নিজস্ব প্রতিবেদক

  ০৮ মার্চ, ২০১৮

ভাষণের ভিডিও সংরক্ষণের গল্প

নির্ঘাত মৃত্যু জেনেও ঝুঁকিটা নিয়েছিলেন আমজাদ

‘আমরা জানতাম, ধরা পড়লে নির্ঘাত মৃত্যু, তবু ঝুঁকিটা নিয়েছিলাম। কারণ বঙ্গবন্ধুকে আমরা ভালোবাসতাম। আর তিনিও আমাকে অনেক স্নেহ করতেন,ভালোবাসতেন।’ কথাগুলো বলছিলেন আমজাদ আলী খন্দকার, যিনি ওই সময় ছিলেন চলচ্চিত্র বিভাগের ক্যামেরা সহকারী। পাকিস্তানি সেনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সচিবালয় থেকে ঢাকার দোহারে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের টেপগুলো নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বয়ে নেওয়া বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ভিডিও ধারণ হয়েছিল পাকিস্তান সরকারের ক্যামেরায়, অনেকের চোখ ফাঁকি দিয়ে তা ডেভেলপ করার পর জীবন ঝুঁকি নিয়ে রক্ষা করা হয় পাকিস্তানি হানাদের থাবা থেকে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতরে কর্মরত কয়েকজন মুক্তিকামী বাঙালির বীরত্বে রক্ষা পেয়েছিল বাঙালির ইতিহাসের এই অমূল্য সম্পদ। ভাষণের মাসখানেকের মাথায় সেটা সচিবালয় থেকে লুকিয়ে নেওয়া হয়েছিল দোহারে একটি বাড়িতে। সেখানে ধানের গোলাতে মাসখানেক রাখার পর নিয়ে যাওয়া হয় ভারতে। নয় মাসের যুদ্ধ জয়ের পর ভিডিও টেপটিও ফিরে আসে নতুন বাংলাদেশে।

বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণের ৪৭তম বার্ষিকীতে এর ভিডিও ধারণ এবং সংরক্ষণ করার গল্প শুনিয়েছেন আমজাদ আলী। ডিএফপির ক্যামেরা সহকারী থেকে ক্যামেরাম্যান হয়ে ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে যোগ দেন তিনি। ২০০৪ সালে বিটিভির কন্ট্রোলার চিফ ক্যামেরাম্যান হিসেবে অবসরে যান। কর্মজীবনে বেশ কয়েকবার আহত হওয়া আমজাদের শরীরের বাঁ দিকের অংশ আট বছর ধরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার রেসকোর্স মাঠে স্বাধীনতার ডাক দিয়ে ভাষণ দেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯ মিনিটের সেই ভাষণে বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উত্তাল জনসমুদ্র যখন স্বাধীনতার ঘোষণা শুনতে উদগ্রীব; তখন বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেন তার চূড়ান্ত নির্দেশনাÑ‘তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব; এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’

সেই ভাষণকে গত বছর ‘বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য’ হিসেবে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টারে’ যুক্ত করেছে ইউনেসকো।

আমজাদ আলী খন্দকার জানান, ১৯৬৯ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ড গোপনে ধারণ করে সংরক্ষণ করতেন চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতরের বাঙালি কর্মীরা।

এরই ধারাবাহিকতায় অসহযোগ আন্দোলনের উত্তাল সময়ে আসা ৭ মার্চের ভাষণ রেকর্ড সংরক্ষণের আয়োজন সম্পন্ন করেন তারা। সে সময় চলচ্চিত্র বিভাগের পরিচালক মহিবুর রহমান খানের (অভিনেতা আবুল খায়ের নামেই বেশি পরিচিত) নির্দেশে আমজাদরা ভাষণের ভিডি ধারণ ও সংরক্ষণের এ কাজ করেন। জনসমুদ্রে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে ভিডিওচিত্র ধারণের কাজ করেন চলচ্চিত্র বিভাগের কর্মীরা। এক ভাগে দায়িত্ব মূল ভাষণ আর অন্য ভাগ ধারণ করে সেখানকার সার্বিক পরিবেশ। এই দুই দলে ছিলেন ক্যামেরাম্যান জেড এম এ মবিন, ক্যামেরাম্যান এম এ রউফ, ক্যামেরা সহকারী আমজাদ আলী খন্দকার, ক্যামেরা সহকারী এস এম তৌহিদ, ক্যামেরা সহকারী সৈয়দ মইনুল আহসান, ক্যামেরা সহকারী জোনায়েদ আলী ও এম এল এস এস খলিলুর রহমান।

ভাষণ রেকর্ডের পর সেটা সংরক্ষণে উদ্যোগী হন মহিবুর রহমান খার কর্মীরা। পাকিস্তানিদের চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হচ্ছিল তাদের।

আমজাদ আলী বলেন, ফিল্ম ডেভেলপ করতে গিয়ে ধরা পড়তে পারেন সেই শঙ্কায় ট্যাগ লাইনে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সংশ্লিষ্ট কিছু না লিখে কৌশল নিলাম। সেখানে লেখা হলো ‘সাইক্লোন’; যাতে অন্যরা মনে করে, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় সংশ্লিষ্ট ফিল্ম এগুলো। ২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউনের পর বিভিন্ন অফিস-আদালতের দায়িত্ব নেওয়া শুরু করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। সে কারণে কীভাবে এগুলো সচিবালয়ের আর্কাইভ থেকে সরানো যায়, সেই পরিকল্পনা করলেন বিভাগের প্রধান মহিবুর রহমান। তিনি নিজে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, কাজী নজরুল ইসলামের ওপর করা ডকুমেনটারি ফিল্ম ও বঙ্গবন্ধুর আরো ছবি ফিল্ম ঢুকিয়ে দেন। রেকর্ড নিয়ে পালানোর পরিকল্পনা বুঝিয়ে দেন। সচিবালয়ে ঢোকার ফটক ‘সেকেন্ড গেট’ দিয়ে বেরোনোর পরিকল্পনা করা হয়। ওই ফটকের দায়িত্বে থাকা বাঙালি পুলিশ সার্জেন্ট ফরিদও ছিলেন সেই পরিকল্পনায়। বেবিট্যাক্সিতে করে বড় আকারের ট্রাংক নিয়ে রওনা হন আমজাদ। সংকেত পেয়ে ফটক খুলে দেন ফরিদ।

দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল। সচিবালয়ের টিনশেড থেকে ট্রাংক নিয়ে বের হয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সেনাবাহিনীর সতর্ক প্রহরায় কিছুটা স্বতন্ত্র হলেও লক্ষ্যে এগিয়ে যাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের পাশ ধরে চাঁনখারপুল থেকে চকবাজার হয়ে সোয়ারীঘাটে পৌঁছায়। পরে নৌকায় সোয়ারীঘাট থেকে জিনজিরা গেলাম। সেখানে দেখি, একটা বাস ছাইড়া যাইতেছে। ট্রাংকটি বাসের ওপরে উঠায়া দিলাম।

নবাবগঞ্জের বক্সনগরে এসে হাঁটাপথ কিংবা ঘোড়া। আমরা হেঁটে চলে গেলাম। জয়পাড়ায় মজিদ দারোগার বাড়িতে। ওইখানে গিয়ে তাদের বাড়িতে ওটা রাখলাম। ওই সময়ে মহিবুর রহমানও পৌঁছে যান সেই এলাকায়। ওইখানে দুজনের বাড়ি আছে, হাজি দানেশ ও উমেদ খাঁ দুই ভাই। ওই বাড়িতে উমেদ খাঁর ধানের গোলার ভেতরে লুকায় রাখা হয়। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় ট্রাংকটি ভারতে নিয়ে যান মহিবুর রহমান। বিজয়ের পরপরই দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। সাদা-কালো ওই ভিডিও ভাষণ ২০১৬ সালে রঙিন সংস্করণে রূপান্তরিত করা হয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist