কামরুজ্জামান কিরন, রাবি

  ৩১ মার্চ, ২০২৪

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করেই জোহা চত্বর, সেখান থেকে পূর্বদিকে কিছুদূর এগোলেই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণের পাশেই চোখে পড়ে চমৎকার স্থাপত্য ও নৈপুণ্যসমৃদ্ধ একটি ভবন। বলছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালার কথা। বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন মহান মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সব মুক্তিসংগ্রামের বিজয় এক দিনে অর্জন হয়নি, এর পেছনে রয়েছে অনেক অত্মত্যাগের ইতিহাস, কতশত প্রাণ বিসর্জনের ইতিহাস, হাজারো মা-বোনের সম্ভ্রম বিসর্জনের ইতিহাস, অভাগা মায়ের ছেলে হারানোর ইতিহাস ও মুক্তিযোদ্ধা বাবার যুদ্ধজয়ের ইতিহাস। স্বাধীনতার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অমূল্য সব সম্ভার নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় দেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক জাদুঘর ‘শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা’।

স্বাধীনতাযুদ্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের অসীম আত্মত্যাগকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৯৭৬ সালে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। পরে ১৯৯০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এটি স্থায়ী গ্যালারিতে পরিণত হয়। ৬,৬০০ বর্গফুট জায়গা নিয়ে এই সংগ্রহশালাটি তিনটি নান্দনিক গ্যালারিতে বিভক্ত। এখানে প্রবেশের জন্য কোনো টিকিট সংগ্রহ করতে হয় না। শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালায় দায়িত্বরত কিউরেটর ড. মো. সফিকুল ইসলাম জানান, এখানে প্রায় ৭৫০ থেকে ৮০০টি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নিদর্শন রয়েছে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানা ও গবেষণার জন্য অসংখ্য দলিল-দস্তাবেজে ভরপুর একটি লাইব্রেরি আছে। রয়েছে বঙ্গবন্ধু কর্নারও, যেখানে প্রায় ৪৫০০ বইপুস্তক ও দলিল-দস্তাবেজ রয়েছে।

জাদুঘরে ঘুরতে আসা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী রাকিব বলেন, এই সংগ্রহশালা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে, এত দিন যা বইয়ে পড়েছিলাম, এখানে তা নিজ চোখে দেখছি। আরেক দর্শনার্থী জানায়, বাংলাদেশের ইতিহাস সঠিকভাবে জানা ও তরুণ প্রজন্মকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে এই জাদুঘর ব্যাপক ভূমিকা পালন করে।

প্রথম গ্যালারিতে ৫৯টি আলোকচিত্র, ৬টি প্রতিকৃতি, ২টি কোলাজ, ৮টি শিল্পকর্ম, ১টি ভাস্কর্য, ১টি ডায়েরি ও অন্যান্য পান্ডুলিপি ৪টি। রয়েছে ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রথম শহীদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তৎকালীন প্রক্টর শামসুজ্জোহা স্যারের বিভিন্ন চিত্র। এ ছাড়া ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের চিত্র, ১৪৪ ধারাভঙ্গের প্রস্তুতি, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের মুখে পুলিশ বাহিনী এবং ১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি রাতে রাজশাহীতে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনারের বাঁধাই করা আলোকচিত্র। এ ছাড়া ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ‘ডাক বিভাগ’ কর্তৃক প্রকাশিত সব ডাক টিকিটের সংগ্রহ রয়েছে।

দ্বিতীয় গ্যালারিতে রয়েছে ১০৮টি আলোকচিত্র, ৩৫টি প্রতিকৃতি, ৯টি শিল্পকর্ম, ৩টি ভাস্কর্য, ৫টি ডায়েরি, পোশাক ও অন্যান্য বস্তু। মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরশ্রেষ্ঠ, বীরবিক্রম, বীর-উত্তম, বীর-প্রতীক ও সেক্টর কমান্ডারদের নামের তালিকা। এই গ্যালারিতে আরো রয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা নওরোজদ্দৌলা খানের ব্যবহৃত পোশাক এবং কীভাবে তাকে হত্যা ও দাফন করা হয়েছিল তার কিছু আলোকচিত্র। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ৩ জন শিক্ষককে হত্যা করা হয়েছিল, তার মধ্যে গণিত বিভাগের শিক্ষক শহীদ হবিবুর রহমানের ব্যবহৃত পোশাক এখানে সংরক্ষিত রয়েছে। এ ছাড়া শহীদ লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাহাঙ্গীরের ব্যবহৃত প্যান্ট-জ্যাকেট-টুপি এবং শিক্ষক সন্তোষ ভট্টাচার্যের ব্যাগ ও টাই সংরক্ষিত রয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা বিভাগের শিক্ষক কনক বাবুর তৈরি বঙ্গবন্ধুর একটি ভাস্কর্য রয়েছে এখানে।

তৃতীয় গ্যালারিতে ১১২টি আলোকচিত্র, ১১টি শিল্পকর্ম, ১টি প্রতিকৃতি, ৬টি ভাস্কর্য, ৪০টি ডায়েরি আছে। বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক কিছু ছবি রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে বাঙালির পাশে দাঁড়ানো সেই মমতাময়ী নারী ইন্দিরা গান্ধীর ছবি এখানে সংরক্ষিত আছে। ১৯৭২ সালের ৭ মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আসেন এবং শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন, সেই মুহূর্তের কিছু স্থিরচিত্র সংরক্ষিত আছে এখানে। ১৯৭১ সালে চিত্রশিল্পী কামরুল হাসানের আঁকা ইয়াহিয়া খানের বীভৎস ছবি এবং ‘রক্তাক্ত বাংলা’ সিনেমার কিছু ছবিও সংরক্ষিত আছে এখানে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাক বাহিনীর ব্যবহৃত হেলমেট ও গুলির বাক্স সংরক্ষিত আছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বধ্যভূমি রয়েছে, সেখানে যারা শহীদ হয়েছিল তাদের কিছু শরীরের হাড়, কঙ্কাল ইত্যাদি সংরক্ষিত আছে। এ ছাড়া তিনজন মহিলা বীর-প্রতীক তারামন বিবি, কাঁকন বিবি, সেতারা বেগম এবং একজন বিদেশি বীর-প্রতীক উইলিয়াম ওডারল্যান্ডের ছবি রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর কোলে ১৩ বছর বয়সি বাংলাদেশের সর্বকনিষ্ঠ বীর-প্রতীক শহিদুল ইসলাম লালু, সেই চিত্রটিও এখানে সংরক্ষিত আছে। রাজশাহীতে উত্তোলন করা প্রথম জাতীয় পতাকাটি এই সংগ্রহশালায় রাখা হয়েছে। এই আঁতুড়গরের প্রতিটি চিত্রকর্মই স্বাধীনতাযুদ্ধে আমাদের পূর্বপুরুষদের বীরত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু কর্নারে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখা প্রায় এক হাজার বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে। গবেষকরা বলছেন, যারা ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ ১৯৬৯-এর গণ অভ্যুত্থানসহ বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করতে চান, তাদের কাছে এটি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা পাঠাগার। প্রতি বছর এমফিল ও পিএইচডি গবেষকরা গবেষণাকালে এই পাঠাগাটি ব্যবহার করেন। সংগ্রহশালাটি সবার জন্য উন্মুক্ত। শুক্র ও শনিবার ছাড়া অন্যান্য দিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সংগ্রহশালাটি খোলা থাকে। সংগ্রহশালাটিতে প্রতিদিন দেশ ও দেশের বাইরের অনেক দর্শনার্থী ভিড় জমায়। জাতীয় দিবসগুলোতে দর্শনার্থীদের ভিড় কয়েক গুণ বেড়ে যায়। সংগ্রহশালাটির গ্যালারিতে প্রবেশ করলেই কৌতূহল আরো বেরে যায় এবং জীবন্ত হয়ে চোখে ভেসে উঠবে রক্তে কেনা বাংলাদেশের প্রতিটি সময়। এটি নতুন প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাতিঘর। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল অর্জন সম্পর্কে তরুণ প্রজন্মকে অবহিত করতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালাটি’ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close