ফয়জুন্নেসা মণি

  ০২ জানুয়ারি, ২০১৮

মুঠোফোন

অতিব্যবহারের পরিণতি

মুঠোফোন একটি উপকারী যন্ত্র, এতে কোনো সন্দেহ নেই। যোগাযোগ ও তথ্যানুসন্ধানে এ যুগের শ্রেষ্ঠ প্রযুক্তি বন্ধুটির নাম মুঠোফোন। তাই মানুষের দৈনন্দিন কাজে বহুলাংশে ব্যবহার বেড়েছে মুঠোফোনের। কিন্তু এটি যেহেতু একটি যন্ত্রচালিত প্রযুক্তিÑতাই সেই যন্ত্রের কিছু যন্ত্রণাও থাকবে স্বাভাবিক। মনে রাখতে হবে মুঠোফোনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কিন্তু অন্যসব আবিষ্কারের মতো এটারও ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক রয়েছে। আর মুঠোফোন আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর কীভাবে প্রভাব ফেলছে সেটা জানা জরুরি। আমরা দিনের লম্বা একটা সময় মুঠোফোন ব্যবহারের মধ্যে থাকি। জানা থাকা প্রয়োজন, মুঠোফোন ব্যবহার না করার সময়েও বেতারতরঙ্গ-প্রবাহ অব্যাহত থাকে। এই বেতারতরঙ্গ হয় দুই প্রকারের। ১. আয়োনাইজিং এবং ২. নন-আয়োনাইজিং। নন-আয়োনাইজিং অর্থাৎ আয়োনিত নয় এমন তরঙ্গ দুয়ের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী। মুঠোফোন ফোন থেকে এই তরঙ্গ নির্গমন হয়। এর অর্থ হলো, আমাদের মস্তিষ্কে এ তরঙ্গ প্রবাহিত হতে থাকে অবিরত।

চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন, মুঠোফোনের ব্যবহার বাড়তে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে তা বিরাট বিপর্যয় বয়ে আনবে। গবেষণায় দেখা যায়, সেলফোন বিকিরণ স্বাস্থ্যের ওপর বিভিন্ন প্রভাব ফেলে। যেমন : মাথাব্যথা, উচ্চরক্তচাপ, ব্রেইন টিউমার, ক্যানসার, আলজেইমারসহ নানা রোগ। জানা গেছে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে মুঠোফোন ব্যবহারকারী প্রায় ২০ কোটি ৮০ লাখ। সেলফোন ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক ড. জর্জ কার্লো বলেন, ২০১০ সালে সেলফোন ব্যবহারের ফলে সারা বিশ্বে পাঁচ লাখ ব্যবহারকারী মস্তিষ্ক ও কানের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছে। মার্কিন গবেষকরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, মুঠোফোন নিয়মিত পরিষ্কার না করায় এটি জীবাণুর অভয়ারণ্য। টয়লেট সিটের তুলনায় ১০ গুণ বেশি ব্যাকটেরিয়া থাকে মুঠোফোনে। তবে গবেষকরা বলেন, মুঠোফোনে ব্যাকটেরিয়াগুলো ব্যবহারকারীর জন্য খুব বেশি ক্ষতিকারক না হলেও এটি থেকে সংক্রমণ বা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে।

যুক্তরাজ্যের চক্ষুবিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে জানিয়েছেন, মুঠোফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারে দৃষ্টি বৈকল্য সৃষ্টি হতে পারে। তারা বলছেন, স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা সাধারণত চোখ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার দূরত্ব রেখে তা ব্যবহার করেন। তবে, অনেকের ক্ষেত্রে এ দূরত্ব মাত্র ১৮ সেন্টিমিটার। সংবাদপত্র, বই বা কোনো কিছু পড়ার ক্ষেত্রে সাধারণত চোখ থেকে গড়ে ৪০ সেন্টিমিটার দূরত্ব থাকে। চোখের খুব কাছে রেখে অতিরিক্ত সময় ধরে স্মার্টফোন ব্যবহার করলে জিনগত সমস্যা দেখা দিতে পারে। ক্ষীণদৃষ্টি সৃষ্টির জন্য যা ভূমিকা রাখতে সক্ষম। গবেষকরা দৈনিক কিছু সময় মুঠোফোন থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেন। যুক্তরাজ্যের এক্সেটর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা সাম্প্রতিক এক গবেষণার দাবি করা হয়েছেÑপ্যান্টের পকেটে মুঠোফোন রাখলে পুরুষের প্রজনন ক্ষমতার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। এক্সেটর বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োসায়েন্সের গবেষক ফিয়োনা ম্যাথিউসের নেতৃত্বে একদল গবেষক বিষয়টি খতিয়ে দেখতে এ-সংক্রান্ত ১০টি গবেষণার পর্যালোচনা এবং এক হাজার ৪৯২টি নমুনা পর্যবেক্ষণ করেছেন। গবেষণা-সংক্রান্ত নিবন্ধটি ‘এনভায়রনমেন্টাল ইন্টারন্যাশনাল’ সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষক ম্যাথিউস বলেছেন, সারা বিশ্বে প্রচুর মুঠোফোন ব্যবহৃত হচ্ছে। পরিবেশে এর উন্মুক্ত ব্যবহারে সম্ভাব্য ভূমিকাগুলো আরো পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত ‘ইন্টারফোন নামে একটি গবেষণায় বলা হয়, যারা দশ বছর ধরে দিনে আধঘণ্টার বেশি সেলফোন ব্যবহার করেছে, তাদের মারাত্মক মস্তিষ্ক টিউমারের সম্ভাবনা বেড়েছে। গবেষকরা বলেছেন, তারা যে গবেষণা করেছেন তাতে দেখা গেছে, মুঠোফোন থেকে নির্গত হওয়া রেডিও-ফ্রিকোয়েন্সি ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন শুক্রাণুর গুণগত মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

মুঠোফোনের অতিব্যবহারে আরো যেসব ক্ষতি হতে পারে তার মধ্যেÑ১. হেডফোন ব্যবহার করে উচ্চশব্দে গান শুনলে অন্তকর্ণের কোষগুলোর ওপর প্রভাব পড়ে এবং মস্তিষ্কে অস্বাভাবিক আচরণ করে। ২. একসময় বধির হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ৩. অতিরিক্ত সময় ধরে মেসেজ বা বার্তা টাইপ করা হলে আঙুলের জয়েন্টে ব্যথা হতে পারে। এর পরিণতি হিসেবে আর্থরাইটিসের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। ব্যস্ততার সময়ে কাঁধ ও কানের মধ্যে ফোন রেখে কথা বলা, অতিরিক্ত ঝুঁকে বসে দীর্ঘ সময় এসএমএস বার্তা লেখা ও পাঠাতে বসার ভঙ্গির কারণেও শরীরে নানা অসুবিধা দেখা দিতে পারে। ৪. গবেষকেদের দাবি, মুঠোফোন থেকে নির্গত ক্ষতিকর তরঙ্গ শুক্রাণুর ওপর প্রভাব ফেলে এবং শুক্রাণুর ঘনত্ব কমিয়ে দিতে পারে। গবেষকরা জানান, মুঠোফোন থেকে হাইফ্রিকোয়েন্সির ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক রেডিয়েশন নির্গত হয়। এই ক্ষতিকর তরঙ্গের সঙ্গে মস্তিষ্কে ক্যানসারের যোগসূত্র থাকতে পারে। এ ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে পুরুষের প্রজননতন্ত্রেরও। ৫. মুঠোফোনের আরেকটি ক্ষতিকর প্রভাব হলো মানসিক চাপ। মুঠোফোনের বদৌলতে ২৪ ঘণ্টাই আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগ রয়েছে। কাজেই নির্বিঘেœ একটু আরাম করার সুযোগ অনেকেরই মেলে না। ৬. সর্বদা মুঠোফোনের সঙ্গে থাকার কারণে মনোসংযোগে ঘাটতি সৃষ্টি করে। বিশ্বের অনেক দেশে গাড়ি চালানো অবস্থায় মুঠোফোনে কথা বলা নিষিদ্ধ করার এটা অন্যতম কারণ। গাড়ি চালানো অবস্থায় ফোনে কথা বললে শুধু নিজের জীবন নয় অন্যদের জীবনও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। ৭. মুঠোফোনে শ্রবণশক্তি হ্রাস করে। কানের ভেতরের পর্দা খুবই সংবেদনশীল। কাজেই দীর্ঘ সময় ধরে ফোনে যখন আমরা কথা বলি তখন কর্ণকুহরে অবিরাম প্রভাব পড়ে, যা কিনা আংশিক বধিরতা এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বধিরতার কারণ হতে পারে। মুঠোফোন ব্যবহার থেকে আমরা দূরে থাকতে পারব না। তবে মুঠোফোনের অতিমাত্রিক ব্যবহার থেকে বিরত থাকা নিজের জন্যই জরুরি নয়কি? তাই আসুন সবাই সুস্থ, সবল ও দীর্ঘ জীবনযাপনের স্বার্থে মুঠোফোনের পরিমিত ব্যবহার করার পক্ষে মত বিশেষজ্ঞদের।

লেখক : কবি ও শিক্ষিকা (ওয়ার্ল্ড সায়েন্স অবলম্বনে)

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist