সাহাদাৎ রানা

  ২১ জানুয়ারি, ২০২০

বিশ্লেষণ

বাড়ছে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা

শিক্ষার্থী ঝরে পড়া আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার একটি দৈন্যতা। প্রতি বছরই আমাদের দেশে বিভিন্ন স্তরে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে; যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সম্প্রতি সেভ দ্য চিলড্রেনসহ শিশুদের নিয়ে কাজ করা ৬টি আন্তর্জাতিক সংস্থার এক গবেষণা রিপোর্টে প্রকাশ মাধ্যমিক পর্যায়ে ৪১ ভাগ মেয়ে ও ৩৩ ভাগ ছেলে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। এমন তথ্য আমাদের জন্য সত্যিই উদ্বেগের।

শুধু মাধ্যমিক স্তর নয়, উচ্চমাধ্যমিক থেকে শুরু করে সব জায়গায়ই শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার ক্রমেই বাড়ছে। এখানে আরো কিছু তথ্য তুলে ধরলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। গত বছর ১৭ জুলাই প্রকাশিত হয় এইচএসসি পরীক্ষার ফল। সে বছর সারা দেশে এইচএসসি পাসের হার ছিল ৭৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছিল ৪৭ হাজার ২৮৬ জন। সংখ্যার হিসেবে আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ড, মাদরাসা ও কারিগরি বোর্ড মিলিয়ে ১০টি বোর্ডের অধীনে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ১৩ লাখ ৩৬ হাজার ৬২৯ জন। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে ৯ লাখ ৮৮ হাজার ১৭২ জন। গতবার মানে ২০১৮ সালে ১০টি শিক্ষা বোর্ডে গড় পাসের হার ছিল ৬৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ। পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন ১২ লাখ ৮৮ হাজার ৭৫৭ জন। পাস করেন ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৮০১ জন। আগের বছরের চেয়ে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ও পাসের হার দুটোই বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু শঙ্কার খবর হলো, পাসের হার বাড়লেও বিভিন্ন কারণে উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়ে ২ থেকে আড়াই লাখের বেশি শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে। এর পেছনে রয়েছে অনেকগুলো কারণ।

বাস্তবতা হলো- শুধু দারিদ্র্য ও প্রত্যাশিত ফলাফল করতে না পারায় উচ্চমাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না অনেক শিক্ষার্থী। অর্থাৎ এইচএসসি পাস করা একটি অংশ ঝরে পড়ছে উচ্চশিক্ষা থেকে। শুধু উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেই নয়, প্রাথমিক থেকে শুরু করে সব পর্যায়েই ঝরে পড়ছে শিক্ষার্থীরা। এবার একটু পেছনে ফিরে তাকানো যাক। ২০১৯ ও ২০১৮ সালে যারা এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন তারা ২০১২ ও ২০১৩ সালে পিএসসি বা প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার্থী ছিল। সেসময় পিএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যাছিল ২৬-২৭ লাখের মতো। আর ২০১৯ ও ২০১৮ এইচএসসি পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১২ থেকে ১৩ লাখের মধ্যে। অর্থাৎ সময়ের হিসেবে মাত্র ৭ বছরে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার প্রায় অর্ধেক। ২৬-২৭ লাখ থেকে নেমে এসেছে প্রায় ১২-১৩ লাখে। অর্ধেকের মতো শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার এমন চিত্র আমাদের জন্য সত্যিই উদ্বেগজনক। বিশেষ করে শিক্ষাব্যবস্থার জন্যও উদ্বেগের।

ভাবনার বিষয় হলো, দেশের শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া শুধু নির্দিষ্ট কোনো পর্যায়ে নয়। বরং প্রাথমিক শিক্ষা শেষ না করতেই ঝরে পড়ার সংখ্যা শুরু হয়। সবচেয়ে বেশি ঝরে পড়ে মূলত অষ্টম শ্রেণি থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পেরে। এরপর উচ্চমাধ্যমিকে যারা পাস করতে ব্যর্থ হন ঝরে পড়ার তালিকায় রয়েছে তাদের নামও। আবার অনেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগের অভাবে ঝরে পড়ছে। তবে প্রশ্ন হলো, কেন এতসংখ্যক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে? এ ক্ষেত্রে প্রধানতম কারণ দরিদ্রতা। বেশির ভাগ সময়ই দেখা যায়, আর্থিক অভাব-অনটনের কারণে সাধারণত শিক্ষার্থী বেশি ঝরে পড়ে। অথচ এর পরিণতি যে কত করুণ হয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য সত্যিই অস্বস্তির।

বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশের বেশির ভাগ পরিবারই দারিদ্র্যের সঙ্গে বসবাস করে। সেখানে তাদের নানা ধরনের সমস্যার মধ্যে থাকতে হয়। বিশেষ করে অর্থনৈতিক সমস্যা। বিভিন্ন পরিবারেই দেখা যায়, সন্তান একটু বড় হয়ে উঠলেই তাকে উপার্জনে পাঠাতে উদ্যত হন অভিভাবকরা। ফলে অনেকেই পড়ালেখা না করে কর্মজীবনে প্রবেশ করে এক রকম বাধ্য হয়েই। এ কারণে প্রতিনিয়ত দেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। বিপরীতে কমছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। অথচ শিশুশ্রম প্রতিরোধে দেশে আইন রয়েছে। কিন্তু আইন থাকলেও তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব না হওয়ায় আইনের তোয়াক্কা না করে বেড়েই চলছে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা। আবার যারা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক উত্তীর্ণ হতে পারেননি তারা অনেক সময় পারিবারিক অসচ্ছলতার কারণে এদের বড় একটি অংশ চলে যায় কর্মসংস্থানে। অনেকে আবার যায় বিদেশে। এটা শুধু যে এ বছর হবে, তা কিন্তু নয়। এটা প্রায় প্রতি বছরই নিয়মে পরিণত হয়েছে। তবে শঙ্কার খবর হলো, এর সংখ্যাটা দিন দিন শুধুই বাড়ছে। অথচ আমরা কখনো ভেবে দেখি না, দেশের সার্বিক অগ্রগতির পথে এটা একটি বড় বাধা। কারণ এভাবে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার মানে হলো এতে বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি আরো একটি তথ্য আমাদের বেশি শঙ্কা জাগাচ্ছে।

ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর একটি বড় অংশ সমাজে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা থেকে শুরু করে অপরাধ কাজে জড়িয়ে পড়ছে। দেখা যায়, যাদের স্কুলে থাকার কথা তারা যখন জীবিকার তাগিদে ঝরে পড়ছে, তখন বিষয়টিকে হালকাভাবে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ এর সঙ্গে জড়িত অনেক কিছু। অনেক সময় দেখা যায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে পাঁচ বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষাচক্র করতে পারে না। এর মাঝে মধ্যবর্তী যেকোনো সময়ে যেকোনো শ্রেণি থেকে ঝরে পড়ে তারা। আমাদের দেশে মূলত বিভিন্ন কারণে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। এরমধ্যে প্রধান কারণ গুলো হলোÑ অভিভাবকের অসচেতনতা, দারিদ্র্যতা, মেয়েশিশুর প্রতি অবহেলা, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম, বিদ্যালয়ের সময়সূচি, বিদ্যালয়ের ভৌত সুবিধাদি ও সর্বোপুরি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে ঝরে পড়া রোধ করার জন্য সবার আগে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি স্থানীয় জনসমাজের স¤পৃক্ততাও জরুরি। এ ছাড়া বিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি করা, বিদ্যালয়ে খেলাধুলাসহ নিয়মিত সহপাঠক্রমিক কার্যক্রমের ব্যবস্থা করা, বিদ্যালয়ের যাতায়াত ব্যবস্থা নিরাপদ রাখা, বাল্যবিবাহ বন্ধ করা সম্ভব হলে অনেকাংশে রোধ করা যাবে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা। শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার আরো একটি বড় কারণ মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে না পারা। তাই এ বিষয়ে আলাদা গুরুত্ব দিতে হবে। এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে শিক্ষার্থী ঝরে পড়া রোধ করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার। বিশেষ করে বিনামূল্যে বই দেওয়া থেকে শুরু করে উপবৃত্তি, স্কুলে মিড ডে মিল। এর জন্য সরকারকে প্রতি বছর মোটা অঙ্কের টাকাও খরচ করতে হচ্ছে। কিন্তু এত কিছুর পরও শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।

তবে এ ক্ষেত্রে যেসব জায়গায় সমস্যা রয়েছে, সেই বিষয়গুলো চিহ্নিত করে সমাধানের জন্য সরকারকে আরো বেশি উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। বিশেষ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। যেহেতু এটা একটি বড় ধরনের সমস্যা, কিন্তু বিপরীতে এর সমাধানও রয়েছে। তবে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি। বিশেষ করে এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। কারণ নিজ সন্তানকে যদি গড়ে তোলার দায়িত্ব তারা বোধ না করে, তবে শত চেষ্টাতেও এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তাই সরকারের উচিত এ বিষয়ে অভিভাবকদের অনুপ্রাণিত করা। যাতে তাদের সন্তানরা স্কুলমুখী হয়। এ ছাড়া যথাযথ সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রচার-প্রচারণা আরো বৃদ্ধি করতে হবে। পাশাপাশি সঠিক ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close