জুবায়ের চৌধুরী

  ১৭ আগস্ট, ২০১৭

এক যুগেও শেষ হয়নি বিচার

দেশব্যাপী সিরিজ বোমা হামলার এক যুগ পূর্ণ হচ্ছে আজ। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলায় একযোগে সিরিজ বোমা হামলা চালিয়ে নিজেদের শক্তির জানান দিয়েছিল জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)। ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া ১৬১ মামলার তদন্ত কাজ শেষ হয়েছে অনেকে আগেই। কিন্তু অনেক মামলার বিচারকাজ আদালতে থেমে আছে। এক যুগ পরেও শেষ হচ্ছে না বিচার।

এদিকে, গত বছরের ১ জুলাই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জঙ্গি হামলা হয় গুলশানের হলি আর্টিজানে। এক সপ্তাহের মাথায় ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় ঈদের জামাত চলাকালে প্রকাশ্যে জঙ্গিরা হামলা চালায়। নব্য জেএমবির পরপর দুটি হামলার পর নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একের পর এক অভিযানে নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের কমপক্ষে ৫৮ জঙ্গি নিহত হয়। গ্রেফতার হন অর্ধ শতাধিক।

পুলিশ ও র‌্যাবের দাবি, এই মুহূর্তে জঙ্গি নেটওয়ার্ক ভেঙে গেছে। খন্ড খন্ড হয়ে নাশকতা ঘটানোর মতো শক্তি থাকলেও তা গোয়েন্দাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। বিশেষ করে গত মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর পান্থপথে একটি আবাসিক হোটেলে সাইফুল ইসলাম নামে এক জঙ্গি আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহত হয়। সে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর এলাকায় নাশকতার পরিকল্পনা করছিল। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব তথ্য জেনে ফেলে। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে সাইফুল যে হোটেলে উঠে সেই হোটেলটি ঘিরে ফেলে তারা। আত্মসমর্পণ না করে সাইফুল আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহত হয়।

২০০৫ সালের এই দিনে মুন্সীগঞ্জ বাদে দেশের সব জেলায় ৫০০-এর বেশি স্থানে সিরিজ বোমা হামলায় দুজন নিহত ও শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। এরপর বিভিন্ন সময়ে ওই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তার পরও নামে-বেনামে বারবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সদস্যরা। বর্তমানে নতুন নামে, ভিন্ন পরিচয়ে আবার সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করেছে তারা।

র‌্যাব সূত্র জানায়, ২০০৫ সালের সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় দেশের ৬৩ জেলায় ১৬১টি মামলা হয়। আসামি করা হয় ৬৬০ জনকে। এর মধ্যে ৪৫৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। বিচারকার্যক্রম শেষ হয়েছে ১০২টি মামলার। তার মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যুদ-, ২৪৭ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা ও ১১৮ জনকে খালাস দেওয়া হয়। এর মধ্যে পলাতক রয়েছে ৫০ জন। জামিনে রয়েছে ৩৫ জন। ওই সিরিজ বোমা হামলার ৫৯টি মামলা এখনো বিচারাধীন।

সূত্র জানায়, রাজধানী ৩৩টি স্পটে বোমা হামলার ঘটনায় বিভিন্ন থানায় ১৮টি মামলা হয়। ঢাকা মহানগর এলাকায় বোমা হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলার বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। ঢাকার বাইরের ৫৯টি মামলা বিচারাধীন। সাক্ষীদের না পাওয়ায় অনেক মামলা শেষ করতে সময় বেশি লেগে যাচ্ছে। আবার সাক্ষীরা ঠিকমতো না আসায় জঙ্গিদের শাস্তিও সঠিকভাবে হচ্ছে না। বেশির ভাগ সাক্ষীর ঠিকানাও পরিবর্তন করা হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। তার পরও জঙ্গিদের যাতে কঠোর সাজা হয় সে ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।

আদালত সূত্র জানায়, ফৌজদারি কার্যবধি অনুসারে নিম্ন আদালতে মৃত্যুদন্ডাদেশ পাওয়া অপরাধীদের ফাঁসি কার্যকর করতে হলে হাইকোর্টের অনুমোদন লাগে। মৃত্যুদন্ড প্রাপ্তরা নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিলও করতে পারেন। অথবা সরকার পক্ষ ফাঁসির দ- পাওয়া আসামির ডেথরেফারেন্সের (মৃত্যুদন্ড নিশ্চিতকরণ) শুনানির জন্য হাইকোর্টে আপিল করতে পারে। আপিল হওয়ার পর সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন মামলার যাবতীয় তথ্যসংবলিত একটি বই প্রস্তুত করে, যাকে বলা হয় পেপারবুক। এই পেপারবুক প্রস্তুত হলেই আপিলের শুনানি হয় হাইকোর্টে। আর আপিলের শুনানি শেষে হাইকোর্ট মৃত্যুদ- বহাল রাখলে কারা কর্তৃপক্ষ বা সরকার অপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করতে পারে। আবার যদি আসামিরা বা রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করেন, তাহলে সেই আপিলের শুনানি শেষে রায় দেন আপিল বিভাগ। এ রায় অনুযায়ী সরকারপক্ষ পদক্ষেপ নেয়।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, ওই মামলার পলাতক ও জামিনে মুক্তি পাওয়া জঙ্গিরা অনেকে গোপনে ফের জঙ্গি তৎপতায় জড়িয়ে পড়েছে। জেলেবন্দি জঙ্গিরা কারাগারে বসেই তাদের জঙ্গিবাদের কলকাঠি নাড়ছে। তাই কার্যত থেমে নেই নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির জঙ্গি তৎপরতা। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাজা পাওয়া আসামি রাসেল, আবদুল কাফি, এম এ সিদ্দিক বাবলু, রানা ওরফে আবদুস সাত্তার, মাসুম ওরফে আবদুর রউফ এবং রায়হান ওরফে উবায়েদ মামলার শুরু থেকেই পলাতক। সিরিজ বোমা হামলার পর জেএমবির তখনকার শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানি, খালেদ সাইফুল্লাহ, আবদুল আউয়াল, হাফেজ মাহমুদসহ প্রায় সাড়ে সাত শ জঙ্গি সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। ঝালকাঠিতে দুই বিচারক হত্যা মামলায় জেএমবিপ্রধান শায়খ আবদুর রহমান ও সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাইসহ সাতজনের ফাঁসির আদেশ দেন আদালত। এ মামলার রায়ে মৃত্যুদন্ডাদেশপ্রাপ্ত অপর জঙ্গি আসাদুর রহমান আরিফ পলাতক রয়েছে। ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ রাতে শীর্ষ জঙ্গি নেতা শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম, খালেদ সাইফুল্লাহ, আতাউর রহমান সানি, আবদুল আউয়াল, ইফতেখার হাসান আল মামুনের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়। ওই ৬ জঙ্গির পরে এই মামলায় আর কারো ফাঁসি কার্যকর হয়নি।

সিরিজ বোমা হামলার দিনে শুধু রাজধানীতেই ৩৩টি স্পটে বোমার বিস্ফোরণ ঘটে। সারা দেশের মতো সিরিজ বোমা হামলার স্থান হিসেবে হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, জেলা আদালত, বিমানবন্দর, বাংলাদেশে থাকা মার্কিন দূতাবাস, জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, প্রেস ক্লাব ও সরকারি-আধা সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বেছে নেয় জঙ্গিরা। হামলার স্থানগুলোয় জেএমবির লিফলেট পাওয়া যায়। লিফলেটগুলোয় বাংলাদেশে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে বক্তব্য লেখা ছিল। দেশে কর্মরত বিচারকদের প্রতি একটি বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়। তাতে বলা হয়, দ্রুত এ দেশে ইসলামী হুকুমত কায়েম করতে হবে। প্রচলিত বিচারব্যবস্থা আমরা মানি না।

এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, ‘৬৩ জেলায় সিরিজ বোমা হামলার পর অধিকাংশ আসামি গ্রেফতার হয়েছে। তাদের বিচারও হয়েছে। অনেকের বিচার কার্যক্রম চলমান। জঙ্গি তৎপরতা নির্মূলে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সক্রিয় রয়েছেন। জঙ্গিদের গ্রেফতার করছে।’ বড় কোনো নাশকতার হুমকি রয়েছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা কিভাবে দেশ থেকে জঙ্গিদের নির্মূলের চেষ্টা চালাচ্ছি তা সবাই দেখতে পারছেন। জঙ্গি নির্মূলে এখন সবাই সচেতন। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, আলেম ও সর্বস্তরের জনতা জঙ্গি নির্মূলে তৎপর।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist