মানিক লাল ঘোষ

  ০১ মে, ২০২৪

মুক্তমত

শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু

গণমানুষের কল্যাণ ও মুক্তির লক্ষ্যে আমৃত্যু আপসহীন সংগ্রামী স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার চিন্তা, চেতনা ও ভাবনায় জুড়ে ছিল মেহনতি মানুষের মুক্তি। এ দেশের কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন তিনি। তাই তো আজীবন শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন।

বঙ্গবন্ধু বৈষম্যের বিরুদ্ধে যেমননি ছিলেন সোচ্চার, তেমনি দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। শ্রমজীবী মানুষকে কতটা শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন বঙ্গবন্ধু তার বিভিন্ন বক্তব্যে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহান স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে বঙ্গবন্ধু চাকরিজীবীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনি চাকরি করেন আপনার মায়না দেয় ওই গরিব কৃষক, আপনার মায়না দেয় ওই গরিব শ্রমিক। আপনার সংসার চলে ওই টাকায়, আমি গাড়িতে চলি ওই টাকায়। ওদের সম্মান করে কথা বলুন, ওদের ইজ্জত করে কথা বলুন, ওরাই মালিক।’ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণে শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের প্রতি তার মমত্ববোধ কতটা তা ফুটে ওঠে। কতটা শ্রমবান্ধব ও বিশাল হৃদয়ের অধিকারী হলে একজন রাষ্ট্রনায়ক তার দেশের গরিব শ্রমজীবীদের দেশের মালিক বলে ঘোষণা দিতে পারেন। সেদিন বঙ্গবন্ধুর এমন ঘোষণায় নব জাগরণের প্রেরণা পায় এ দেশের শ্রমজীবীরা।

বঙ্গবন্ধু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, শ্রমজীবী মেহনতি মানুষ হচ্ছে উৎপাদন, শিল্পোন্নয়ন, তথা অর্থনৈতিক উন্নয়নের অপরিহার্য উপাদান, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মধ্যে নিহিত দেশের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ। তাই তিনি সেদিন তার ভাষণে বলেন, ‘শ্রমিক ভাইয়েরা, আমি শ্রমিক প্রতিষ্ঠান করেছি, আপনাদের প্রতিনিধি ইন্ডাস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট, লেবার ডিপার্টমেন্টের শ্রমিক প্রতিনিধি বসে একটা প্ল্যান করতে হবে। সেই প্ল্যান অনুযায়ী কী করে আমরা বাঁচতে পারি তার বন্দোবস্ত করতে হবে।’ নিজে কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে শ্রমিকদের কল্যাণে তাদের কাছ থেকেই মতামত গ্রহণ করে শ্রমিকদের স্বার্থ সুরক্ষা করে উৎপাদন বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। শুধু নিজ দেশের শ্রমজীবী মানুষের জন্য নয় বিশ্বের সবল মেহনতি মানুষের মুক্তির কণ্ঠস্বর ছিলেন বঙ্গবন্ধু।

১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন- ন্যাম শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে নেহনতি মানুষেরই জয়গান গেয়েছেন। বলেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দুভাগে বিভক্ত, একদিকে শোষক, আর অন্যদিকে শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ এই ভাষণ বিশ্বের শ্রমজীবী মেহনতি মানুষকে হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকে। তিনি জানতেন শোষিত নিপীড়িত মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে সমাজে সাম্যতা আসবে না।

শ্রমজীবী মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর মমত্ববোধ এই প্রজন্মের অনেকের কাছেই অজানা। আর জানবেই বা কি করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে দীর্ঘ ২১ বছর বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার কত ষড়যন্ত্রই না করেছিল পাকিস্তানের দোসর স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি। অবশ্য আজ তারাই ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত।

বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের স্মরণীয় দিন ১ মে। মহান মে দিবস। এই দিবসটিকে সামনে রেখে আবার গণমাধ্যমে উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধুর শ্রমভাবনা। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য শ্রমিকদের আত্মত্যাগের এই দিনকে শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় স্মরণ করতে ১ মে সারা বিশ্বে ‘মে দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশে ও যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয় দিবসটি।

বাংলাদেশে এ দিবসটি যথাযথভাবে পালন ও শ্রমিকদের কল্যাণে মহান স্বাধীনতা লাভের পরই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নবপ্রণীত সংবিধানের বেশ কয়েকটি অনুচ্ছেদে শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের অধিকারের বিষয় সুদৃঢ়করণ করেন। সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদে কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তির কথাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হবে মেহনতি মানুষকে- কৃষক ও শ্রমিকের এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা। ১৫ (খ) অনুচ্ছেদে কর্ম ও মজুরির অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে- কর্মের অধিকার অর্থাৎ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করে যুক্তিসংগত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার; যুক্তিসংগত বিশ্রাম বিনোদন ও অবকাশের অধিকার। ৩৪ অনুচ্ছেদে জবরদস্তি- শ্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সকলপ্রকার জবরদস্তি শ্রম; এবং এই বিধান কোনভাবে লঙ্ঘিত হইলে আইনত; দণ্ডনীয় অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে। শ্রমজীবীদের প্রতি বঙ্গবন্ধু নিখাদ ভালোবাসা ও আন্তরিকতার কারণেই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে মেহনতি মানুষের অধিকারের বিষয়টি অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৭২ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সদস্যপদ লাভ করে সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালের ২২ জুন আইএলসি সম্মেলনে ৬টি কোর-কনভেনশনসহ ২৯টি কনভেনশন অনুসমর্থন করে সবার দৃষ্টি কাড়ে বাংলাদেশ নামের নতুন রাষ্ট্র। ১৯৭৩ সালে পহেলা মে কে মে দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেন এবং সরকারি ছুটি ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু।

শ্রমজীবী মেহনতি মানুষকে বঙ্গবন্ধু যেভাবে আপন করে নিয়েছেন, সম্মান দিয়েছেন তা ইতিহাসে বিরল। শ্রমজীবীদের তার মমত্ববোধ থেকে আমাদের নৈতিকতার শিক্ষা নিতে হবে। ভাবতে হবে শ্রমজীবীরা ও রক্তমাংসের মানুষ। তাদের ঘাম আর পরিশ্রমে গড়ে উঠেছে এই নাগরিক সভ্যতা। মেহনতি মানুষের অধিকার আদায় ও তাদের সার্বিক কল্যাণে বর্তমান সরকারের সব জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি সফল বাস্তবায়ন হোক মহান মে দিবসে- এমন প্রত্যাশা সব শ্রমজীবী মানুষের।

লেখক : ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সহসভাপতি ও

বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close