এস এম মুকুল

  ২০ এপ্রিল, ২০১৮

সুখ

মরীচিকার মোহ

সুখ মানুষের চিরায়ত আকাক্সক্ষা। সুখের জন্য মানুষ যেন সবকিছু করতে পারে। এক জীবনে সুখের সন্ধানে ঝাঁপিয়ে পড়া আর দাপিয়ে বেড়ানো মানুষ বেলাশেষে কতটা সুখী, তা আপেক্ষিক বিষয়। হজরত আলী (রা.) বলেছেন, ‘মানুষ বড়ই আশ্চর্যজনক ও বোকা। সে সম্পদ অর্জন করতে গিয়ে স্বাস্থ্য হারায়। তারপর আবার সেই স্বাস্থ্য ফিরে পেতে সম্পদ নষ্ট করে। সে বর্তমানকে ধ্বংস করে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে, আবার সে ভবিষ্যতে পৌঁছে কাঁদে, অতীতের জন্য অনুসূচনা করে। সে এমনভাবে জীবন কাটায় যেন সে কখনো মরবে না। কিন্তু সে এমনভাবেই মরে যেন সে কখনোই জন্মায়নি!’ বিশ্লেষণ থিউরি অনুযায়ী, মানুষ সত্যি আশ্চর্যরকমের বোকা। সে সারা জীবন সুখের সন্ধানে পাগলা হয়ে অর্থ উপার্জন করে। আবার সেই অর্থ আহরণে নিজের শরীর ও মনকে করে তোলে অসুখী অর্থাৎ অসুস্থ। সে আবার সেই অর্থ অকাতরে খরচ করে শরীর আর মানসিক সুস্থতার পেছনে। মাঝখানে তার জীবন উপভোগের সুবর্ণ সময়গুলো চলে যায় কালের গর্ভে। তাহলে সুখ কোথায়? সুখ আসলে কীসে? কেন মানুষ অকারণে ছুটে চলে সুখের সন্ধানে? একি তাহলে মানুষের সুখের অসুখ!

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সমাধান নেটওয়ার্ক (এসডিএসএন) ‘বিশ্ব সুখী প্রতিবেদন-২০১৮’ সুখী দেশের তালিকায় পাঁচ ধাপ পিছিয়ে বাংলাদেশ এবার ১১৫তম অবস্থানে। ২০১৮ সালে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ফিনল্যান্ড। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, সেখানকার অধিবাসীরাই শুধু নয় অভিবাসীরাও আনন্দে থাকেন। কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ার প্রফেসর জন হেলিওয়েল বলেছেন, অদ্ভুতভাবে ফিনল্যান্ডের প্রবাসীরা বেশ খুশিতে থাকেন। খুম কম দেশেই এমন দেখা যায়। এটিই বোনাস পয়েন্ট ফিনল্যান্ডের ক্ষেত্রে। যাক বাংলাদেশের পিছিয়ে যাওয়ার কারণে প্রশ্ন এসেছে, তবে কি বাংলাদেশ অসুখী দেশ হতে চলেছে? বাংলাদেশের মানুষ কি অসুখী? কিন্তু কেন, কেন এবং কেন? এর কারণ নিয়ে বিশ্লেষণ হতেই পারে, তবে তার আগে জেনে রাখুন ২০১৬ সালে প্রকাশিত যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংগঠন নিউ ইকোনমিকস ফাউন্ডেশনের ‘হ্যাপি প্ল্যানেট ইনডেক্স ২০১৬’ প্রতিবেদনে পরিবেশবান্ধব ও সুখী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ বিশ্বের ১৪০টি দেশের মধ্যে অষ্টম অবস্থানে ছিল। একটি দেশের নাগরিকদের সন্তুষ্টি, গড় আয়ু, পরিবেশের ওপর প্রভাব ও বৈষম্য- এই চার মানদ- বিবেচনায় সুখী দেশের তালিকা তৈরি করে। সে প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ২৫ বছরে বাংলাদেশ মানব উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখিয়েছে। ২০১৪ সালে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে কর্মসংস্থানে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে ছিল বাংলাদেশ। আরো বলা হয় গড় আয়ুর দিক দিয়ে ১৪০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৮১তম আর নাগরিকদের সন্তুষ্টির বিচারে বাংলাদেশ ৯৫তম অবস্থানে। অন্যদিকে, যেসব দেশের মানুষ পরিবেশকে সবচেয়ে কম বদলে দিচ্ছে, তাদের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। মূলত, এ বিষয়টিই বাংলাদেশকে বিশ্বের ‘অষ্টম সুখী ও সবুজ দেশ’ হওয়ার পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে। আমার বদ্ধমূল ধারণা হ্যাপি প্ল্যানেট ইনডেস্ক যথার্থই মূল্যায়ন করেছে। তবে তাদের জরিপ অনুযায়ী বর্তমান বাংলাদেশকে বিশ্লেষণ করলে তা আরো এগিয়ে থাকার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। দেশকে সবুজায়নে এবং পরিবেশের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের সহানুভূতি ও সচেতনতা অনেক বেড়েছে। দেশের মানুষের গড় আয়ু, পুষ্টিগ্রহণ, শিশুর মৃত্যুহার, নারীর অধিকার ও মূল্যায়ন এরকম অনেক সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক। তবে হাতাশারও অনেক দিক রয়েছে যেগুলোকে আমরা অসুখী প্রবণতার জন্য দায়ী বলতে পারি।

দার্শনিক সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘ সুখ বাহ্যিক জগত থেকে আসে না। সুখের গোপন মন্ত্র হলো, খুব বেশি না চাওয়া আর কম উপভোগের বিষয়টি আয়ত্ত করা।’ গত দুই দশকে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, দেশের মানুষের অসুখী হওয়ার কারণগুলো কী কী? বাংলাদেশের মানুষের মাঝে রাতারাতি ধনী হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে ৯০ দশকের শেষ দিক থেকেই। রাজনৈতিক অস্থিরতা, অসাধুতা সমাজের সর্বস্তরে ধন আহরণের এক অসুস্থ প্রতিযোগিতার প্রেষণা জাগিয়ে দিয়েছে। ফলে সমাজে, রাষ্ট্রে সবখানে সুনীতি পরাজিত হতে বাধ্য হয়েছে দুর্নীতির কাছে। কেননা দুর্নীতি, অনিয়ম, অসদুপায়, প্রতারণা, শোষণ ছাড়া রাতারাতি ধনবান আর বলবান হওয়ার অন্য কোনো উপায় যে নেই। মানুষ ধনসম্পদ, বাড়ি-গাড়ি, গয়নাগাটি, ব্যাংক ব্যালেন্সকেই সুখের অন্যতম উপাদেয় মনে করে বাকি সবকিছুকে তুচ্ছ করে টাকা কামানোকেই মুখ্যম দাওয়াই মনে করেছে। কিন্তু তারা আজ কতটা সুখী হতে পেরেছে এর সমীকরণ ১১০ থেকে একবছরে ১১৫-তে অবস্থানই বড় প্রমাণ। এখন মানুষের মনে সুখ নেই, শরীরে অসুখের বাসা। ঘরে সুখ নেইÑ সুখ খোঁজেন ফেসবুকে, টুইটারে, বারে বা ক্লাবে। সন্তান বিপথে গেছেÑ জীবনের সব সুখ আজ অসুখের অতলে নিমজ্জিত। মাদকের ভয়াল থাবা আর অনলাইনে বুঁদ হয়ে থাকা সন্তানের মতিগতি বোঝে না পিতা-মাতারা। টাকা আছে, বাড়ি, গাড়ি সব আছেÑ শুধু সুখটুকু যেন নেই।

অর্থে যদি সুখ আসত, তবে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর নাম সুখী দেশের তালিকায় সবার আগে থাকার কথা। সুখের উপাদানগুলো কী? টাকা-পয়সা, বাড়ি-গাড়ি, নাম-যশ-খ্যাতি-প্রতিপত্তি? কেউ কেউ খুব অল্পেই নিজেকে সুখী মনে করেন। আবার অনেকেই তন্ন তন্ন করে সুখ খুঁজেও সুখের দেখা পান না। সুখের মাপকাঠির আসলে কী? হার্ভার্ডের মনোবিজ্ঞানী ড্যান গিলবার্ট বলেছেন, তোমার সুখ তোমাকেই সংশ্লেষণ করতে হবে। তোমার শরীরে মনস্তাত্ত্বিক একটি ‘ইম্মিউন সিস্টেম’ রয়েছে, যা তোমার পারিপার্শ্বিকতা বা তোমার বিশ্বকে জানতে ও বুঝতে সাহায্য করার মাধ্যমে তোমাকে সুখী করে তুলবে। নতুন কাপড়চোপড় কেনা, অগাধ টাকা অর্জন তোমার জীবনের সব দুঃখ দূর করে দিয়ে অনাবিল আনন্দ ও সুখ বয়ে আনবে, এ ধরনের কল্পনা মানুষের চিন্তাশক্তিকে ভুল পথে পরিচালিত করে। তিনি ঠিকই বলেছেন। কারণ, বৈষয়িক অর্থে আমরা সুখ বলতে ইচ্ছাপূরণকেই বুঝে থাকি। কিন্তু প্রকৃত অর্থে সুখে থাকা মানে ভালো থাকা। অন্যভাবে বলা যেতে পারে, অর্থ দিয়ে ইচ্ছেপূরণ হলেও মানসিকভাবে সুখী হওয়া না-ও যেতে পারে। আবার ভালো থাকার চেষ্টায় মানুষ নিজ নিজ অবস্থানে অল্পতে তুষ্ট থেকেই সুখী হতে পারে। আসলে সুখী হওয়ার আছে কি কোনো তন্ত্রমন্ত্র। বিভিন্ন গবেষণার আলোকে বলা হয়েছে, সকালে ঘুম থেকে ওঠা, ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করা, মন খুলে কথা বলা, ক্ষমা করার প্রবণতা, সবার সঙ্গে হাসিখুশি আচরণ করাÑ এই পাঁচটি অভ্যাস মানুষের জীবনে সুখ এনে দিতে পারে। এই পাঁচটি অভ্যাসকে সুখের মন্ত্র বলার কারণ হলো, পৃথিবীর অধিকাংশ সুখী মানুষকে এই বিষয়গুলো অনুসরণ করতে দেখা গেছে।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, মানুষ তখনই সুখী হয়, যখন তার আবেগ এবং ইচ্ছা প্রকাশ সহজে করতে পারে। আবার এই আবেগ অনুভূতি সবসময় সুখকর না-ও হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল, চীন, জার্মানি, ঘানা, ইসরায়েল, পোল্যান্ড এবং সিঙ্গাপুরের প্রায় দুই হাজার ৩০০ মানুষের ওপর জরিপ চালিয়ে জেরুজালেমের হিব্রু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মায়া তামির বলেছেন, ‘আপনার মনে যদি কোনো অনুভূতি জমা হয়, তবে তা দ্রুত প্রকাশ করাই ভালো। সেটা সুখকর অনুভূতি না-ও হতে পারে।’

লেখক : বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist