ষেত্রে এনেছে নতুন মাত্রা।

এবার এক খুদে বিজ্ঞানীর গল্প। রেলগাড়ির আধুনিক সিগন্যালিং সিস্টেম উদ্ভাবন করেছে নেত্রকোনা টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির মেধাবী ছাত্র শাহাবুদ্দিন ভূঁইয়া সামি। রেলগাড়ি তার এ সিগন্যালিং সিস্টেমে চলাচল করলে যাত্রীরা যে কোনো স্টেশন থেকে তাদের কাক্সিক্ষত ট্রেনের অবস্থান স্টেশনে রক্ষিত সুইচ টিপলেই জানতে পারবে। যেকোনো স্টেশন থেকে ট্রেন ছেড়ে দিলেই পরবর্তী স্টেশনের সিগন্যাল বাতি আপনা-আপনি নিভে যাবে এবং অ্যালার্ম বাজবে। এ পদ্ধতিতে যাত্রীদের ট্রেনের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষায় থাকতে হবে না বা অযথা সময় নষ্ট করতে হবে না।

সামির এই ইলেকট্রিক সিস্টেমে ট্রেন তার নিজস্ব গতিতে নির্দিষ্ট স্টেশনে থামবে। রেলগেট বা ক্রসিংগুলোয় কোনো গেটকিপার বা সিগন্যাল ম্যান লাগবে না। যেকোনো রেলগেট বা ক্রসিংয়ের কাছাকাছি ট্রেন আসতেই অ্যালার্ম বাজবে। ট্রেনটি রেলগেটের নিরাপদ দূরত্বে আসার সঙ্গে সঙ্গে গেট বন্ধ হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে গেট পার হওয়ার পরপরই গেট আপনা-আপনি খুলে যাবে। এই খুদে বিজ্ঞানী আশা করছে, তার এ প্রযুক্তি দ্বারা রেলের অনেক অর্থ সাশ্রয় হবে। কমে যাবে রেল দুর্ঘটনা।

সামির আগামী পরিকল্পনা বড় বড় শহরে অগ্নিকা- থেকে সহজে বাঁচার উপায় বের করা। সাধারণত বড় বড় বিপণি বিতান, শপিং মল বা ফ্ল্যাট বাড়িতে আগুন লাগলে মানুষ পুড়ে মরার চেয়ে হুড়াহুড়িতে দ্বিগুণ মরে। তার আবিষ্কৃত যন্ত্রের মাধ্যমে কোন জায়গায় আগুন লেগেছে তা সংশ্লিষ্ট ভবনের সবাই সহজে জানতে পারবে। এ ভবনের প্রতিটি তলায় সংরক্ষিত সুইচ বোর্ড অগ্নিকান্ড সংঘটিত হওয়ার স্থান বা তলার চিহ্ন দেখিয়ে দেবে, একই সঙ্গে অ্যালার্ম বাজবে। সামির মতে, তার এ উদ্ভাবিত যন্ত্রের মাধ্যমে আগুনের অবস্থান লক্ষ্য করে এ ভবনের সব লোকজনকে উদ্ধার করা সম্ভব হবে। কিছুদিনের মধ্যেই সামির এ যন্ত্র উদ্ভাবনের কাজ সম্পন্নœ হবে।

এই খুদে বিজ্ঞানী ১৮ এপ্রিল বাংলাদেশ শিশু একাডেমি মিলনায়তনে আয়োজিত জাতীয় শিশু পুরস্কার ২০০৭ অর্জন করে। সামি তার উদ্ভাবিত এ প্রকল্প প্রদর্শন করে জাতীয়ভাবে দ্বিতীয় ও ঢাকা বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে। সামি নবম শ্রেণির ছাত্র থাকা অবস্থায় ২০০৭ সালে এ প্রকল্প উপস্থাপন করে ময়মনসিংহ জেলা শিশু একাডেমির প্রথম পুরস্কার লাভ করে। এর আগে ২০০৫ সালে তার উদ্ভাবিত নৌ-দুর্ঘটনায় বা জলোচ্ছ্বাসে আগাম সংকেত-সংক্রান্ত যন্ত্র উপস্থাপন করে বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটির তৎকালীন ভিসি ড. আমিরুল ইসলাম তাকে অ্যাগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটিতে এক সংবর্ধনা দেন। আমাদের দেশে লঞ্চডুবি বা দুর্ঘটনায় ডুবে যাওয়া জাহাজটি সহজে উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। সামির প্রযুক্তির সাহায্যে ডুবে যাওয়া জাহাজটির অবস্থান কোথায় ও কত পানির নিচে তা সঙ্গে সঙ্গেই জানা যাবে। তবে প্রতিটি জাহাজে এ যন্ত্রটি সংরক্ষিত থাকতে হবে।

সামির মতো এমন সম্ভাবনাময় বিজ্ঞানীদের প্রতি সরকারের শিগগিরই গুরুত্বারোপ প্রয়োজন। মেধাবী আমাদের মানুষ। প্রয়োজন পৃষ্ঠপোষকতার। সরকারের এ ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকার রাখার ব্যাপার রয়েছে। বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহী করে তোলার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist