বিশ্বজিত রায়

  ১১ আগস্ট, ২০২০

শুভ জন্মাষ্টমী

‘তোমাকে বধিবে যে গোকূলে বাড়িছে সে’

আজ সনাতন ধর্মের প্রবক্তা মহান পুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী। দ্বাপর যুগের শেষ দিকে ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন এবং যখন হানাহানি, সংঘর্ষ, রক্তপাত, রাজন্যবর্গের মধ্যে রাজ্যালোভ তথা পৃথিবী যখন মর্মাহত, ঠিক সেই সময়ে মানবরূপী মহামানব ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মথুরার অত্যাচারী রাজা কংসের কারাগারে বসুদেবের স্ত্রী দৈবকীর উদরে জন্মগ্রহণ করেন। আর সনাতন ধর্মাবলম্বীরা শ্রদ্ধা-ভক্তি আর উৎসবমুখর পরিবেশে হিন্দুধর্মের প্রাণপুরুষ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিন ‘শুভ জন্মাষ্টমী’ হিসেবে পালন করে আসছে। শ্রীকৃষ্ণের মানবরূপে পৃথিবীতে আবির্ভাবের কারণ সম্পর্কে গীতায় তিনি বলেছেন,

‘যদা যদাহি ধর্মস্য গ্লানি ভবতি ভারত।/অভ্যুত্থানম ধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম।/পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃৃতাম।/ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভাবামি যুগে যুগে।’ (জ্ঞানযোগ ৭/৮।)

‘হে ভারত, যখনি পৃথিবীতে অধর্ম বেড়ে যায় তখন আমি অবতীর্ণ হই, অবতীর্ণ হয়ে সাধুদের রক্ষা দুষ্টের বিনাশ ও ধর্ম সংস্থাপন করি।’ অধর্মকে নাশ করার জন্য পৃথিবীতে পরমেশ্বর ভগবান মানব রূপ নিয়ে কৃষ্ণ হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। শ্রীল শ্রীধর স্বামী ‘কৃষ্ণ’ শব্দের ব্যাখ্যায় লিখেছেন ‘কৃষিভূর্বাচকঃ শব্দো নশ্চ নির্বৃতিবাচকঃ।’ ‘কৃষ’ ধাতু আকর্ষণ বাচক এবং ‘ণ’ পরমানন্দ বাচক। অর্থাৎ যিনি জীবদেরকে মায়ার কবল থেকে আকর্ষণ করে নিজ নিত্য দাস্যে নিয়োগপূর্বক পরমানন্দ প্রদান করেন, তিনিই কৃষ্ণ। যার ছিল ষোলকলা গুণ। অনিমা, মহিমা, প্রাপ্তি, প্রাকাম্য, লঘিমা, ঈশিতা, কামাবসায়িতা ও বশিতা এই আট সিদ্ধি; ঐশ্বর্য, বীর্য, যশঃ শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য এই ছয় ভগ এবং লীলা ও কৃপা। এই গুণগুলো পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে নিত্য বর্তমান।

‘ঐশ্বর্যস্য সমগ্রস্য বীর্যস্য যশসঃ শ্রিয়ঃ।/জ্ঞানবৈরাগ্যয়োশ্চৈব ষণœাং ভগ ইতীঙ্গনা ॥’ (বিষ্ণুপুরাণ ৬/৫/৪৭)

“সমগ্র ঐশ্চর্য, সমগ্র বীর্য, সমগ্র যশ, সমগ্র সৌন্দর্য, সমগ্র জ্ঞান ও সমগ্র বৈরাগ্য এই ছয়টির সমাহারকে ‘ভগ’ বলে। এই ছয়টি অচিন্ত্য গুণ যার মধ্যে অঙ্গাঙ্গিভাবে পূর্ণরূপে রয়েছে, তিনিই ভগবান।” একমাত্র শ্রীকৃষ্ণের মধ্যেই এই ষড়ৈশ্বর্য পূর্ণরূপে বিরাজমান। আর শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং তার জন্ম ও আমাদের জন্মের পার্থক্য বলছেন “বহূনি মে ব্যতীতানি জন্মানি তব চার্জুন।/তান্যহং বেদ সর্বাণি ন ত্বং বেত্থ পরন্তপ ॥”

‘হে পরন্তপ অর্জুন, আমার ও তোমার বহু বহু জন্ম অতীত হয়েছে। আমি সেই সমস্ত জন্মের কথা স্মরণ করতে পারি, কিন্তু তুমি পারো না।’ (গীতা ৪/৫)। আমরা বহু বিভিন্ন শরীর নিয়ে বিভিন্ন স্থানে জন্মগ্রহণ করে তারপর কালক্রমে মানুষ হয়ে জন্ম নিয়েছি। কিন্তু অতীতের সেই সব ঘটনা বিস্মৃতির অতল সাগরে তলিয়ে গেছে। আবার মৃত্যুর পর কোথায় জন্ম নেব, তা-ও অবগত নই। কিন্তু কৃষ্ণ সেই সবই অবগত। এই হলো পার্থক্য।

জানা যায়, তখনকার অসুর রাজারা ছিল খুবই অত্যাচারী। তাদের অত্যাচারের পরিমাণ এতটাই বেশি ছিল যে, দেবদেবীগণ তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ক্ষীর সমুদ্র তীরে গিয়ে সব দেবদেবী ভগবানের কৃপা লাভের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করতে থাকেন। তাদের প্রার্থনায় সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান ব্রহ্মার অবগতির জন্য দৈববাণীতে বলেন, ‘হে ব্রহ্মা, আমি খুবই অল্প সময়ে যদুবংশীয় রাজাদের রাজধানী মথুরা রাজা সুরসেনের পুত্র বসুদেবের সন্তানরূপে দেবকীর অষ্টম গর্ভে জন্মগ্রহণ করব। তাই তোমরা আমার নির্দেশ অনুসারে দ্বারকা, মথুরা ও ব্রজের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে জন্মগ্রহণ করো।’ ব্রহ্মা ভগবানের দৈববাণী শুনে সবাইকে জানিয়ে দিল এবং সবাই যথাসময়ে যথাস্থানে ফিরে গেল।

সেসময়ে মথুরায় উগ্রসেন নামে একজন ধার্মিক রাজা ছিলেন। কিন্তু উগ্রসেন ধার্মিক ছিলেন ঠিকই, তার পুত্র কংস যেমন অহংকারী তেমনি ছিল অত্যাচারী। কংস এতটাই অত্যাচারী ছিল যে, নিজের জন্মদাতা পিতা উগ্রসেনকে সিংহাসনচ্যুত করে কারাবন্দি রেখে নিজেই মথুরা রাজত্ব করত। কংস আরাধনা করে বরলাভ করেছিল যে, তার বোন দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান ছাড়া অন্য কোনোভাবেই তার মৃত্যু হবে না। আর এর জন্য কংস আরো অত্যাচারী এবং অহংকারী হয়ে উঠল। কংসের বোন দেবকী বাসুদেবের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বাসুদেব আর দেবকীকে যে রথে বসানো হয়েছিল সে রথের সারথি হচ্ছে কংস। রথটি যখন তার নিজস্ব গতিতে চলছিল তখন হঠাৎ করে দৈববাণীটি কংসের কানে বেজে উঠল, ‘ওরে নির্বোধ কংস, তুমি যাকে রথে করে নিয়ে যাচ্ছো, তার গর্ভের অষ্টম সন্তান তোমার প্রাণনাশ করবে।’ এই দৈববাণীটি কানে বাজা মাত্রই অসুররূপী কংস খড়গ হাতে দেবকীকে হত্যার জন্য এগিয়ে গেল। কংসের এরূপ আচরণ দেখে বসুদেব অনেক অনুনয় বিনয় করে এই বলে রাজি করাল যে, তাদের সন্তান জন্ম নেওয়ার পরপরই তার হাতে সোপর্দ করা হবে। বাসুদেবের অনুরোধ শুনে কংস শান্ত হলো ঠিকই, কিন্তু দেবকী আর বাসুদেবকে কারাগারে নিক্ষেপ করল। এ রকম পরিস্থিতিতে বাসুদেব আর দেবকীর বিবাহ বাসর হলো কংসের কারাগারে। দশ মাস দশ দিন পর দেবকী জন্ম দেন এক পুত্রসন্তানের। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বাসুদেব জন্মের পরপরই পুত্রসন্তানকে তুলে দেন কংসের হাতে। দেবকী ও বাসুদেবের প্রথম পুত্রসন্তানটিকে নৃশংসভাবে হত্যা করে অত্যাচারী কংস। কংসের নির্মম আর নিষ্ঠুরতার শিকার হন বাসুদেব দেবকী দম্পতির পর পর আরো ছয়টি সন্তান।

বাসুদেব দেবকী দম্পতির ছয়টি সন্তানকে হত্যার পর মৃত্যুর চিন্তায় উৎকন্ঠিত কংস হয়ে যায় দিশেহারা। দেবকী গর্ভে যখন বলরাম সপ্তম সন্তানরূপে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন তখনই ভগবানের নির্দেশে দেবী যোগমায়া দেবকীর গর্ভ হতে বলরামকে স্থানান্তরিত করে নন্দালয়ে রোহিনীর গর্ভে স্থাপন করেন। একপর্যায়ে দেবকীর গর্ভপাত হয়েছে বলে প্রচার করা হয়েছিল। এবার দেবকীর অষ্টম সন্তান অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্ম নেওয়ার পালা। দেবকী অষ্টমবারের মতো সন্তানসম্ভবা হলে কারাগারের চতুর্দিকে বাড়ানো হয় নিরাপত্তা প্রহরা। ভাদ্র মাসের অষ্টমী তিথি আর প্রবল ঝড় বৃষ্টি বিদ্যুৎ চমকিতো এক দুর্যোগময় অন্ধকারাচ্ছন্ন রজনিতে দেবকী উদরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আবির্ভূত হন। শ্রীকৃষ্ণ ভূমিষ্ঠ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পিতা বাসুদেব দেখলেন শিশু সন্তাটির চার হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা এবং পদ্ম ধারণ করে আছেন। তার দেহে শোভা পাচ্ছে মহামূল্যবান মণি-রতœ শোভিত সব অলংকার। বাসুদেব বুঝতে পারলেন জগতের মঙ্গল কামনার্থে নারায়ণই জন্মগ্রহণ করেছেন দেবকীর উদরে। বাসুদেব কড়জোড়ে প্রণাম করে তার বন্দনা শুরু করলেন। বাসুদেবের বন্দনার পর দেবকী প্রার্থনা শেষে একজন সাধারণ শিশুর রূপ ধারণ করতে বললেন শ্রীকৃষ্ণকে।

এমন একটি মুহূর্তে বাসুদেবের কানে দৈববাণী ভেসে আসে যে, ‘তুমি এখনই গোকূল নগরে গিয়ে নন্দের স্ত্রী যশোদার ক্রোড়ে তোমার ছেলেশিশুকে রেখে এসো এবং যশোদার যে কন্যাশিশুর জন্ম হয়েছে তাকে নিয়ে দেবকীর ক্রোড়ে শুয়ে দাও। পৃথিবীর সব মানুষ এখন গভীর ঘুমে অচেতন, কেউ কিছুই জানতে পারবে না।’

দৈববাণী শুনে বাসুদেব দুর্যোগপূর্ণ অন্ধকার রাতেই শিশুটিকে নিয়ে ছুটতে লাগলেন গোকূল নগরে নন্দের বাড়ির দিকে। পথিমধ্যে যমুনা নদী। বর্ষাকাল হওয়ায় যমুনা নদীটি ছিল কানায় কানায় পরিপূর্ণ। যমুনা নদীর এমন অবস্থা দেখে বাসুদেব কোনো উপায়ন্তর না দেখে ছুটতে লাগলেন। হঠাৎ করে বাসুদেব দেখলেন যে, জলে পরিপূর্ণ নদীটি শুকিয়ে গেল এবং একটি শিয়াল নদীটি পার হচ্ছে। বাসুদেব তখন রূপধারী ওই শিয়ালটির পিছু পিছু হাঁটতে লাগলেন। তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছিল। বাসুদেব ও শ্রীকৃষ্ণকে বৃষ্টির পানি থেকে রক্ষার জন্য নাগরাজ বিশাল ফণা বিস্তার করল তাদের মাথার ওপরে। অল্প কিছু সময়ের মধ্যে গোকূলে গিয়ে বাসুদেব তার ছেলে সন্তানটিকে যশোদার ক্রোড়ে রেখে যশোদার জন্ম নেওয়া কন্যাসন্তান যোগমায়াকে নিয়ে কংসের কারাগারে হাজির হলেন।

সকালবেলা ঘুম থেকে জেগেই কংস জানতে পারল দেবকীর অষ্টম সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে কংস কারাগারে ছুটে আসে এবং দেবকীর কোল থেকে মেয়ে সন্তানটিকে কেড়ে নিয়ে সজোরে মাটিতে উড়িয়ে মারতেই মেয়ে সন্তানটি শূন্যে আকাশে উঠে যোগমায়া মূর্তি রূপ ধারণ করে। আকাশে মিলিয়ে যাওয়ার পূর্বে কংসকে সাবধান করে বলে যায়, ‘তোমাকে বধিবে যে গোকূলে বাড়িছে সে।’ এই কথা শুনে কংস মথুরার সকল শিশুকে মারার পরিকল্পনা করে।

কংসের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষ মুক্তির আশায় কৃষ্ণের অনুসারী হয়ে উঠে এবং ধীরে ধীরে কংসবধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। আর এদিকে কংস কৃষ্ণকে বধ করার জন্য মথুরায় মল্লক্রীড়ার আয়োজন করে। আর এ আয়োজনে আমন্ত্রণ জানানো হয় শ্রীকৃষ্ণ আর বলরামকে। কৃষ্ণবধের আশায় কংস তখন আত্মহারা। পাগলা হাতি রাখা হয় কৃষ্ণকে মাটিতে পিষে মারার জন্য। আর বিকল্প হিসেবে কংস চানুর ও মুষ্টির নামে দুই বলবান বীরকে রাখা হয় কৃষ্ণকে হত্যার জন্য। কিন্তু অবতাররূপী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কংসের সব চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেন। হতভম্ব হয়ে পড়েন অত্যাচারী কংস। তার সহচর সবাইকে অস্ত্র ধারণ করতে বললেন, কিন্তু কেউ কংসের কথায় সাড়া দেয়নি। তখন নিরুপায় কংস নিজেই কৃষ্ণের ওপর অস্ত্র ধারণ করলে কৃষ্ণ রক্তপিপাসু হিংস্র সিংহের মতো প্রবল শক্তিতে কংসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। অবশেষে কৃষ্ণের শক্তির কাছে ধরাশায়ী হতে হলো প্রতাপশালী কংসকে।

লেখক : কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close