এ টি এম মোসলেহ্উদ্দিন

  ২৩ আগস্ট, ২০১৯

বিশ্লেষণ

চামড়াশিল্পের অস্থিরতার অবসান হোক

দেশের ইতিহাসে গত ৩১ বছরের মধ্যে এবারের ঈদুল আজহায় কোরবানি হওয়া পশুর চামড়ার দাম অনেক কম। এ নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা চলছে। চামড়া ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, এবারের চামড়ার দাম স্মরণকালের মধ্যে সর্বনি¤œ। দাম না পেয়ে অনেকেই কোরবানির পশুর চামড়া ফেলে দিয়েছেন। অনেকেই চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলেছেন। এমন ঘটনা ঘটেছে নীলফামারী, সুনামগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। বিভিন্ন এলাকায় চামড়া কেনার লোক না পাওয়া যাওয়াতে সারা দিন অপেক্ষার পর বাধ্য হয়েই কোরবানিদাতাদের পশুর চামড়া পুঁতে ফেলতে হয়েছে। খুচরা চামড়া ব্যবসায়ী ও মৌসুমি কাঁচা চামড়া সংগ্রহকারীরা ন্যূনতম দর দিয়েও ট্যানারি মালিক ও পাইকারদের কাছে চামড়া বিক্রি করতে না পেরে রাগে-দুঃখে ও হতাশায় ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়কের ওপর চামড়া ফেলে দিয়ে বাড়ি ফিরে চলে যান। এই অবস্থাকে কেউ বলছেন সিন্ডিকেট, কেউ বলছেন অন্তরালের খেলা!

এবার গরুর কাঁচা চামড়ার দাম ঢাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি বর্গফুট ৪৫-৫০ টাকা। ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট ৩৫-৪০ টাকা। সারা দেশে খাসির চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি বর্গফুট ১৮-২০ টাকা এবং বকরির চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয় প্রতি বর্গফুট ১৩-১৫ টাকা। বিগত বছরগুলোতে নামাজের পরপরই রাজধানীসহ দেশের বড় বড় শহরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় অসংখ্য খুচরা ও মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ীর ভিড় দেখা গেলেও এবার তাদের দেখা মেলেনি। কাঁচা চামড়ার খুচরা ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন ট্যানারির মালিক ও পাইকারদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে ও সরকার নির্ধারিত দরে চামড়া ক্রয়ের কাজে নেমে পড়তেন। কিন্তু এবার খুচরা ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা এ ধরনের কোনো অগ্রিম টাকা পাননি, এমনকি ট্যানারির মালিক ও পাইকারদের কাছ থেকে কোনো দরও পাননি। তবে এরই মধ্যে যেসব মৌসুমি ব্যবসায়ী চামড়া কিনেছেন, তারা খুবই অল্প দামে কিনেছেন, যা সরকার নির্ধারণ করে দেওয়া দামের চেয়েও অনেক কম।

অতীতে কোরবানির আগে সংবাদমাধ্যমের দ্বারা সরকারের কিছু দৃশ্যমান উদ্যোগ দেখা যেত। কিন্তু এবার শুধু চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দেওয়া ছাড়া তেমন কোনো উদ্যোগ সাধারণ মানুষের গোচরীভূত হয়নি। ঈদুল আজহার আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ব্যাংকিং সেক্টরের দ্বারা চামড়া ক্রয় ও সংগ্রহের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের ঋণ দেওয়া হতো। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে চামড়া সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রফতানিসহ বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো। অতীতে বিভিন্ন ব্যাংক কোরবানির আগে ঘোষণা দিয়ে চামড়া শিল্পসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের ঋণ দিত। কিন্তু এ বছর এ ধরনের কোনো উদ্যোগ সাধারণ মানুষের নজরে আসেনি। কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিনমার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি দেলোয়ার হোসেন সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের হাতে এ মুহূর্তে সব চামড়া কেনার মতো টাকা নেই। ফলে মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে এবার সব চামড়া হয়তো আমরা কিনতেই পারব না।’

ঈদের পর গত বুধবার ট্যানারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএ) এক সংবাদ সম্মেলনে জানায়, ‘কাঁচা চামড়া রফতানির সরকারি সিদ্ধান্তে শতভাগ দেশীয় চামড়াশিল্প হুমকির মুখে পড়বে। এ খাতে সাত হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়বে। সাভারে আধুনিক চামড়া শিল্পনগরী প্রয়োজনীয় কাঁচামালের অভাবে সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে যাবে। কাঁচামাল না পেলে এ শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে জড়িত জনগোষ্ঠী বেকার হয়ে যাবে। দেখা দিতে পারে শ্রমিক অসন্তোষ। তাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নেওয়া কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।’ অন্যদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেছেন, ‘চামড়ার দাম কমে যাওয়ার পেছনে ব্যবসায়ীদের কারসাজি আছে।’ আবার সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেছেন, ‘চামড়ার দাম নিয়ে সিন্ডিকেটের বিষয়টি নিরপেক্ষভাবে জানা দরকার। সিন্ডিকেটের একটা ব্যাপার আমাদের দেশে আছে। ফায়দা লোটার জন্য একটা মহল সিন্ডিকেট করে। এ ধরনের কিছু হয়েছে কি না, সেটা খোঁজখবর নিয়ে জানাব। যার বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ পাওয়া যাবে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেউ রেহাই পাবে না।’

এসব বিষয় পর্যালোচনা করলে দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। একটা হলো বড় ধরনের সমন্বয়ের অভাব, আরেকটি বিষয় হলো সিন্ডিকেটের কারসাজি। ট্যানারি মালিক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের বক্তব্যের আলোকে বোঝা যায়, তারা এবার অর্থায়নের অভাববোধ করেছে এবং কাঁচা চামড়া রফতানির সরকারি সিদ্ধান্ত তাদের কাছে ব্যবসাবান্ধব ও শিল্পবান্ধব মনে হয়নি। এখানে যথাযথভাবে সরকারি তদারকির অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো যদি ঈদুল আজহার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে একটা ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারত, তাহলে চামড়াশিল্প এ ধরনের বিপর্যয় এড়াতে পারত। অন্যদিকে সরকারের দুজন মন্ত্রী সিন্ডিকেটের কারসাজির কথা বলছেন। সরকারের হাতে তো চৌকস গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে। সেগুলোর মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে সে আলোকে আগেই যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারত। এবং সিন্ডিকেট বা কারসাজি হয়ে থাকলে কার স্বার্থে হয়েছে তা খতিয়ে দেখে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। এখানেও কেমন জানি একটা সমন্বহীনতার অভাব রয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, এবারের কোরবানির পশুর চামড়া খুব একটা ক্রয়-বিক্রয় করা সম্ভব হয়নি, বেশির ভাগ চামড়া ক্রয়-বিক্রয় না হওয়ার কারণে নষ্ট হয়ে গেছে এবং ফেলে দেওয়া হয়েছে বা মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে। যদি সিন্ডিকেটের লোকজন চামড়া ক্রয় করত, তাতে কিছুটা হলেও চামড়ার দাম পাওয়া যেত। এখানে কেমন যেন একটা অদৃশ্য রহস্য থাকতে পারে। বেশ কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, অস্থির ব্যাংকিং খাত, বিপর্যস্ত শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীরা, কৃষকরা ধানের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে ধানখেতে আগুন দিচ্ছেন, এখন চামড়া ব্যসায়ীরা কাঁচা চামড়া রাস্তায় ফেলে বা মাটিতে পুঁতে ফেলছেন। এগুলো কখনোই একটা দেশের সার্বিক ব্যবস্থায় ইতিবাচক নয়। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য এক ধরনের অশনিসংকেত। ইসলাম ধর্মীয় রেওয়াজ অনুযায়ী কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির টাকা কোরবানিদাতারা গরিব, মিসকিন, অসচ্ছল, অভাবী, দুঃখী, দুস্থ ও এতিমদের দান করে থাকেন। এবারের কোরবানিদাতারা পশুর চামড়া ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করতে পারেননি। এর ফলে ভয়াবহভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে গরিব, মিসকিন, অসচ্ছল, অভাবী, দুঃখী, দুস্থ ও এতিমরা। ধর্মীয় মতে, মিসকিন, অসচ্ছল, অভাবী, দুঃখী, দুস্থ ও এতিমদের অধিকার বা হক আত্মসাৎকারীদের পরিণাম খুবই কঠিন হবে।

পশুর চামড়া আমাদের দেশের জাতীয় সম্পদ। দেশের রফতানি আয়ের দ্বিতীয় বড় খাত চামড়াশিল্প। এ শিল্পের প্রায় ৮০ শতাংশ কাঁচামালের জোগান আসে কোরবানির ঈদে। চামড়াশিল্পকে টিকিয়ে রাখা শুধু নয়, বিকশিত করতে হলে এ শিল্পে জড়িতদের সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা না হলে পাটশিল্প যেমন ধ্বংস হয়ে গেছে, চামড়াশিল্পও একসময় ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। যাদের কারণে কোরবানির পশুর চামড়ার এই ভয়াবহ অবস্থা এবং গরিব ও এতিমদের হক যারা নষ্ট করল, তাদের বিরুদ্ধে সরকারের কঠোর থেকে কঠোরতর ব্যবস্থা নেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে এ ব্যবস্থা গ্রহণ হতে পারে অর্থনীতির পরিমন্ডলে এক উজ্জ্বল এবং ইতিবাচক দৃষ্টান্ত।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close