ইসমাইল মাহমুদ

  ২৬ অক্টোবর, ২০১৯

মুক্তমত

বিশেষ মহলের ফায়দা হাসিলের চেষ্টা

সনাতন (হিন্দু) ধর্মাবলম্বী এক ব্যক্তির ফেসবুক আইডি হ্যাক করে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানো নিয়ে তুলকালাম কান্ড হয় ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলায়। এ নিয়ে প্রাণ যায় চার ব্যক্তির। আহত হয় পুলিশসহ শতাধিক। যদিও পুলিশ দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ ঘটনায় জড়িত প্রকৃত অপরাধী বা ফেসবুক হ্যাকারিদের গ্রেফতার করে প্রকৃত ঘটনা দ্রুত উদ্ঘাটনের আশ্বাস দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী স্থানীয় আলেম সমাজের সঙ্গে বৈঠকে বসে। বৈঠকে স্থানীয় আলেম সমাজ ও প্রশাসনের মধ্যে সমঝোতাও হয়। দেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং এলাকার শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষার্থে সবাই এক হয়ে কাজ করার প্রতিশ্রুতিবদ্ধও হন। সব কিছু সুন্দর ও শান্তিপূর্ণভাবে পরিসমাপ্তির দিকে এগোচ্ছিল; তখনই একটি বিশেষ মহল ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে ঘোলাপানিতে মাছ শিকারের মতো অপরাজনীতি শুরু করে। ওই অপরাজনীতির কারণে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরও পুনরায় ঘোলাটে হয়ে ওঠে। স্থানীয় আলেম সমাজের সামনেই বোরহানউদ্দিন উপজেলা ঈদগাঁহ মাঠে প্রশাসন তথা পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। একটি মহল দেশব্যাপী অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির পাঁয়তারায় এ হামলার ঘটনা ঘটায় বলে অভিজ্ঞজনদের অভিমত। প্রশাসন ও পুলিশের ওপর হামলার পরপরই আত্মরক্ষার্থে ও সরকারি জানমাল রক্ষায় পুলিশ গুলি চালায়। এতে চারজন নিহত হয় এবং দুজন পুলিশ সদস্য গুলিবিদ্ধ হওয়াসহ বেশ কয়েকজন হামলাকারী আহত হন।

ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার এ ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের দেশে ধর্মকে পুঁজি করে বারবার দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও ফায়দা হাসিলের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে একটি মহল। ওই মহলটি ধর্মকে পুঁজি করে মূলত দেশ ও সরকারকে বেকায়দায় বা বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার অপচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। দেশকে একটি উগ্রধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। অথচ ইসলাম শান্তি ও সৌহার্দের ধর্ম। ইসলামে হানাহানি-মারামারি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আর ইসলাম ধর্মকে পুঁজি করে দেশব্যাপী অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করার অপচেষ্টা একটি অশুভ রাজনৈতিক মহলের। এ অপশক্তিকে এখনই প্রতিরোধ করতে না পারলে দেশের ললাটে চরম দুঃখ অনিবার্য।

দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা অভিমত ব্যক্ত করে বলেছেন, এ অশুভ রাজনীতি ও ধর্মের চেতনার নামে অস্থিতিশীলতা বা উন্মাদনা বন্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। এ ব্যাপারে সরকার, দেশের সচেতন নাগরিক, আলেম সমাজকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আর তা না হলে অপকর্ম থেকে দেশ রক্ষা পাবে না। বিশিষ্ট নাগরিকরা বলেন, ‘এই অপশক্তি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে রোধ করে একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার ধারাবাহিক অপচেষ্টায় লিপ্ত। আমরা এই ধরনের ষড়যন্ত্র ও অপতৎপরতার তীব্র নিন্দা জানাই এবং একই সঙ্গে বাংলাদেশের শত্রু এই উগ্র মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি। একই সঙ্গে আমরা দেশের সব জনগণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, এই ধরনের যেকোনো সাম্প্রদায়িক উসকানি ও গুজবের বিরুদ্ধে সচেতন ও সতর্ক থাকতে।’

ভোলায় সহিংসতার ঘটনায় ২০ অক্টোবর রোববার পুলিশের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সার্বিকভাবে মনে হচ্ছে পুলিশ প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন করে তদন্ত চলমান রাখা সত্ত্বেও এবং আলেম সমাজ থেকে এ ঘটনায় কোনো বিশৃঙ্খলা না করার ঘোষণা দেওয়া সত্ত্বেও একটি বিশেষ মহল এ ঘটনাকে পুঁজি করে অস্থির পরিস্থিতি তৈরি করেছে এবং করতে চাচ্ছে।’

গত ২০ অক্টোবর দেশব্যাপী আলোচিত ভোলার ঘটনায় সারা দেশের মানুষ যখন স্তব্ধ অবস্থায় ঠিক; সেসময়ে ঘটনার পরদিন ২১ অক্টোবর ঘটনার প্রতিবাদে বিবৃতি দিয়েছে দেশে ধর্মকে পুঁজি করে বারবার অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টাকারী জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি ড. মোবারক হোসাইন ও সেক্রেটারি জেনারেল সিরাজুল ইসলাম ওই বিবৃতিতে বলেন, ‘পুলিশের বর্বরতা ও নৃশংসতা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। নিরীহ মুসল্লিদের ওপর এমন বর্বরতায় দেশবাসী প্রচন্ড ক্ষুব্ধ। ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের চন্দ্র মোহন বৈদ্দের ছেলে বিপ্লব চন্দ্র শুভর ফেসবুক আইডি থেকে তার বন্ধু তালিকার বেশ কয়েকজনের কাছে আল্লাহ এবং রাসুলকে (স.) অবমাননা করে কুরুচিপূর্ণ ভাষায় মেসেজ আসে। এই ন্যক্কারজনক উসকানিমূলক ধর্মদ্রোহী কাজের প্রতিবাদ ও কটূক্তিকারীকে গ্রেফতারের দাবিতে সাধারণ মুসল্লিদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশ বিনা উসকানিতে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে কিশোর ছাত্রসহ ৫ মুসল্লিকে। একটি শান্তিপূর্ণ সমাবেশে নিরীহ মুসল্লিদের ওপর গুলি করে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে পুলিশ বর্বরতা ও নির্মমতার যে পরিচয় দিয়েছে, তার নিন্দা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। এর আগেও পুলিশ এমন বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। এ বর্বরতা কোনো পুলিশের কাজ হতে পারে না, বরং তা ঘাতকের কাজ। প্রতিটি হত্যাকান্ডে জড়িত পুলিশ সদস্যরা জনগণের কাছে চিহ্নিত।’ ঘটনার পরদিন সংবাদপত্রে পুলিশকে একতরফাভাবে দায়ী করে তাদের এ ধরনের বিবৃতি কী প্রমাণ করে! এখন পুলিশের একমাত্র ও প্রধান কাজ শান্তিময় আমাদের দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির চেষ্টাকারীদের মদদদাতা বা পৃষ্ঠপোষকদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা।

এদিকে ঘটনার পর বিচারপতি মোহাম্মদ গোলাম রাব্বানী, ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম, সাংবাদিক কামাল লোহানী, শাহরিয়ার কবির ও অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা একটি বিবৃতি দিয়েছেন। তারা বলেছেন, ‘গত ২০ অক্টোবর ভোলায় সংঘটিত সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা ধারাবাহিক পরিকল্পিত অপচেষ্টার অংশ। ফেসবুককে আশ্রয় করে গুজব ছড়িয়ে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়া এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ও ভীতিকর হুমকি প্রদানকে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলো একটি নিয়মিত কৌশলে পরিণত করেছে। ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়সহ যেকোনো ইস্যুতে কেউ সংক্ষুব্ধ হলে দেশের প্রচলিত আইনি প্রক্রিয়ায় প্রতিকার চাইবার সব সুযোগ রয়েছে। আইনের প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে যারা ধর্মীয় ইস্যুতে গুজব ছড়িয়ে সামাজিক উত্তেজনা ও অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চায়। তারা মূলত অসাম্প্রদায়িক, শান্তিপূর্ণ এবং সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ার শত্রু।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন রাসুল (স.) অবমাননা মেনে নেওয়া হবে না। এ ঘটনা যেই করে থাকুক, তাকে আইনের কাটগড়ায় দাঁড়াতেই হবে।

প্রশ্ন হলোÑ আমরা কি আমাদের মানবিক গুণগুলো হারিয়ে ফেলছি। কারো মাঝেই কোনো সহিষ্ণুতা নেই। জবাবদিহিরও যথেষ্ট অভাব রয়েছে। ভোলার ঘটনাটি অত্যন্ত দুঃখজনক। প্রযুক্তি ব্যবহার বা অপব্যবহার করে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এ ধরনের ঘটনায় সম্প্রীতির পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। আমাদের হাজার বছরের ইতিহাস ও সংস্কৃতি অসাম্প্রদায়িক। এ ঘটনায় যারা দায়ী তাদের অনেককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। বাকিদের খুঁজে বের করার প্রক্রিয়া চলছে। যার ফেসবুক আইডি থেকে পোস্ট করা হয়েছে, সেই বিপ্লবও রয়েছে পুলিশের খাঁচায়। তার পরও পুলিশের ওপর হামলা করা হয়েছে। যারা ধর্মীয় উগ্রবাদ ছড়িয়েছে, তারা নিজেরা লাভবান হয়েছে। দেশের লাভ হয়েছে কি কোনো কিছু? এখন দেশের সাধারণ নাগরিকদের কাজ হলো কোনোভাবেই ধর্মীয় উসকানি যেন আর না হয়; সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আসলে এখন আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি, যেকোনো সময় যেকোনো ঘটনা ঘটে যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, ধর্মকে পুঁজি করে যারা ফায়দা হাসিল করতে চায়, তারা এখনো তৎপর রয়েছে। তাই দেশের মানুষের জানমাল রক্ষায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরো অধিক তৎপর হতে হবে।

লেখক : কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close