রেজাউল করিম খান

  ২১ মে, ২০১৮

পর্যালোচনা

খুলনা সিটি নির্বাচন

চলতি বছরের শুরুতে আলোচিত বিষয়ের মধ্যে ছিল গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। নির্বাচন কমিশন একই সঙ্গে দুই নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ ঘোষণা করে। মাঝপথে আদালতের নির্দেশে গাজীপুরের নির্বাচন স্থগিত হলেও খুলনা সিটির নির্বাচন যথারীতি অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী তালুকদার আবদুল খালেক তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি মনোনীত প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে ৬৭ হাজার ৯৪৬ ভোটে পরাজিত করেন। মঙ্গলবার নির্বাচনের শুরুতেই বিএনপি প্রার্থী নজরুল ইসলাম অভিযোগ করেন, তার এজেন্টদের ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে, এমনকি মারধরও করা হয়েছে। ফলাফল ঘোষণার পর বুধবার নজরুল ইসলাম মঞ্জু এক সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে বলেন, এই নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনে সহায়ক না, যোগ্যও না। ১০৫টি কেন্দ্রে ব্যালট ছিনিয়ে ভোট দেওয়া হয়েছে, ৪৫টি কেন্দ্রে ভোটারদের আটকে রাখা হয়েছে। ভোট ডাকাতির অন্যতম দৃষ্টান্ত এটি। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব না। অন্যদিকে ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ (ইডব্লিউজি) বলছে, বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি) নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে তেমন কোনো সহিংসতা বা অনিয়মের ঘটনা ঘটেনি। নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অধিকতর স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে ২৮টি সিভিল সোসাইটি সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ খুলনা সিটি নির্বাচন পর্যবেক্ষণ শেষে বুধবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেছে। মূল প্রবন্ধে ড. মো. আবদুল আলীম জানান, ভোট দেওয়ার হার ৬৪ দশমিক ৮ শতাংশ। ভোট গ্রহণের সময় পর্যবেক্ষকরা ৯৯ দশমিক ৩ শতাংশ ভোটকেন্দ্রে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট এবং ৮৮ দশমিক ৮ শতাংশ কেন্দ্রে বিএনপি মেয়র প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট দেখতে পেয়েছেন।

ভোটের ফলাফল ঘোষণার পর সংগত কারণেই খুলনা সিটি নির্বাচন সব মহলে আলোচিত হয়। নির্বাচন পরিচালনা, ভোটের প্রচারণা, খবর সংগ্রহ ও পর্যবেক্ষণের জন্য যারা রাজধানী থেকে খুলনা গিয়েছিলেন, ঢাকায় ফিরে তারা নানা মতামত প্রকাশ করেছেন। বিএনপিও বিপুল ভোটে পরাজয়ের কারণ অনুসন্ধান করছে। স্থানীয় পর্যবেক্ষণ ও ওইসব মতামতের সারসংক্ষেপ করলে দাঁড়ায়Ñ(ক) সরকারের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। (খ) নির্বাচন কমিশন বিদ্যমান প্রশাসনের ওপর নির্ভরশীল হয়েই নির্বাচন পরিচালনা করেছে। (গ) বিএনপির স্থানীয় নেতৃত্বে বিরোধ ছিল। নির্বাচনের আগে বিরোধ নিষ্পত্তি ও সমন্বয় করা সম্ভব হয়নি। (ঘ) তালুকদার আবদুল খালেক এর আগেও সিটি মেয়র ছিলেন এবং ওই সময় খুলনা সিটিতে কিছু উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপির মেয়র মনিরুজ্জামান তেমন কাজই করতে পারেননি। মানুষের ধারণা হয়েছিল, আওয়ামী লীগ প্রার্থী পরাজিত হলে খুলনার উন্নয়ন ফের বাধাগ্রস্ত হবে। (ঙ) বিএনপি প্রচারিত জাতীয় ও দলীয় ইস্যু যেমন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মুক্তি এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের বিষয়টি ভোটারদের তেমন প্রভাবিত করতে পারেনি।

চলতি বছরেই জাতীয় সংসদের নির্বাচন। এ সময় আওয়ামী লীগ কোনো ঝুঁকি নিতে চায় না। এখন পরাজয় বরণ করলে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া নেতাকর্মীদের মনোবলেও চিড় ধরতে পারে। বিষয়টি মাথায় রেখে সরকার সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এর ফলে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কিছু বাড়তি সুবিধা পেয়েছে। এ কারণে নির্বাচনে কিছু বলপ্রয়োগ ও অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে বলে অনেকের ধারণা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। মঙ্গলবার রাতে গুলশানে খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরো বলেন, দেশে এখন ফ্যাসিবাদ চলছে। রাজনৈতিক দলগুলো স্বাধীনভাবে নিজেদের রাজনৈতিক কর্মকা- পরিচালনা করতে পারছে না। সরকার জোর করে ক্ষমতা দখল করে আছে। এভাবে বেশিদিন থাকা যায় না। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা ব্লুম বার্নিকাট গত বুধবার পররাষ্ট্র সচিব এম শহিদুল হকের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের বলেন, খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচন তারা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। ভোটে যে বলপ্রয়োগ হয়েছে, ভোটারদের ভোটদানে বাধা দেওয়া হয়েছে, এসব ঘটনার উপযুক্ত তদন্ত করে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। ভবিষ্যৎ নির্বাচনের জন্য এটি জরুরি।

রাজনীতিসচেতন মানুষদের একটি অংশ মনে করে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও তৎপরবর্তীকালের প্রায় সব কয়টি স্থানীয় সরকার পরিষদের নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ ও ত্রুটিপূর্ণ ছিল। অধিকাংশ ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভা নির্বাচনে বিরোধী দলের প্রার্থীদের নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে। বিএনপি নেতাকর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে হামলা অথবা মামলা দিয়ে এলাকাছাড়া করা হয়। নির্বাচনী প্রচারেও বাধা সৃষ্টি করা হয়। মানুষ ভয় পেতে থাকে। ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার প্রয়োজনই হয় না। এসব কারণে নির্বাচনগুলো প্রহসনে পরিণত হয়। তবে ব্যতিক্রম ছিল নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা ও রংপুর সিটি নির্বাচন। পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, রংপুর সিটি নির্বাচন এযাবৎকালের অন্যতম সেরা নির্বাচন। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যেসব পূর্বশর্ত থাকে, তার সব কয়টিই রংপুর সিটি নির্বাচনে বিদ্যমান ছিল। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন সফল হয়েছে। ওই নির্বাচনের আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে, ইলেকট্রিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) সফল ব্যবহার। ভোট গ্রহণের মাত্র ১৩ মিনিটের মধ্যে ওই কেন্দ্রের ফলাফল পাওয়া গেছে। প্রত্যাশা অনুযায়ী নির্বাচনটি ছিল সবার অংশগ্রহণমূলক ও শান্তিপূর্ণ।

খুলনা সিটি নির্বাচনে বিএনপি নেতারা ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত হলেও কেউ কেউ একে স্বাভাবিক বলেই মনে করছেন। পরাজিত হয়ে নজরুল ইসলাম মঞ্জু যা-ই বলুন না কেন, নির্বাচনে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ছিল। ছিল সাংগঠনিক দুর্বলতা। অনেকে আগেই বুঝতে পেরেছিলেন, তাদের প্রার্থী পরাজিত হবে। সেই কারণে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। ২০-দলীয় জোটের কোনো তৎপরতা ছিল না। স্থানীয় নেতাকর্মীদের অনেকেই গ্রেফতার হয়েছেন, অনেকে ভয়ে গা-ঢাকা দিয়েছেন। কাউন্সিলর প্রার্থীদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগ ও তাদের মেয়র প্রার্থীর সঙ্গে সমঝোতা করেছেন। দলীয় পোলিং এজেন্টদের কয়েকজন অজানা ভয়ে ভোটকেন্দ্রেই যাননি, অনেকের কাগজপত্র ঠিক ছিল না, নানা কারণ দেখিয়ে তাদের বুথ থেকে বের করে দেওয়া হলেও তারা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেননি। এতদসত্ত্বেও বিএনপি মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম মঞ্জু লক্ষাধিক ভোট পেয়েছেন। ব্যাপক কারচুপি হলে তিনি এই পরিমাণ ভোট পেতেন না। এমনই বাস্তবতায় নির্বাচন কমিশনের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেছেন, চমৎকার ও সুন্দর এবং উৎসবমুখর পরিবেশে খুলনায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।

খুলনা সিটি নির্বাচনে সিপিবি-বাসদ ও বাম মোর্চা সমর্থিত মেয়র প্রার্থী ছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির মিজানুর রহমান বাবু। নির্বাচনে পর্যাপ্ত টাকা খরচ করার সামর্থ্য তার ছিল না। প্রচার-প্রচারণা ছিল দায়সারা গোছের। তার প্রাপ্ত ভোটের পরিমাণ উল্লেখ না করাই ভালো। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন তিনি ওই নির্বাচনে প্রার্থী হলেন? বলা হয়ে থাকে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ। পার্টির নাম প্রচার ও ইশতেহারের মাধ্যমে জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে বেগবান করাও অন্যতম লক্ষ্য। কিন্তু পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে প্রচলিত বিধিতে নির্বাচনে অংশ নিয়ে তাদের বৈধতা দেওয়া ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায় না। বরং বামদের হাস্যকর উপস্থাপন জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। নির্বাচনে কালোটাকার ব্যবহার বন্ধ, রাষ্ট্রক্ষমতার অবৈধ হস্তক্ষেপ রোধ, প্রচারে সমতা আনা প্রভৃতি বিষয়ে বামদের প্রস্তাবনা থাকলেও নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। করতেও পারবে না। সে ক্ষেত্রে নিজেদের জোটবদ্ধ ও সংগঠিত হয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের চেষ্টা করাই অধিকতর যুক্তিসংগত।

স্থানীয় সরকার পরিষদের নির্বাচনে জয়-পরাজয়ে সরকারের তেমন কিছু আসে যায় না। তবে চলতি বছরে নির্বাচনের ফলাফল ভিন্ন বার্তা বহন করছে। এতে ভোটারদের মনোভাব বোঝা যচ্ছে। বাংলাদেশের মানুষ প্রবাদ অনুযায়ী শক্তের ভক্ত। তারা বুঝতে পেরেছে, বিএনপি যেমন আন্দোলনের ক্ষমতা হারিয়েছে, তেমন প্রচারে নামতে ও ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত থাকতেও ভয় পাচ্ছে। যারা নিজেরাই ভীত, তারা অন্যের ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে না। সুতরাং মানুষ আর তাদের সমীহ করতে চায় না। এ ছাড়া সাধারণ ভোটার মনে করছেন, যে দল ক্ষমতায় থাকে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সেই দলের না হলে উন্নয়ন কর্মকা- বাধাগ্রস্ত হয়। খুলনা সিটি নির্বাচনে ভোটাররা এই সত্যটি বুঝতে পেরেছেন।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist