ইভান অনিরুদ্ধ
গল্প
করোনাকালে বিয়ে
গ্রামের মানুষের এখন অফুরন্ত অবসর, ধান কাটা শেষ। বাড়ি বাড়ি বিয়ের ধুম লেগেছে, কারো ছেলে বিয়ে করছে, কেউ মেয়ে বিয়ে দিচ্ছে। করোনা কোনো সমস্যা নয় তাদের কাছে। বরং বর্ষাকালটাই তাদের কাছে বিয়ের জন্য জুতসই।
মালয়েশিয়াফেরত কাজলের বিয়ে। সকাল থেকেই বাড়ির সামনের সড়কে বারো সিটের একটা মাইক্রো আর একটা সিএনজি দাঁড়ানো। অনেক দূরের পথ, ময়মনসিংহের ধোবাউড়ায় যাবে সে বরযাত্রী হিসেবে।
আমার বিশেষ কোনো কাজ নেই। বাড়ির সামনে সড়কের পাশে আমগাছের নিচে এসে দাঁড়িয়ে আছি। দেখছি, কাজলের বিয়ের লোকজনের আনাগোনা, শুনছি এর-তার বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা। কিছুক্ষণ পর, ছোট ভাতের পাতিলের মুখে বড় সাইজের ঢাকনা দিলে যেরকম বেখাপ্পা লাগে, তেমনি নিজের মুখের চেয়েও বড় সাইজের সানগ্লাস চোখে পরে কাজল আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। তাকে বেঢপ দেখায়।
বাইজান, অছম্বিত বিয়ার আয়োজনডা কইরালছি। ছেড়ির মা বিরাট অসুস্থ, এই বালা, এই বুরা।
আচ্ছা। তবে করোনার ভেতর বিয়েশাদি করাটা এক অর্থে বিরাট অন্যায়। এ সময় সবার ঘরে থাকা উচিত।
বাইজান, বুঝি বেকতাই। কিন্তু বিয়াডা না কইরাও উফায় নাই। কয়েক দিন বাদে হাতে টেহা-ফইসা থাকত না। এই কারণেই অত তরস্ত অইয়া কামডা কইরালছি।
হুম!
আফনে তো আর আমার সঙ্গে যাইতাইন না, তাই অহন আমরার বাড়িত যাইবান। দুইলা ডাইল-বাত কাইবাইন গুস্তের ছালুন দিয়া।
খাব, তবে এখন না।
না, বাইজান, আফনে না করবাইন না। আফনে দুইলা বাত না কাইলে আমার মন ডা ছনোবনো করব।
হাহাহা। বললাম তো অন্য একদিন খাবো। দোয়া করি তুমি ভালোভাবে গিয়ে ভালোভাবে ফিরে এসো।
বাইজান, ছেড়ির চেহারা-ছবি কিন্তু মাশাল্লা। আগে গার্মেনছে চাকরি করত। আমি তারে কইছি, বিয়ার ফরে আর চাকরি করন যাইত না। আমি নিজে দুই হাতে কামাইতাছি, আমি বেডির কামাই ক্যারে কাইতাম?
তারপরও সংসারে দুজন আয়-রোজগার করলে ভালো থাকা যায়, অভাব-অনটন থাকে না।
না বাইজান। অতো তা বালা না। ঘরের বাইর করলেই বেইট্টানের মতিগতি ডাইনে-বাঁয়ে যাইবো গা। বাদে অইবো আরেক কেরেংকাল।
আমি বাইজান এই খেলানেলা চাই না।
হাসান ভাই, বিয়ের মিষ্টি এনেছি। আপনার হাতে সবাইকে মিষ্টিমুখ করান। একান্ত ঘরোয়া পরিবেশে দ্বিতীয় বিয়েটা করে ফেললাম। অথচ আপনি তো এখনো একটাও করতে পারলেন না
দুই.
করোনার মধ্যেও মিজান সাহেব বিয়ে করেছেন। এটা তার দ্বিতীয় বিয়ে। অফিসে দুই কেজি লাল জিলাপি আর এক কেজি কালোজাম নিয়ে এসেছেন। আমার পাশের ডেস্কেই বসেন। এই কারণে আমার সঙ্গে খাতিরও অন্যদের চেয়ে বেশি। টি-ব্রেকের সময় আমার টেবিলে চেয়ার টেনে বসলেন।
হাসান ভাই, আপনাদের জন্য বিয়ের মিষ্টি এনেছি। আপনার হাতে সবাইকে মিষ্টিমুখ করান। একান্ত ঘরোয়া পরিবেশে দ্বিতীয় বিয়েটা করে ফেললাম। অথচ আপনি তো এখনো একটাও করতে পারলেন না।
এই করোনায় বিয়ে! আপনি কি কোনো দিন মানুষ হবেন না মিজান ভাই?
কী যে বলেন! করোনার কারণে কি জীবন থেমে থাকবে? জীবনের চাহিদা বন্ধ থাকবে? তা ছাড়া এই বয়সে মেসের বুয়ার হাতে খাবার খেতে আর ভালো লাগে না। তাই বিয়ে করে নতুন বউ নিয়ে মগবাজারে এক ফ্যামিলির সঙ্গে সাবলেট উঠেছি।
নতুন ভাবিকে নিয়ে হানিমুনে যাবেন না? সীমিত আকারে তো যোগাযোগ ব্যবস্থা চালুই আছে। কক্সবাজার থেকে ঘুরে আসুন।
ধুর মিয়া, বুড়া বয়সে হানিমুন! চার ঠ্যাং এক করে শুয়ে থাকব। গরিবের আবার কীসের হানিমুন। হাহাহা।
মিজান সাহেব সিগারেট খাওয়ার জন্য আমার সামনে থেকে উঠে বারান্দায় যান। দশ মিনিট পর আবার আমার টেবিলে ফেরত আসেন। ফিসফিস করে বলেন—
আপনার জন্য ফাস্ট ক্লাস মেয়ে দেখেছি। আপনার ভাবির খালাতো বোন। অল্প বয়স, সুন্দরী। আপনার সঙ্গে ম্যাচিং হবে দারুণ!
ছবি আছে মোবাইলে?
ছবি নাই। আগে নিয়ত ঠিক করেন। আমার বাসায় মেয়েকে দেখাবো। ফাস্ট ক্লাস মেয়ে। মেয়ের বাড়ি নেত্রকোনা।
আমি মুখে কিছু বলি না, কেবল তার দিকে তাকিয়ে হাসি। সব অফিসেই একজন-দুজন মানুষ থাকে, যাদের কথা অন্য কলিগরা শোনে কিন্তু গুরুত্ব দেয় না। মিজান সাহেব এরকমই একজন কলিগ!
তিন.
মিজান সাহেবকে আজকাল মারাত্মক অসহ্য লাগে। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয়, আড়ালে ডেকে নিয়ে অশ্লীল ভাষায় আবক্তা করি। আবক্তা মানে খুব খারাপ গালাগাল! আমরা যারা নেত্রকোনার মানুষ তারা হরেক কিসিমের আবক্তায় দারুণ অভিজ্ঞ। অফিসের কলিগ, পাশাপাশি বসে কাজ করি ঠিক এই কারণে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারি না। মাঝবয়সি এই লোকটাকে কেন এত অপছন্দ করি আজকাল? কারণ আছে। কারণ ছাড়া তো গাছের পাতাও নড়ে না আজকাল।
প্রতিদিন লাঞ্চের পর একটা ম্যাচের কাঠি দিয়ে বিশ্রী ভঙ্গিতে দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে মিজান সাহেব আমার কাছে চেয়ার টেনে বসবে। যদি বলি করোনাকালে একটু স্বাস্থ্যবিধি মেনে বসুন, তাতে আরো ঝুঁকে বসে আমার দিকে! আমি যে বিরক্ত হচ্ছি তাকে দেখে, এটা তার মাথায় ঢুকে না। আর মাথায় ঢুকলেই বা কী! শালার মাথায় ‘গু’ ছাড়া তো কিছু নাই। গোবর থাকলে না হয় কিছু কাজ হতো! টেবিলের পায়ার নিচে একদলা থুতু ফেলে মিজান সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে মিচকা শয়তানের মতো হাসেন।
শফিক ভাই, খেলা তো ভালোই খেলতাছেন!
মানে? কীসের খেলা?
আমগো অফিসের ডাইরেক্টর ম্যাডামের সঙ্গে এক গাড়িতে আসা-যাওয়া করেন, কারণে-অকারণে তার রুমে গিয়া রঙ্গরস করেন।
আপনি কি কখনো ভদ্র হবেন না ভাই? এই বয়সেও এসব কুচিন্তা না করলে কি আপনার ভালো লাগে না? এর মধ্যে বিয়ে তো ঠিকই দুইটা করে ফেলেছেন!
হাহাহা। বডি ডিমান্ড। তা আপ্নে রাগ করেন ক্যা? আপ্নেও ইয়াং, ম্যাডামও ইয়াং। ইয়াং হলেই ভালা। আমার নতুন বউও বেশ ইয়াং!
চুপ করেন। আপনি একটা চরম ফাউল আর ইতর।
মিজান সাহেব যেন আমার কথায় মজা পেল! নির্লজ্জের মতো একটা হাসি দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল যাই, আমার টেবিলে ম্যালা ফাইল জইম্যা গেছে। আইজকার ভিত্রে শেষ করতে অইবো। আপ্নের তো রাজকপাল, কামকাজ না করলেও চাকরি যাইব না। দেরি না কইরা ম্যাডামরে বিয়া কইরা ফালান!
আমি বিরক্তির চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেছি! কত মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে, এই মিজানকে কি করোনা দেখে না?
পিডিএসও/হেলাল