প্রতিদিনের সংবাদ ডেস্ক
সালমান শাহর মৃত্যু
কী ঘটেছিল সেদিন
বাংলা চলচ্চিত্র জগতের জনপ্রিয় নায়ক শাহরিয়ার চৌধুরী ইমনের মৃত্যুর ২১ বছর পর ফের সামনে চলে এসেছে ঘটনাটি। তার রূপালী পর্দার নাম ছিল সালমান শাহ। তার মৃত্যু নিয়ে কথা বলেছেন সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী। এ নিয়ে বিবিসি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে নীলা চৌধুরী বর্ণনা করেছেন, ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর দিনটি ছিল শুক্রবার। সেদিন সকাল সাতটায় বাবা কমর উদ্দিন চৌধুরী ছেলে শাহরিয়ার চৌধুরী ইমনের সঙ্গে দেখা করতে রাজধানীর ইস্কাটনের বাসায় যান। কিন্তু ছেলের সঙ্গে দেখা করতে না পেরে তিনি ফিরে আসেন। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে নীলা চৌধুরী বলেন, বাসার নিচে দারোয়ান সালমান শাহর বাবাকে তার ছেলের বাসায় যেতে দিচ্ছিল না। নীলা চৌধুরীর বর্ণনা ছিল এরকম- দারোয়ানরা বলেছে, ‘স্যার এখন তো ওপরে যেতে পারবেন না। কিছু প্রবলেম আছে। আগে ম্যাডামকে (সালমান শাহর স্ত্রীকে) জিজ্ঞেস করতে হবে।’ এক পর্যায়ে উনি (সালমান শাহর বাবা) জোর করে ওপরে যান। কলিং বেল দেওয়ার পর দরজা খুলল সামিরা (সালমান শাহর স্ত্রী)। উনি (সালমান শাহর বাবা ) সামিরাকে বললেন, ‘ইমনের সঙ্গে কাজ আছে, ইনকাম ট্যাক্সের সই করাতে হবে। ওকে ডাকো। তখন সামিরা বলল, আব্বা ও তো ঘুমে। তখন উনি বললেন, ঠিক আছে আমি বেডরুমে গিয়ে সই করিয়ে আনি। কিন্তু যেতে দেয় নাই। আমার হাজব্যান্ড প্রায় ঘণ্টা দেড়েক বসে ছিল ওখানে।’
বেলা ১১টার দিকে একটি ফোন আসে সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরীর বাসায়। ওই টেলিফোনে বলা হলো, সালমান শাহকে দেখতে হলে তখনই যেতে হবে। টেলিফোন পেয়ে নীলা চৌধুরী দ্রুত ছেলে সালমান শাহর বাসার দিকে রওনা হন। তবে সালমানের ইস্কাটনের বাসায় গিয়ে ছেলে সালমানকে বিছানার ওপর দেখতে পান নীলা চৌধুরী। খাটের মধ্যে যেদিকে মাথা দেওয়ার কথা সেদিকে পা। আর যেদিকে পা দেওয়ার কথা সেদিকে মাথা। পাশেই সামিরার এক আত্মীয়ের একটি পার্লার ছিল। সে পার্লারের কিছু মেয়ে ইমনের হাতে-পায়ে সর্ষের তেল দিচ্ছে। আমি তো ভাবছি ফিট হয়ে গেছে। আমি দেখলাম আমার ছেলের হাতে পায়ের নখগুলো নীল। তখন আমি আমার হাজব্যান্ডকে বলেছি, আমার ছেলে তো মরে যাচ্ছে, বিবিসিকে বলছিলেন নীলা চৌধুরী।
ইস্কাটনের বাসা থেকে সালমান শাহকে হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানকার ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এরপর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে ময়না তদন্ত শেষে বলা হয় সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছে।
তার পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, সালমান শাহকে হত্যা করা হয়েছে। নীলা চৌধুরীর অভিযোগ ছিল, তারা হত্যা মামলা করতে গেলে পুলিশ সেটিকে অপমৃত্যুর মামলা হিসেবে নথিভুক্ত করে। পুলিশ বলেছিল, অপমৃত্যুর মামলা তদন্তের সময় যদি বেরিয়ে আসে যে এটি হত্যাকা-, তাহলে সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে হত্যা মামলায় মোড় নেবে।
সালমান শাহর আকস্মিক মৃত্যুতে স্তম্ভিত হয়ে যায় পুরো দেশ। তার মৃত্যুর পর বেশ কয়েকজন তরুণী আত্মহত্যা করেন বলেও খবর আসে পত্রিকায়।
সালমানের মৃত্যু নিয়ে ভক্তদের মাঝে তৈরি হয় নানা প্রশ্নের। তখন পরিবারের দাবির মুখে দ্বিতীয়বারের মতো ময়না তদন্ত করা হয়। মৃত্যুর আট দিন পরে সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজে তিন সদস্য বিশিষ্ট মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়। সে বোর্ডের প্রধান ছিলেন ডা. নার্গিস বাহার চৌধুরী। তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, ‘লাশটা আমি দেখেছি মরচুয়েরিতে। আমার কাছে মনে হয়েছে যেন সদ্য সে মারা গেছে। এ রকম থাকলে তার মৃত্যুর কারণ যথাযথভাবে নির্ণয় করা যায়। আত্মহত্যার প্রত্যেকটা সাইন (চিহ্ন) সেখানে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে ছিল। তার শরীরে আঘাতের কোনো নিশানা ছিল না।’ দ্বিতীয় ময়না তদন্তে আত্মহত্যার বিষয়টি নিশ্চিত করা হলে মামলার কাজ সেখানেই থেমে যায়।
সালমান শাহর পারিবারিক বন্ধু চলচ্চিত্র পরিচালক শাহ আলম কিরণ বলছিলেন, মানসিক চাপে ছিলেন সালমান শাহ। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়ন এবং প্রযোজকদের সঙ্গে বোঝাপড়ার ঘাটতি তৈরি হয়েছিল। সালমান শাহর মৃত্যুর সংবাদ দর্শকদের মনে এতটাই দাগ কেটেছিল যে এত বছর পরেও অনেকে তার প্রিয় নায়ককে ভুলতে পারেননি। মৃত্যুর দুই দশকের বেশি পরেও তাকে নিয়ে দর্শকদের মাঝে আলোচনা থামেনি।
চলচ্চিত্র বিশ্লেষক এবং বেসরকারি ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক জাকির হোসেন রাজু বলেন, সালমান শাহ যে সময়টিতে অভিনয়ে এসেছিলেন, তখন ছিল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে পালাবদলের সময়। পর্দায় তার পোশাক-পরিচ্ছদ, সংলাপ বলার ধরন, অভিনয়-দক্ষতা- সবকিছু মিলিয়ে দর্শকের মনে স্থান করে নিতে সময় লাগেনি এ নায়কের।
পরিচালক শাহ আলম কিরণ বলেন, ‘ও যাই করত, সেটাই ভালো লেগে যেত। অল্প সময়ের মধ্যে এ ছেলেটা চলচ্চিত্রামোদীদের মনে জায়গা করে নিয়েছিল।’ মাত্র চার বছরে ২৭টি সিনেমায় অভিনয় করেন। এর বেশিরভাগই ছিল আলোচিত এবং ব্যবসা সফল।
চলচ্চিত্র বিশ্লেষক জাকির হোসেন রাজু বলেন, নায়ক রাজ্জাক, আলমগীর এবং ফারুকের পর সে সময় নতুন একদল তরুণ অভিনেতার আবির্ভাব হয়েছিল ঢাকার সিনেমা জগতে। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে যত নায়কের আবির্ভাব ঘটেছিল তাদের মধ্যে সালমান শাহ সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিশীল ছিলেন। সালমান শাহর অভিনয়ের মধ্যে দর্শক একটা ভিন্নধারা খুঁজে পেয়েছিল। অনেকে আবার সালমান শাহর মধ্যে বলিউড নায়কদের ছায়াও খুঁজে পেয়েছিলেন। এখনো প্রতি বছর সালমান শাহর মৃত্যু দিবসে তার অনেক ভক্ত তাকে স্মরণ করেন ভালোবাসার সঙ্গে। আর সালমানের অনেক ভক্তের কাছে তার মৃত্যু এখনো একটি বড় রহস্য হিসেবেই রয়ে গেছে।
"