দিলীপ কুমার আগরওয়ালা

  ১৩ এপ্রিল, ২০১৮

নিবন্ধ

মাদক এবং সন্ত্রাস

বিগত বছরগুলোতে মাদক বাংলাদেশসহ বিশ্বে সামাজিক ক্যানসারে পরিণত হয়েছে। মাদক সমাজকে এমনভাবে গ্রাস করছে যে, এখান থেকে বেরিয়ে আসা আমাদের জন্যে দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। মাদকের আগ্রাসন যুবসমাজকে কোন পথে নিয়ে যাচ্ছে, সে প্রশ্ন এখন জনমনে। দেশ, জাতি ও সমাজের উজ্জ্বল নক্ষত্র হচ্ছে তরুণরা। তরুণরা আগামী দিনের কর্ণধার। সেই তরুণরা মাদকের কুপ্রভাবে যেভাবে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। মাদকের ভয়াল আগ্রাসন দেশের যুবসমাজকে সর্বনাশের পথে নিয়ে যাচ্ছে। এ সর্বনাশা নেশা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে, ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের মাঝে। ইদানিং এ নেশা মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নবিত্ত পরিবারেও বিস্তার লাভ করেছে। নেশার জন্য ধনাঢ্য পরিবারের সন্তানদের অনেকে দুর্বৃত্তপনার সঙ্গেও জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়। নেশার টাকা জোগাড় করতে হাইজ্যাকসহ দস্যুপনার সঙ্গেও জড়িত হচ্ছে।

১৬ কোটির এই দেশে মাদকাসক্তের সংখ্যা প্রায় দেড় থেকে দুই কোটি। বন্ধুদের প্ররোচনা, কৌতূহল ও সহজলভ্য হওয়ায় তরুণরা সহজেই মাদকাসক্ত হচ্ছে। নেশার অর্থ জোগাতে বড় বড় অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে কেউ কেউ। ধূমপানে কৌতূহলী হয়ে বন্ধুর হাত ধরে মাদকে আসক্ত হচ্ছে তরুণরা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়াসহ কেউ বাদ যাচ্ছে না এই মরণাসক্ত মাদক থেকে। সমাজে পারিবারিক বন্ধন শিথিল হওয়া, নৈতিক মূল্যবোধ কমে যাওয়া এবং ব্যক্তিগত অর্জনের নেশার কারণেই দিন দিন আসক্তের সংখ্যা বাড়ছে। তারা ক্রমাগত মাদকের প্রতি আসক্ত হয়ে, ছিনতাই, চুরিসহ বিভিন্ন অপরাধের দিকে পা বাড়াচ্ছে। মাদকাসক্তরা দ্রুত কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং পরিবারের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।

ফেনসিডিল, ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকের জীবনবিনাশী আগ্রাসনের শিকার হয়ে দেশের যুব সমাজ নৈতিক ও শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে। দেশের সীমান্তরক্ষীদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সীমান্তের পেশাদার, দাগি চোরাকারবারীদের মাধ্যমে বছরে হাজার কোটি টাকার মাদক দেশে আসছে এবং আমাদের যুবসমাজ ক্রমাগতভাবে মাদকের ভয়াল ছোবলে ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা যদি পরিবারের কথাই বলি, তাহলে দেখা যাবে অনেক পরিবারেই বাবা-মায়ের কলহ কিংবা মনোমালিন্যের প্রভাব পড়ে সন্তানদের ওপর। স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্যতার কারণে অনেক সময় সংসারও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তখন দেখা যায় পিতা-মাতা দুজন বিচ্ছিন্ন হয়ে দুই মেরুর বাসিন্দা হয়ে পড়েন। আর সন্তানরা এ ক্ষেত্রে অনেকটাই অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ে। এই অভিভাবক শূন্যতা এবং পারিবারিক দুশ্চিন্তার ফলে উদীয়মান তরুণ শক্তিকে গ্রাস করে মাদক। বিগত দিনগুলোতে আমরা এ ধরনের কিছু ঘটনা বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ করেছি।

অনেক সময় অধিকাংশ বাবা মা-ই খবর রাখেন না যে, তার আদরের সন্তান ঘরের বাইরে কী করে? এমনকি, অনেক বাবা-মা ঘরের ভেতরে সন্তান কী করে, সে খবরও জানেন না। বাবা মায়ের এই অসর্তকতার কারণেও অনেক সময় ছেলে মেয়ে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। বিশ্বের প্রতিটি দেশেই কমবেশি মাদক সমস্যা বিদ্যমান। বাংলাদেশেও মাদক ও মাদকাসক্তি এক জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। দেশের অধিকাংশ মাদকসেবী কিশোর-কিশোরী এবং যুবক-যুবতী। যে যুব সমাজের ওপর দেশের শিক্ষা-দীক্ষা, উন্নতি, অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ নিভর্রশীল, তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ যদি মাদকাসক্তিতে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে সে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এ ভয়ঙ্কর অভিশাপ থেকে আমাদের যুবসমাজকে রক্ষা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

মাদকমুক্ত সমাজ গঠন করতে হলে নেশার ভয়াবহতা সম্বন্ধে তরুণ প্রজন্মকে জানাতে হবে। নিজেও ছাড়তে হবে অন্যকেও বোঝাতে হবে ও পুনর্বাসন করতে হবে ভুক্তভোগীদের। তরুণদের সঙ্গে মিশতে হবে, তাদের বুঝতে হবে এবং সময় দিতে হবে। আমাদের যুব সমাজের প্রাণশক্তি ও উদ্দীপনা দেশ ও জাতির উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য। তারুণ্যের শক্তি যেমন দেশ ও জাতিকে উন্নয়ন ও অগ্রগতির উচ্চ শিখড়ে নিয়ে যেতে পারে, ঠিক তেমনি এর উল্টোটি দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতির কারণও হতে পারে।

তরুণ সমাজের একটি অংশ নেশাজাতীয় দ্রব্য গ্রহণের পাশাপাশি স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল, ইন্টারনেট ও মুঠোফোনের মাধ্যমে ভিনদেশী অপসংস্কৃতি ও পর্নোগ্রাফিতেও আসক্ত হয়ে পড়ছে। এর কুফলে দিনকে দিন ইভটিজিং, অপহরণ, ধর্ষণ, খুন, গুম, আত্মহত্যা ও অপমৃত্যুর হার বেড়ে চলেছে। নেশার ছোবলে যুব সমাজের নৈতিক অবক্ষয় এবং সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অবক্ষয় দেশ ও জাতির সামগ্রিক উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে ব্যাহত করছে। তাই মাদকের আগ্রাসন ও অভিশাপ থেকে মুক্তির জন্য শুধু প্রশাসনিক ও আইনী ব্যবস্থাই যথেষ্ট নয়, সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলাও জরুরি। সামাজিক প্রতিরোধের জন্য সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিই পূর্বশর্ত। মাদকের বিরুদ্ধে সামাজিক, সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সচেতনতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ নিতে হবে। সব বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে যদি মাদকের ধ্বংসাত্মক ও ক্ষতিকর দিকগুলো সঠিকভাবে তুলে ধরা যায় এবং তাদের মধ্যে সচেতনতা আসে তাহলে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই মাদকাসক্তের সংখ্যা কমবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সমাজের সচেতন মানুষকে নিয়ামক ভূমিকা পালন করতে হবে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাদকবিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধির যে কর্মসূচি নেওয়া হয়েছিল, তা জোরদার করতে হবে।

লেখক : পরিচালক, এফবিসিসিআই

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist