পাঠান সোহাগ

  ২২ এপ্রিল, ২০১৮

বিষাক্ত বুড়িগঙ্গা

বুড়িগঙ্গা নদী রাজধানীর তীরঘেঁষে বয়ে গেছে। এ নদীতে একসময় টলমলে পানি ছিল। নানা প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। পানি ব্যবহার হতো ঘর-গৃহস্থালির কাজে। সময়ের স্রোতে সবই হারিয়ে গেছে। পাওয়া যায় না মাছ। নেই বিশুদ্ধ পানি। প্রতিদিন দূষিত হচ্ছে পানি। বাড়ছে দূষণের বিস্তৃতি। নদীর দিকে তাকালেই কালো পানি দেখা যায়। চারপাশে উৎকট গন্ধ। দুই পাশজুড়ে আবর্জনার স্তূপ। এটাই বর্তমান বুড়িঙ্গার বাস্তব চিত্র।

সরেজমিন সদরঘাটের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ঘাটে নৌযানগুলো স্থির দাঁড়িয়ে আছে। মাঝেমধ্যে ছোট ছোট ডিঙি নৌকা এপার-ওপার যাচ্ছে। তীরঘেঁষে পড়ে আছে খাবারের পরিত্যক্ত মোড়ক, ফলের খোসা, বোতলসহ বিভিন্ন রকমের বর্জ্য। সদরঘাটে বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখানকার মানুষ এই দুর্গন্ধের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এখন আর এ বিষয় নিয়ে কেউ কোনো কথা বলে না। ধোলাইখাল, শ্যামপুরের কাছে বুড়িগঙ্গা নদীতীরে দূষণের চিত্র ভিন্নরূপে দেখা যায়। নদীতে শুধু শিল্পাঞ্চলের বর্জ্য মিশ্রিত রঙিন পানি পড়ছে। স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এসব ডায়িং ও বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের কারখানার রঙিন পানি। সব সময় এভাবেই পড়ে। কেউ কিছু বলে না। বললেও কাজে আসে না। সদরঘাট থেকে গাবতলীমুখী সড়ক দিয়ে এগিয়ে গেলে দেখা যায়, নদীর পাড়ে কেউ গোসল করছে, কেউ বোতল, কেউ প্লাস্টিকের বস্তা, কেউ বেসরকারি হাসপাতালের রোগীদের ব্যবহৃত কাপড়-চোপড় ধুয়ে রোদে শুকাতে দিচ্ছে। নদীর পানি বিষাক্ত জেনেও তারা এসব কাজকর্ম করে যাচ্ছে।

জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোস্তাক আহমেদ বলেন, বুড়িগঙ্গা নদীর পানিতে বা চারপাশে যারা কাজ করেন প্রথমত তারা চর্মরোগে আক্রান্ত হবে। চোখের রোগে ভোগবে। এ নদীর পানি যদি কোনোভাবে খাবারের সঙ্গে মিশতে পারে, তাহলে পানিবাহিত রোগ অবধারিত। নানা জটিল রোগের মধ্যে হেপাটাইটিস, টাইফয়েড, ডায়রিয়া, কলেরা, আমাশয়, জন্ডিসের মতো মারাত্মক ব্যাধি হতে পারে।

জানা যায়, বুড়িগঙ্গায় টেক্সটাইল, ওষুধ, সিমেন্ট, রাবার, পাল্প, সার, চামড়া, ইস্পাত, পেট্রোলিয়াম, কাচ, তেল কারখানার বর্জ্য পড়ে। এক হিসাবে বলা হয়েছে, প্রতিদিন সাড়ে চার হাজার টন কঠিন বর্জ্য এবং ২২ হাজার টন তরল বর্জ্য বুড়িগঙ্গায় মিশে দূষিত হচ্ছে পানি।

বুড়িগঙ্গা নদীর পানিতে দূষণের মাত্রা পরীক্ষা করেছে বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংঘঠন। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন জায়গার পানি পরীক্ষা করে দ্রবীভূত অক্সিজেনের (ডিও) পরিমাণ শূন্য দশমিক ১২ থেকে শূন্য দশমিক ৪০ মিলিগ্রাম পেয়েছে। পাশাপাশি পরিবেশ অধিদফতরের পরীক্ষায় প্রতি লিটার পানিতে সর্বনি¤œ শূন্য দশমিক ৩৮ মিলিগ্রাম ছিল। বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, বুড়িগঙ্গা নদীর পানি সবচেয়ে বেশি দূষিত। পাঁচ জায়গায় সর্বোচ্চ পরিমাণে ক্ষতিকারক ধাতু রয়েছে। আর বাবুবাজার এলাকায় বুড়িগঙ্গার পানির ভয়াবহ অবস্থা। এ এলাকার পানিতে একই সঙ্গে চারটি (কপার, নিকেল, লেড ও আয়রন) ভারী ধাতু শনাক্ত হয়েছে। এসব ভারী ধাতু ভূগর্ভেও ছড়িয়ে পড়ছে। এ ছাড়া প্রতিদিন যোগ হচ্ছে নতুন নতুন দূষণকারী উপাদান।

এদিকে বর্তমানে ঢাকায় পৌনে ২ কোটি মানুষ বসবাস করে। প্রতিদিন ২৫০ থেকে ৩০০ কোটি লিটার পানি ব্যবহার করে। এর ৭৮ শতাংশই ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে উত্তোলিত হয়। বাকি ২২ শতাংশ আসে নদীর পানি পরিশোধনের মাধ্যমে। কিন্তু নদীর পানি যে হারে দূষিত হচ্ছে; যে পরিমাণ বিশাক্ত ধাতু ভূগর্ভেও ছড়িয়ে আছে। তা উত্তোলিত পানিতেও পাওয়া যাচ্ছে। এ নিয়ে গবেষকরা সংশয় প্রকাশ করেছেন।

ড. মোস্তাক হোসেন আরো বলেন, এ রকম দূষিত পানি দীর্ঘদিন ব্যবহার করলে আরো জটিল রোগ যেমন আলসার, রক্তচাপ, অ্যাজমা, যক্ষ্মা, কিডনি রোগ এমনকি মরণব্যাধি ক্যানসারও হতে পারে। তাই বুড়িগঙ্গার পানি ব্যবহার ও কাজে জড়িত সবাইকেই সাবধান হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী মৎস্য ও জলজপ্রাণীর জীবনধারণের জন্য পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন প্রতি লিটারে ৫ মিলিগ্রাম বা এর ওপরে থাকা প্রয়োজন। এর কম হলে প্রাণের অস্তিত্ব টিকে থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু বুড়িগঙ্গা নদীর বিভিন্ন জায়গায় এই মাত্রা শূন্য দশমিক ৪০ মিলিগ্রাম। তাই নদী গবেষকরা নদীটি একটি মৃত নদী হিসেবেই দেখছেন। বুড়িগঙ্গা নদীর পানি দূষণ এমন একপর্যায়ে পৌঁছেছে যে, হাইকোর্ট অভিমত দিয়েছেন যে, এই পানিকে আর পানি বলা যায় না।

নদী দখল ও দূর্ষণ নিয়ে কাজ করে নোঙর। সুমন সামস এ সংগঠনের চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, আদি বুড়িগঙ্গার পানি ১০০ ভাগ দূষিত। নদীর চারপাশে বসবাসরত ৯৫ শতাংশ মানুষ এ দূষণের শিকার। এসব এলাকার ৯০ শতাংশ শিশু এ পানির ব্যবহার করে ও সংশ্লিষ্ট কাজকর্ম করে নানারকম রোগব্যাধিতে ভোগছে।

পরিবেশ অধিদফতরের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, বুড়িগঙ্গার পানি সবচেয়ে বেশি দূষিত। এ ঢাকা নগরী ও এই নদীর দুই পাশে গড়ে উঠা শিল্প-কারখানাই এর জন্য দায়ী। তা জেনেও আমরা কিছুই করতে পাছি না। তবে নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে দূষণের পরিমাণ কমিয়ে আনতে হবে। জনস্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বুড়িগঙ্গার চারপাশে গড়ে উঠা শিল্প-কারখানার মালিকসহ সবাইকে নিঃস্বার্থভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist