সোহেল নওরোজ

  ১৮ আগস্ট, ২০১৭

সেরা পীঠস্থান

স্বপ্নযাত্রার ৫৭ বছরে বাকৃবি

চলতি মাসের শুরুতে একটা সংবাদে হঠাৎ করে চোখ আটকে গেল। যার শিরোনাম ছিল ‘র‌্যাংকিংয়ে দেশসেরা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়’। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই এক ধরনের দুর্বলতা কাজ করে। ইতিবাচক খবরে যেমন পুলকিত হই, মন্দ সংবাদ তেমনি পীড়া দেয়। খবরের ভেতরে ঢুকে জানতে পারি, বিশ্বের সব বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে প্রকাশিত ওয়েবমেট্রিক্সে র‌্যাঙ্কিং অব ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিস এ বাংলাদেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)। স্পেনের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্প্যানিশ জাতীয় গবেষণা কাউন্সিলের করা র‌্যাংঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের ১৫০টি বিশ্ববিদ্যালয় এবং এদের অধিভুক্ত কলেজের মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে এ অবস্থান দেখানো হয়েছে। সার্বিক বিবেচনায় বাকৃবির এ অবস্থান হয়তো আহামরি কিছু নয়, কিন্তু প্রায়োগিক শিক্ষা ও মৌলিক গবেষণার অন্যতম এ বিদ্যাপীঠ তার অভীষ্ঠে পৌঁছাতে আগামীতে আরো উদ্যোমী ও কার্যকর হয়ে উঠবে সন্দেহ নেই। কৃষি শিক্ষায় বাকৃবির অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলে কৃষিতে বিল্পব ঘটানোর স্বপ্ন পূরণের পথে দ্রুতই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।

একটা সময় পর্যন্ত কৃষি ও কৃষিজাত দ্রব্যের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দরিদ্রতা দূর, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, আমিষের অভাব পূরণ করাতেই সীমাবদ্ধ ছিল আমাদের স্বপ্ন। কারিগরি শিক্ষা, কার্যকর গবেষণা ও কৃষি প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় সে স্বপ্ন সীমা ছুঁয়েছে। কৃষকেরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ হয়ে উঠেছে। গবেষণালব্ধ জ্ঞানের প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে ফসলের মাঠে, মাছের পুকুরে কিংবা গবাদিপশুর খামারে। মৎস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের প্রথম কাতারে। ছাগল পালনে আমাদের অবস্থান ওপরের দিকে। কৃষি পণ্য উৎপাদনেও বিশ্বের অন্যান্য কৃষিনির্ভর দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়েছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি ভারত ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় জেনেছি, সে দেশের অনেক প্রদেশের চাষ ব্যবস্থা এখনও প্রকৃতি-নির্ভর। বিকল্প সেচ ব্যবস্থা না থাকায় পানির জন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। বৃষ্টির পানিই সেখানকার মানুষের একমাত্র ভরসা। আমাদের দেশেও কিছু স্থানে কৃষি কাজে প্রকৃতি-নির্ভরতা আছে। তবে কৃষি বিষয়ক শিক্ষা, গবেষণা ও তার প্রয়োগে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। নতুন ও টেকসই জাত উদ্ভাবনে আমাদের সাফল্য সর্বস্বীকৃত। কৃষিভিত্তিক উচ্চতর শিক্ষা ও গবেষণায় বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার যে কয়টি বিদ্যাপীঠ গৌরবের সঙ্গে পথ চলছে, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি) তার অন্যতম। সাফল্যের ধারাবাহিকতা অক্ষুণœ রেখে ৫৭ বছরে পদার্পণ করছে এই বিদ্যাতীর্থ।

বাংলাদেশে কৃষিশিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে পথিকৃৎ, পূর্ণাঙ্গ ও প্রধান বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। মানসম্পন্ন উচ্চতর কৃষিশিক্ষা ব্যবস্থার নিশ্চয়তা বিধানের মাধ্যমে দেশে কৃষি উন্নয়নের গুরু দায়িত্ব বহনে সমর্থ তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ কৃষিবিদ, কৃষিবিজ্ঞানী ও কৃষি প্রযুক্তিবিদ তৈরি করাই এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান লক্ষ্য। প্রতিষ্ঠাকালে মাত্র দুটি অনুষদ নিয়ে কার্যক্রম শুরু করা বাকৃবিতে বর্তমানে ছয়টি অনুষদে ৪৩টি শিক্ষা বিভাগের তত্ত্বাবধানে কৃষিবিষয়ক পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান আহরণের সুযোগ রয়েছে। ৪২টি শিক্ষা বিভাগে তিন সিমেস্টার মেয়াদে এমএস ডিগ্রি কার্যক্রম চালু রয়েছে। বর্তমানে ৪০টি বিভাগ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো বা সুযোগ-সুবিধার অভাবে দেশের বেশিরভাগ পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাবিমুখতার বিষয় আমাদের জানা, কিন্তু বাকৃবি এক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত স্থাপনে সক্ষম হয়েছে। কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে দেশে যত গবেষণা পরিচালিত হয়, তার সিংহভাগই এ বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক। নতুন ও সহজতর কৃষি প্রযুক্তি উদ্ভাবনে বাকৃবির কৃষিবিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টার অন্ত নেই। দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় সেশনজট সমস্যায় জর্জরিত হলেও বাকৃবিতে সে সমস্যা নেই। সেমিস্টার পদ্ধতি চালু হওয়ার পর থেকে হরতাল, অবরোধ বা অন্য কোনো রাজনৈতিক ইস্যুতে বন্ধ হয়নি বাকৃবির শিক্ষা কার্যক্রম। গর্বভরে বলা যায়, দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে ৫৫ বছর পূর্ণ করছে শিক্ষা, গবেষণা ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুপম মিলনস্থল বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।

আধুনিক বিশ্বের ৪৮টি স্বল্পোন্নত দেশের তালিকায় থাকা বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক উন্নয়নশীল একটি দেশ হিসেবেই এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের কৃষি সংস্কৃতিতে বারবার আধুনিকতার ছোঁয়া দিয়ে দরিদ্রতা দূর করার প্রত্যয়ে শক্তিশালী আর্থসামাজিক অবকাঠামো নির্মাণে সূচনালগ্ন থেকেই বাকৃবির প্রয়াস অগ্রগণ্য। আধুনিক প্রযুক্তি সম্প্রসারণে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আপন মর্যাদায় আসীন। কৃষি উন্নয়নে এবং খাদ্যে স্বয়ম্ভরতা অর্জনে উন্নত জাতের ফল-ফসল উদ্ভাবন, মাছের উন্নত প্রজাতি ও চাষের সহজ প্রযুক্তি প্রবর্তন, প্রাণিচিকিৎসা ও উৎপাদন বৃদ্ধি প্রভৃতিতে বাকৃবির অবদান স্বীকৃত। প্রচলিত, অপ্রচলিত ও বিলুপ্তপ্রায় দেশি-বিদেশি ফল গাছের সবচেয়ে বড় সংগ্রহশালা জার্মপ্লাজম সেন্টারের অবস্থান বাকৃবি চত্বরে। এ ক্যাম্পাসেই অবস্থিত দেশের প্রথম এবং একমাত্র কৃষি জাদুঘর। কৃষি বিবর্তনের ইতিহাস, কৃষি উপকরণ এবং এ উপকরণ সম্পর্কে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধারণা দিতে প্রতিষ্ঠা করা হয় জাদুঘরটি। জীববৈচিত্রের দিক দিয়ে দেশের বৃহত্তম বোটানিক্যাল গার্ডেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থিত। সহস্রাধিক প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে এখানে। এছাড়া বাকৃবিতে রয়েছে একটি বৃহৎ দুগ্ধ খামার, পোলট্রি খামার, মৎস্য খামার, কৃষি খামার, ফিড মিল, মৎস্য হ্যাচারি, গো-ছাগলের জাত উন্নয়ন কেন্দ্র, ভেটেরিনারি ক্লিনিক এবং আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত প্রফেসর ড. মুহাম্মদ হোসেন কেন্দ্রীয় গবেষণাগার। দেশের নদ-নদী, খাল-বিল থেকে হারিয়ে যাওয়া বিভিন্ন মাছ ও জলজ জীববৈচিত্রের সংগ্রহ নিয়ে স্থাপন করা হয়েছে ‘ফিশ মিউজিয়াম অ্যান্ড বায়োডায়ভার্সিটি সেন্টার’। এছাড়া দেশের কৃষি সম্পর্কিত দুটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) ও বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিনা) প্রধান কার্যালয় বাকৃবির সবুজ ক্যাম্পাসে অবস্থিত।

শিক্ষার পাশাপাশি স্বাধীনতা সংগ্রামেও বাকৃবির গৌরাজ্জ্বল অবদান আমাদেরকে দেশপ্রেম ও স্বাধিকারের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ছয় দফা ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার ভিত্তিতে ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে আন্দোলন ও ত্যাগের মহান ইতিহাস। ১৯৭১ সালের দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে এ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হারায় তার ১৯ বীর সন্তাানকে। তাঁদের নামে বিশ্বদ্যিালয়ের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন মিলনায়তনের পেছন অংশে নির্মাণ করা হয় ‘মরণ সাগর’ নামের স্মৃতিসৌধ। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শহীদ ছাত্র মুক্তিযোদ্ধার নামে তিনটি হলের নামকরণ করা হয়। ভাষা ও স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে স্থাপন করা হয় শহীদ মিনার, মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিস্তম্ভ এবং বিজয়’৭১ নামে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে নির্মিত বধ্যভূমি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের নির্মম হত্যাযজ্ঞ ও ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। মা, মাটি ও মোহনার এমন সম্মিলন বাকৃবিকে যেন এক খ- আশ্চর্যভূমিতে পরিনত করেছে! কৃষিতে মুক্তি আঁকার চিরায়িত সুরই প্রতিভাত হয় এর আনাচে-কানাচে।

কৃষিই কৃষ্টি। কৃষি আমাদের সংস্কৃতির অনিবার্য অনুষঙ্গ। কৃষি প্রধান এই দেশে সনাতন চাষ ব্যবস্থার আধুনিকায়নে তথা বিজ্ঞান-ভিত্তিক চাষাবাদের মাধ্যমে টেকসই কৃষি উন্নয়ন ও কৃষি-বিজ্ঞান ভিত্তিক অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ে তোলার যে লক্ষ্য ষাটের দশকের গোড়ায় নির্ধারণ করা হয়, স্বাধীনতার পর যা অবধারিত হয়ে পড়ে, তা নিশ্চিত করতেই বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করে চলেছে। পেশাগত শিক্ষা হিসেবে কৃষিবিজ্ঞানের সব শাখায় উচ্চতর শিক্ষাদান, প্রায়োগিক ও মৌলিক গবেষণা পরিচালনা, সম্প্রসারণ ও সংশ্লিষ্ট গঠনমূলক কার্যক্রম পরিচালনা ও তত্ত্বাবধান, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তাসহ কৃষক ও আদর্শ চাষীদের জন্য কৃষি ও পল্লী উন্নয়নের নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দান এবং বাংলাদেশের ভেতরে-বাইরে অবস্থিত প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপাক্ষিক সহযোগিতামূলক উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণে বাকৃবির সাফল্য ঈর্ষণীয়। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ এমন একটি পথিকৃৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যা শিক্ষা, গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও সম্প্রসারণের মতো বহুমাত্রিক কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের সমস্যা ও চাহিদা মোকাবেলার জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়কে সবসময় প্রস্তুত থাকতে হয়। নানাবিধ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বাকৃবি এ যাবৎ যে সাফল্য অর্জন করেছে, তা আগামীতে বলিষ্ঠ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। আমাদের বিশ্বাস, যথাযথ পরিকল্পনা ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অনুসরণের মাধ্যমে এর শিক্ষা ও গবেষণাসহ যাবতীয় কার্যাবলীর বিকাশ অব্যাহত থাকবে এবং কৃষি তথা জাতীয় উন্নয়নে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ও অবদান আরো ফলপ্রসূ হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist