রায়হান আহমেদ তপাদার

  ২৯ মে, ২০২০

বিশ্লেষণ

করোনার পরবর্তী কেন্দ্রস্থল আফ্রিকা মহাদেশ

চীন থেকে শুরু হয়ে এশিয়ার বহু দেশে প্রকোপ দেখিয়েছে। তছনছ করে দিয়েছে ইউরোপ। বাদ যায়নি আমেরিকা। অস্ট্রেলিয়াও প্রভাবিত। শুধু যা একটু কম ছিল আফ্রিকায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু মনে করছে এবার করোনার ভরকেন্দ্র হতে পারে আফ্রিকা। এমন ভাবার কারণও রয়েছে। আফ্রিকায় এতদিন তেমন ভয়ংকরভাবে করোনা প্রকোপ না দেখালেও এখন ক্রমে আফ্রিকায় করোনা সংক্রমণের হার বাড়ছে। আর তা বাড়ছে বেশ দ্রুত গতিতে। যা নিয়ে চিন্তিত হু। গত মার্চ মাসে প্রথম আফ্রিকায় করোনায় মৃত্যু হয় এক সাংবাদিকের। জিম্বাবুয়ের ওই সাংবাদিক হারারেতে মারা যান। তাকে বাঁচানোর জন্য প্রয়োজনীয় একটি ভেন্টিলেটরও হারারেতে ছিল না। আর এখানেই সবচেয়ে বেশি চিন্তায় পড়েছে হু। কারণ আফ্রিকার লড়াই করার সেই আর্থিক ক্ষমতা বা পরিকাঠামো নেই। হু এখন চিকিৎসার চেয়েও অনেক বেশি জোর দিচ্ছে আফ্রিকায় ছড়িয়ে পড়াটা আটকানোর দিকে। কারণ করোনা রোগী বাড়তে শুরু করলে আফ্রিকার দেশগুলোর হাতে সেই চিকিৎসা পরিকাঠামো নেই যে তারা তার মোকাবিলা করতে পারে। করোনায় যে যন্ত্রটি খুবই দরকারি সেই ভেন্টিলেটর পর্যন্ত সামান্য রয়েছে আফ্রিকার হাতে। ক্রিটিকাল কেয়ার ইউনিট বা আইসিইউ বিশেষ নেই।

এদিকে দক্ষিণ আফ্রিকা, ঘানা, আইভরি কোস্ট, নাইজেরিয়া ও ক্যামেরুনে করোনা এরই মধ্যে থাবা বসিয়েছে। তাই আপাতত আফ্রিকার দেশগুলোতে করোনা ছড়িয়ে পড়া আটকানোর দিকেই সবচেয়ে বেশি নজর দিচ্ছে হু।

এরই মধ্যে পুরো বিশ্বকে আক্রান্ত করলেও কোভিড-১৯ ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে মূলত আমেরিকা ও ইউরোপে। এশিয়াতেও বিস্তার কম হযনি, কিন্তু তুলনামূলক ভাবে আক্রান্তের হার কম ছিল আফ্রিকায়। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) হুশিয়ারি জানিয়ে বলেছে, করোনাভাইরাস মহামারির পরবর্তী কেন্দ্রস্থল হতে পারে আফ্রিকা মহাদেশ। এ নিয়ে বিবিসির এক খরবে বলা হয়েছে, জাতিসংঘের কর্মকর্তারা আশঙ্কা করছেন, আফ্রিকায় ভাইরাসটির সংক্রমণে অন্তত ৩ লাখ মানুষের মৃত্যু এবং প্রায় ৩ কোটি মানুষ দরিদ্র হতে পারে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ভাইরাসটি আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের রাজধানী থেকে দূরবর্তী এলাকায় দ্রুত ছড়াচ্ছে। মহামারিতে প্রয়োজনীয় ভেন্টিলেটরের সংখ্যাও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে অপ্রতুল বলে উল্লেখ করেছে সংস্থাটি। আফ্রিকার এক-তৃতীয়াংশের বেশি জনগণের প্রয়োজনীয় পানির সরবরাহ নেই এবং প্রায় ৬০ শতাংশ শহরের বাসিন্দা ঘনবসতিপূর্ণ বস্তিতে বাস করে। বস্তিগুলোতে ভাইরাসটির দ্রুত বিস্তার হতে পারে।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা আশঙ্কা করছে, করোনার জেরে আফ্রিকায় কমপক্ষে ৩০ লাখ থেকে ৩৩ লাখ মানুষের মৃত্যু হবে। হু-এর পক্ষ থেকে সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, যদি এখনই এ ব্যাপারে আফ্রিকার দেশগুলো সতর্ক না হয়, সেক্ষেত্রে সংক্রমণ ছড়াতে পারে ১ দশমিক ২ বিলিয়ান মানুষের মধ্যে। গবেষকদের দাবি, যদি আফ্রিকায় এখন থেকে সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং মানা শুরু হয়, তবে মহামারির শেষে সর্বমোট হিসেবে আক্রান্ত হতে পারে ১২২ মিলিয়ন মানুষ। আফ্রিকায় প্রথম করোনাভাইরাস পাওয়া গিয়েছিল ইজিপ্টে এক ব্যক্তির দেহে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ওই দিনের পর থেকে এখন পর্যন্ত মিলেছে আরো ১৮ হাজার করোনা পজিটিভ কেস। আফ্রিকার আলজিরিয়ায় এখন পর্যন্ত সর্বাধিক মানুষের করোনার জেরে মৃত্যু হয়েছে। অন্যদিকে অপর একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে, আফ্রিকায় চলতি বছরের জুনের মধ্যে ১৬ মিলিয়ন মানুষ করোনা আক্রান্ত হতে পারে। ওই সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছে, আগামী ১০ সপ্তাহের মধ্যে আফ্রিকায় করোনার জেরে কমপক্ষে ২০ হাজার মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে। তবে বিজ্ঞানীরা এই পরিসংখ্যানটি অত্যন্ত অনিশ্চিত বলে জানিয়েছেন। তারা জানাচ্ছেন এই ভাইরাস আফ্রিকায় জুনের মধ্যে আক্রান্ত করতে পারে ২.৭ মিলয়ন মানুষকে। আবার আক্রান্ত করতে পারে ৯৮ দশমিক ৪ মিলিয়নের বেশি মানুষকেও। এটা পুরোপুরি নির্ভর করছে, কেমনভাবে ওই ভাইরাস আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তার করতে পারছে তার ওপর। আফ্রিকায় এই ভাইরাইরোধে বিরাট প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। ফলে করোনা মহামারি আকার ধারণ করলে পরিস্থিতিটা সহজেই অনুমেয়।

জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দারিদ্র্য, জনবহুল নগর পরিস্থিতি এবং ব্যাপক স্বাস্থ্য সমস্যা আফ্রিকাকে ভাইরাসের জন্য বিশেষত সংবেদনশীল করে তুলেছে। এদিকে মধ্য আফ্রিকায় দ্বিতীয়বারের মতো হানা দিয়েছে পঙ্গপাল। এবারের ছোট পোকাগুলো আরো অনেক বেশি আগ্রাসী। ছোট ছোট ক্ষতিকর পতঙ্গগুলো করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পর্যুদস্ত মহাদেশটির এখানে-সেখানে অবাধে ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রোগাসে শস্য সাবাড় করে দেওয়া পঙ্গপালকে দমন রীতিমতো দুরূহ হয়ে উঠেছে। এর আগে ২০১৯ সালের শেষের দিকে ওই অঞ্চলে পঙ্গপালের উৎপাত দেখা যায়। এই মুহূর্তে আফ্রিকার সবচেয়ে জনবহুল দেশ ইথিওপিয়ার পাশাপাশি ওই অঞ্চলের অর্থনৈতিক শক্তি কেনিয়া আর রাজনৈতিকভাবে পর্যুদস্ত সোমালিয়া পঙ্গপালের আক্রমণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বলা হচ্ছে, দ্বিতীয় দফায় হানা দেওয়া পতঙ্গগুলোর পাল প্রথমবারের চেয়ে ২০ গুণ বড়। জুন নাগাদ এগুলো ৪০০ গুণ বড় হয়ে যাবে। ইথিওপিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় আমহারা এলাকায় পঙ্গপাল কতটা প্রভাব ফেলেছে, তা নিয়ে কাজ করছেন সরকারি কর্মকর্তা মেসেরেট হাইলু। তিনি বলছেন, বন, চারণভূমি আবাদি জমি, এমনকি জঙ্গলেও দেখা মিলেছে পঙ্গপালের। ২০১৯ সালের শেষদিকে ঝাঁকে ঝাঁকে এই পোকার বিস্তার চোখে পড়ে ইথিওপিয়া, তার প্রতিবেশী ইরত্রিয়া ও জিবুতিতে। সংখ্যায় কম হলেও একসময় তা ছড়িয়ে পড়ে সোমালিয়া, কেনিয়া, উগান্ডা, দক্ষিণ সুদান আর তানজানিয়ায়। গত ২৫ বছরে এত ব্যাপক আকারে পোকার আক্রমণ সামাল দেয়নি, এই পরিস্থিতিতে সরকারগুলো যে হিমশিম খাবে-এটাই স্বাভাবিক। তাই পোকাগুলো মেরে ফেলতে পেস্টিসাইড, সুরক্ষামূলক জামাকাপড়, ধোঁয়ার সাহায্যে আর উড়োজাহাজ থেকে জীবাণুনাশক ছড়ানোর জন্য রীতিমতো হুড়োহুড়ি শুরু করে দেয় আফ্রিকার দেশগুলো।

তবে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) কর্মকর্তা সিরিল ফেরান্ড মনে করেন, পঙ্গপাল দমনের জন্য এ ধরনের পদক্ষেপ জোরদার করাটাই কঠিন। পঙ্গপালের প্রথম দলটি মাটিতে যে ডিম রেখে গেছে, তা থেকে এরই মধ্যে বংশবিস্তার হচ্ছে। ছোট ছোট এই পোকা অনেক বেশি আগ্রাসী ভঙ্গিতে সাবাড় করে দিচ্ছে গাছপালা। এই পোকাগুলোই এখন ছড়িয়ে পড়ছে কেনিয়া, সোমালিয়া আর ইথিওপিয়ায়। এপ্রিলের শুরুতে পোকাগুলো আবার উগান্ডার পাঁচ বর্গকিলোমিটারে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বের অন্য অনেক দেশের তুলনায় দক্ষিণ আফ্রিকা অপেক্ষাকৃত দ্রুত, কার্যকর এবং অনেকটা নির্দয়ভাবে তাদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছে। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা ভয়ানক একজন নেতা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেছেন। নেতা হিসেবে সহানুভূতিশীল, ধীর স্থির চরিত্রের অধিকারী হলেও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ও বেসরকারি খাত থেকে সাহায্যের প্রবাহ নিশ্চিত করে পরিস্থিতি বিবেচনায় দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর প্রেসিডেন্টের পর স্বাস্থ্যমন্ত্রী জুয়েলি এমখিজেও তার কর্মচঞ্চল ও পরিস্থিতি বিবেচনায় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি মার্জিত ও ওয়াকিবহাল দৈনিক সংবাদ সম্মেলনের জন্য বিশ্বব্যাপী নন্দিত হয়েছেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে অসম্মানজনক আচরণ করেছেন, এমন অভিযোগ উঠেছে। এই সময়ে যেকোনো ভুলত্রুটি হয়নি, তা কিন্তু নয়। অনেক সময়ই পুলিশ এবং সেনাবাহিনী তিন সপ্তাহব্যাপী লকডাউন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে ব্যবসায়িক রাজধানী জোহানেসবার্গ এবং অন্যান্য এলাকার রাস্তায় সাধারণ মানুষকে পেটানো, অসম্মানজনক আচরণ করা থেকে শুরু করে গুলিও করেছে।

এবং কিছু নিয়ম সম্পর্কে মানুষের মধ্যে দোটানা ছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অস্পষ্ট বার্তা দেওয়া এবং কয়েকজন মন্ত্রীর কথা ঘুরানোর মতো ঘটনাও ঘটেছে। তবে সবচেয়ে বেশি কঠিন ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার দারিদ্র্যপীড়িত এবং ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে সামাজিক দূরত্ব ও তাদের স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা। অনেকে মনে করেন সেসব এলাকায় এখনো ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে সব মিলিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা যে রকম কঠোর লকডাউনের মধ্যে এক সপ্তাহ পার করেছে, সেরকমটা বিশ্বের আর কোনো দেশেই দেখা যায়নি। দক্ষিণ আফ্রিকা এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকর পদক্ষেপ নিলেও, দেশটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আসল পরীক্ষা এখনো বাকি। আর যেহেতু আর্থসামাজিক দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসম সমাজ ব্যবস্থাগুলোর একটি দক্ষিণ আফ্রিকার সমাজ, সেই পরীক্ষার ফল নির্ধারিত হবে দেশটির দরিদ্রতম সম্প্রদায়গুলোর আচরণে। দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারি ও বেসরকারি খাতের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বোধবুদ্ধিসম্পন্ন, দক্ষ নেতৃত্ব থাকলেও বহু বছর স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি ও অর্থনীতির স্থিরগতি বিরাজ করার কারণে প্রধান প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। করোনা মোকাবিলায় ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে অর্থ নিয়ে তহবিল সংগ্রহ করা সাবেক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী অ্যাড্রিয়ান এথোভেন বলেন, ‘প্রায় এক দশক ধরে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে দেওয়ায় দেশ হিসেবে আমরা যথেষ্ট প্রস্তুত নই। তবে দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের এই কঠোর লকডাউন নীতি করোনা ঠেকাতে কতটা ভূমিকা রাখবে তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। তবে এখন পর্যন্ত দেশটির কর্তৃপক্ষ যতটা তৎপরতা দেখিয়েছেন সেগুলোও কিন্তু কম না।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close