মোহাম্মদ আবু নোমান

  ১৯ এপ্রিল, ২০১৯

মতামত

বাণিজ্যের জায়গা নয় শিক্ষাঙ্গন

কোনো সন্ত্রাসীদের জন্য শিক্ষাঙ্গন বন্ধ হতে পারে না। বরং শিক্ষাঙ্গন থেকে সন্ত্রাসীদের বিতাড়িত করতে হবে। সে শিক্ষক নামধারী হোক বা ছাত্র অথবা যেকোনো রাজনৈতিক পরিচয়ে থাকুক! দেশের প্রতিটি উচ্চ শিক্ষাঙ্গনই পড়াশোনা ও গবেষণার স্থান। বাণিজ্য করার জায়গা নয়। কঙ্কাল বিক্রির ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের দুপক্ষের সংঘর্ষে রাজশাহী ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি (আইএইচটি) অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।

এসব ছাত্র পড়াশোনা করতে গেছেন, নাকি কঙ্কালের ব্যবসায়? এ ধরনের কেনা-বেচা নিয়ে রাজশাহীর আইএইচটির মতো ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাঙ্গনে সংঘাত, সংঘর্ষ ও অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা মেনে নেওয়া যায় না। রুচিতে না এলেও বলতে হয়, কঙ্কাল ও হাড্ডি নিয়ে কুকুরের কামড়াকামড়ি স্বাভাবিক! আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন ‘চির উন্নত মমশির’। অথচ আইএইচটির ঘটনায় লজ্জায়, অপমানে, আমাদের গোটা জাতিই ‘নতশির’ হয়ে পড়েছে। শেষ পর্যন্ত জাতির মেধাবীরা কঙ্কালকেও ছাড় দিল না! অর্থাৎ কঙ্কাল আর হাড় নিয়েও ‘কামড়াকামড়ি’ করে ১১ জন রামেক হাসপাতালে ভর্তি ও ২ জন আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছে!

দেশের বড়রা যখন ইট, বালু, পাথর, কয়লা, সোনা, ব্যাংক, রিজার্ভ, শেয়ার মার্কেট নিয়ে অবৈধ বাণিজ্য করতে পারেন; যে দেশে সংযোগ সড়ক, রাস্তা ও প্রয়োজন ছাড়া কথিত ‘ভূতের সেতু’ তৈরি হয়; যারা রডের বদলে বাঁশ, ঘুষের টাকা গুনেগুনে নিতে পারেন; যে বাঙালিরা গ্যাসের সঙ্গে বাতাসের ভেজাল করতে পারেন; তাদের উত্তরসূরিরা কঙ্কাল বাণিজ্য কেন, পুরো দেশও বিক্রি করতে পারেন! এসব শিক্ষার্থীই তো দেশের পরবর্তী নেতা-নেত্রী তথা ভবিষ্যৎ! বাণিজ্য করতে গিয়ে পড়ালেখা লাটে উঠিয়ে, দলীয় পাওয়ার ও ঘুষ বাণিজ্যে চাকরি লাভের পর; গজ, ব্যান্ডেজ, কাঁচি পেটে রেখেই অপারেশন সমাপ্তি করবে এতে আশ্চর্য হওয়ার কী?

এজন্য শুধু বাংলাদেশেই দেখা যায়, একজন মন্ত্রী, এমপি, একজন প্রধান প্রকৌশলী, পুলিশ কর্মকর্তা, বিসিএস ক্যাডার, সচিব, আমলা হয়েও নানা কুকীর্তির নজিরে ভরপুর। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে, ‘দ্য লাস্ট জ্যাকেট হ্যাজ নো পকেট’। অর্থাৎ ‘শেষ পিরানের (কাফনের) পকেট নেই’। বলা হয় যে, মানুষের সাধ মিটবে না সেই পর্যন্ত, যে পর্যন্ত না তার মুখে মাটি পড়বে। অর্থাৎ মৃত্যু হয়ে কবরে না পেঁৗঁছবে। লেভ তলস্তয়ের লেখা বিখ্যাত গল্প ‘হাউ মাচ ল্যান্ড ডাজ অ্যা ম্যান রিকয়ার’। গল্পটিতে দেখা যায়, একজন মানুষ লোভের তাড়নায় অঢেল জমির দখল পেতে চায় এবং ঘোড়ায় চড়ে বেড় দিয়ে বিশাল জমির দখল নিতে সে প্রাণান্ত ছুটে চলছে। অতিমাত্রায় ছোটাছুটি করে ক্লান্ত ঘর্মাক্ত মানুষটি অবশেষে তার সদ্য অবৈধ দখলে নেওয়া জমির কিনারে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। লোকজন জমিলোভী মৃত মানুষটিকে তার জমিতে কবর দিয়ে দেয়। লোভী মানুষটি বিশাল বেড় দিয়ে সহস্র হেক্টর জমির দখল পেলেও মরার পরে লোকটি নিজের কবরের জন্য সাড়ে তিন হাত জমির বেশি দখল করতে পারেননি!

পেটের দায়ে যখন কেউ কবরের কঙ্কাল চুরি করে, তখন সর্বত্রই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও কঠোর শাস্তির দাবি করে থাকেন। আজ যারা উচ্চশিক্ষা করতে এসে কঙ্কালের ব্যবসা করছেন, এরাই যে এক দিন জীবন্ত মানুষের শরীরের পার্টস চুরি করে বাণিজ্য করবেÑ এটাই তো স্বাভাবিক! রক্ত পিপাসায় হায়েনা যেমন লোভাতুর থাকে, কোনো শিক্ষার্থীও যদি সে রকম টাকার পিপাসায় অস্থির থাকে, তা হলে তাকেই শিক্ষাঙ্গন থেকে বহিষ্কার করতে হবে। শিক্ষাঙ্গন বন্ধ হতে পারে না। এটাই যেকোনো সুস্থ ও বিবেকবান মানুষের কথা।

রাজশাহীর আইএইচটি কর্তৃপক্ষের নোটিসে বলা হয়েছে, ‘আইএইচটিটির একাডেমিক কাউন্সিলের এক জরুরি সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে গুরুতর আহত অবস্থায় ১১ জন শিক্ষার্থীকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পরবর্তী অবস্থা আরো অবনতি এবং রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কায় ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাস বন্ধ ঘোষণা করা হলো। সেই সঙ্গে ডিপ্লোমা কোর্স জানুয়ারি-২০১৯-এর অবশিষ্ট মৌখিক পরীক্ষাসমূহ এবং বিএসসিসহ ডিপ্লোমা কোর্সের সব বর্ষের ক্লাসসমূহ স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে।’ অধ্যক্ষ ফারহানা হক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে জানান, পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার আশঙ্কায় ইনস্টিটিউট বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।

ওই দিনকার ঘটনা বর্ণনায় আইএইচটির শিক্ষার্থীরা গণমাধ্যমকে জানান, ‘তৃতীয় বর্ষের তিনজন শিক্ষার্থী প্রতিষ্ঠানের দুই নম্বর গ্যালারিতে কঙ্কাল বিক্রির জন্য প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে যান। এই তিনজন শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের আইএইচটি শাখার সাধারণ সম্পাদক ওহিদুজ্জামানের অনুসারী। সেখানে সভাপতির অনুসারী প্রথম বর্ষের ছাত্র সাইফুল ইসলামের সঙ্গে ওই তিন শিক্ষার্থীর কথা কাটাকাটি হয়। তিন শিক্ষার্থী বেরিয়ে চলে আসেন। তারা সভাপতির কাছে মীমাংসার জন্য যান। সেখানেই দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষে আহত ছাত্রলীগের ১১ নেতাকর্মীকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

এ কথা ঠিক, দেশে শিক্ষাঙ্গন ও শিক্ষার হার বেড়েছে। কিন্তু সৎ, সুশিক্ষিত ও বিবেকবান মানুষের সংখ্যা বাড়েনি। যার কারণে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আজ মানুষ একে অপরকে হত্যা করছে। এত দিন শুনতাম ‘চায়ের কাপে ঝড়’! এখন দেখা গেলো ‘চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসা নিয়ে ঝড়’! প্রথমে ঝগড়া, পরে সংঘর্ষ। একজনের প্রাণ চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে এর পরিসমাপ্তি। ঘটনাস্থল হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার বশিনা বাসস্ট্যান্ড এলাকা। গ্রামের মাইকে ঘোষণা দিয়ে বশিনা ও দ্বিমুড়া গ্রামের লোকজন সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এ সময় উভয় পক্ষ লাঠিসোঁটা, বল্লম, টেঁটা, ধারালো অস্ত্র ও ইটপাটকেল ব্যবহার করে। সংঘর্ষের ঘটনায় গুরুতর আহত জহুর আলী (৬০) নামে একজন প্রাণ হারিয়েছেন।

লাভ রিঅ্যাক্ট নিয়ে যেখানে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে মারামারি হয়, কঙ্কাল নিয়ে মারামরি হয়, সেখানে চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসা নিয়ে মারামারি হতেই পারে। চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেওয়ার মতো এত সময় পৃথিবীর আর কোনো দেশের মানুষের আছে বলে মনে হয় না! অলস মাথায় ভালো কিছু আসে না, হবিগঞ্জের ঘটনা তারই প্রমাণ।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close