মো. শাহ আলম, খুলনা

  ০৩ মে, ২০২৪

খুলনা অঞ্চলে ঝুঁকিতে কৃষি ও মৎস্য

খুলনা অঞ্চলে দিন দিন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবগুলো স্পষ্ট হচ্ছে। ঝুঁকিতে পড়েছে কৃষি ও মৎস্য খাত। গত ১৪ বছরে খুলনাসহ আশপাশ এলাকার তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০১১ সালে এখানকার বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ছিল ৩১.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর চলতি বছরেই সেই তাপমাত্রা ছাড়াল রেকর্ড ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। আবহাওয়া দপ্তরের ১৪ বছরের তথ্য বিশ্লেষণে এ তথ্য উঠে এসেছে। উচ্চ তাপমাত্রায় হুমকির মুখে থাকা কৃষি ও মৎস্য উৎপাদন নিয়ে সচেতন হওয়া এবং কার্যকর উদ্যোগ জরুরি।

খুলনা আবহাওয়া দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, ২০১১ সালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল মে মাসে ৩৪.৮ সেলসিয়াস, ২০১২ সালে ৩৬.৭, ২০১৩ সালে ৩৩.৯, ২০১৪ সালে ৩৬.৮, ২০১৫ সালে ৩৬ ডিগ্রি, ২০১৬ সালে ৩৬.৩, ২০১৭ সালে ৩৫.৯, ২০১৮ সালে ৩৩.৮, ২০১৯ সালে ৩৬.২, ২০২০ সালে ৩৪.৪, ২০২১ সালে ৩৬.৪, ২০২২ সালে ৩৫.২ এবং ২০২৩ সালে ৩৬.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চলতি বছর ২০ এপ্রিল বিগত বছরের তাপমাত্রা ছাপিয়ে রেকর্ড ৪১.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস স্পর্শ করে, যা ১৪ বছরের রেকর্ড। কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্যে বলা হয়, সাধারণত ধান চাষের ক্ষেত্রে ১৮ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রয়োজন। কিন্তু এর বেশি তাপমাত্রায় ধান উৎপাদন ব্যাহত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে গড় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়াচ্ছে। এতে ধানের পরাগায়ন বাধাগ্রস্ত ও উৎপাদন কম হয়। আবার উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষিজমির মাটির লবণাক্ততা বাড়ছে। তাপমাত্রার সঙ্গে লবণাক্ততায় ফসলের উৎপাদনক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। অনেক কৃষিজমি পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। কৃষিজমির লবণাক্ততা যদি বাড়তে থাকে, তাহলে কৃষি আয় বছরে ২১ শতাংশ কমে যাবে। উপকূলীয় অঞ্চলের ৪০ শতাংশ কৃষিজমি হুমকির মুখে পড়বে। এতে এ অঞ্চলের ২ লাখ ৪০ হাজার কৃষকের বাস্তুচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ধান ছাড়া অন্যান্য শস্য; যেমন পাট, গম, ভুট্টা, মটর, ছোলা উৎপাদনও ব্যাপকভাবে হ্রাস পাচ্ছে।

কৃষি তথ্য আরো বলছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর বিভিন্ন পরিবর্তনের ফলে মৎস্য উৎপাদন মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে। তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে পানি গরম হয়ে পানিতে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। এতে মাছের পোনা উৎপাদন অনেকাংশে হ্রাস পায়। এর ফলে মৎস্য খাত থেকে আয় কমে যাচ্ছে। খুলনার ডুমুরিয়া টিপনা গ্রামের কৃষক মঞ্জুুর রহমান বলেন, গরম বেশি হওয়ায জমিতে সেচসহ বিভিন্ন সংকট মোকাবিলা করতে হয়। চলতি বছরে ব্রি-১০৫ চাষ করায় সফল হয়েছি। কিন্তু তাপপ্রবাহ বেশি থাকায় কৃষি শ্রমিকের কাজের সময় কমছে। আগে তারা বিকেল ৩টা পর্যন্ত মাঠে কাজ করলেও এখন কেউ বেলা ১১টার বেশি সময় কাজ করতে চান না।

খুলনার কয়রা উপজেলার কৃষক শাহজাহান সিরাজ ও পাইকগাছার মাতম গ্রামের সেলিম সরদার জানান, গরম, লবণাক্ততা ও পানি সংকট চরম আকার ধারণ করছে। সব কাজে খরচ বাড়ছে। তারা তাদের জমি-ফসলের ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার গৌরম্ভা ইউনিয়নের আদাঘাট গ্রামের কৃষক এস্কেন্দার শেখ বলেন, বৃষ্টি নেই। খরতাপে ক্ষেত-খামার শুকিয়ে চৌচির। জমিতে সেচ দেওয়ার ব্যবস্থা নেই। উৎপাদিত ফসল এখন পানির অভাবে মরতে বসেছে। একই গ্রামের ঘের ব্যবসায়ী মো. আবু বকর ও ইকরাম শেখ বলেন, ঘেরের পানি শুকিয়ে চিংড়িতে ভাইরাস আক্রমণ শুরু করেছে। ফলে অপরিপক্ব চিংড়ি ধরতে হচ্ছে। লাভ তো দূরের কথা, এতে বিনিয়োগই উঠবে কি না, সংশয় দেখা দিয়েছে।

শরণখোলা উপজেলার দীপচর গ্রামের চাষি মনির সওদাগর জানান, সারা বছরই তাদের গ্রামে ফসলের চাষ হয়। চলতি বছরও প্রায় ৩০ বিঘা জমিতে পুঁইশাক, পাট, ঢ্যাঁড়শ, কলমিসহ নানা জাতের শাকসবজির চাষ হয়েছে। পানির অভাবে সব বিবর্ণ হয়ে গেছে। গ্রামের সব ডোবা-নালা, পুকুর, খাল শুকিয়ে যাওয়ায় পার্শ্ববর্তী খাল থেকে স্যালো মেশিনের মাধ্যমে সেচ দিয়ে ফসল টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। ঘণ্টায় ৩০০ টাকা করে বিঘায় দেড় হাজার টাকা থেকে প্রায় ২ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। তার গ্রামের ৫০ জন চাষি ক্ষতির মুখে পড়েছেন। উপজেলার পূর্ব রাজৈর গ্রামের চাষি মো. দুলু তালুকদার ও রুবেল ফরাজী তাদের দুরবস্থার কথা তুলে ধরে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। সাতক্ষীরার কৈখালী ইউনিয়নের বৈশখালী এলাকার নুরুল হক গাজী বলেন, তীব্র তাপপ্রবাহে এলাকার সব পুকুরের পানি শুকিয়ে গেছে। নলকূপের পানিও লোনা। একই জেলার গাবুরা ইউনিয়নের ডুমুরিয়া গ্রামের সাইফুল ইসলাম, আবদুল কাদের ও রুহুল আমিন জানান, বছরজুড়ে তাদের ক্ষতির শেষ নেই। ফসল, মাছের উৎপাদন দিন দিন কমছে।

এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি, আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ, ক্ষয়ক্ষতি প্রাপ্তিতে সচেতনতা ও নীতিমালা তৈরিতে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের বিভিন্ন উপজেলায় কাজ শুরু হয়েছে। ক্লাইমেট অ্যান্ড ডিজেস্টার রিস্ক ফিন্যান্স অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স (সিডিআরএফআই) নামের প্রকল্পটির সমন্বয়কারী হেলেনা খাতুন বলেন, প্রকল্পটির মাধ্যমে স্থানীয় সুশীল সমাজ; বিশেষ করে নারী ও বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীকে সরাসরি প্রকল্পটিতে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে। খুলনা-৬ (কয়রা-পাইকগাছা) আসনের সংসদ সদস্য মো. রশীদুজ্জামান বলেন, খুলনার কয়রা-পাইকগাছা মূলত উপকূলীয় এলাকা। গত তিন-চার দশকে এ অঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও দুর্যোগে মানুষের কর্মসংস্থান কমে গেছে। প্রায় ৮০ শতাংশ কর্মজীবী মানুষ কাজের জন্য এলাকা ছেড়েছে। তবে মানুষ এখন কৃষিতে ফিরতে চায়। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলা করে আবারও গোটা এলাকায় সবুজ ফসল উৎপাদন ও বাস্তুচ্যুত মানুষকে এলাকায় ফেরানোর চেষ্টা চলছে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close