হাসান জাবির

  ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৮

বিশ্লেষণ

ইউক্রেন প্রশ্নে মুখোমুখি ন্যাটো-রাশিয়া

বরফের দেশ রাশিয়া। বিশাল আয়তনের এই দেশটি গত মে মাসে উদ্বোধন করে ইউরোপের সর্ববৃহৎ একটি সেতু। এই সেতুটি মূলত রাশিয়ার দক্ষিণ উপকূল থেকে ক্রিমিয়ার সঙ্গে সরাসরি সংযোগ রক্ষা করবে। প্রায় ১৬ কিমি দৈর্ঘ্যরে কিছুটা ‘ওভারব্রিজ’ মতো এই সেতুটির অবস্থান কের্চ প্রণালির ওপরে। অন্যদিকে সংকীর্ণ কের্চ প্রণালি হচ্ছে আজভ সাগর ও কৃষ্ণ সাগরের মধ্যকার যোগাযোগ রক্ষার একমাত্র সমুদ্রপথ। ২০০৩ সাল রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে সম্পাদিত এক চুক্তির আওতায় এই জলরাশিতে অবাধ চলাচলের সুযোগ পায় ইউক্রেন। এছারাও ওই চুক্তিতে এই জলরাশির অধিকার সংক্রান্ত বেশ কিছু বাধ্যবাধকতা অনুসরণ করতে হয় উভয় দেশকেই। ঘটনার সুত্রপাত হয় এ বছরের শুরুতে। তখন অর্থাৎ গত জানুয়ারি মাসে কয়েকটি রাশিয়ান জাহাজ ইউক্রেন নেভীর আক্রমণের শিকার হয়। ফলে কিয়েভের উপর ক্ষিপ্ত মস্কো পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ওই অঞ্চলে মেরিন টহল বৃদ্ধি করে। একই সঙ্গে ক্রেচ প্রণালী হয়ে আজভ সাগর ও কৃষ্ণ সাগরে যাতায়াতকারী সব ইউক্রেনীয় জাহাজে তল্লাশি শুরু করে। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক বাক বিতন্ডার সুত্রপাত হয়। যদিও দেশদুটির মধ্যে গত কয়েক বছর ধরেই চলছে নানা ধরনের উত্তেজনা। মুলত ক্রিমিয়ার রুশ অন্তর্ভুক্তি ও ইউক্রেনের আরও দুটি অঞ্চলের স্বাধীনতার দাবিকে কেন্দ্র করেই ২০১৪ সাল থেকেই মস্কো ও কিয়েভের মধ্যকার সম্পর্ক ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ সময় অতিক্রম করছে।

এসব ঘটনাবলীর মধ্যেই গত ২৫শে নভেম্বর ইউক্রেন নেভীর তিনটি জাহাজ আটক করে রাশিয়ান কোস্টগার্ড। একই সঙ্গে তিন জাহাজের ২৬জন নাবিককেও বন্দি করে রাশিয়া। অন্যদিকে এই অভিযান চলাকালে কের্চ প্রণালি ও আজভ সাগরে রীতিমতো যুদ্ধের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এ সময় রাশিয়ান কোস্টগার্ডের গুলিতে আহত হয় তিনজন ইউক্রেনীয় নাবিক। রাশিয়ার এই তৎপরতাকে ‘বেআইনি ও পাগলামি’ বলে আখ্যায়িত করে কিয়েভ। এ পর্যায়ে ইউক্রেন তাদের নাবিক ও জাহাজ ফিরে পেতে ইউরোপ, আমেরিকা ও ন্যাটোর মাধ্যমে রাশিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করে। পক্ষান্তরে মস্কোর দাবিÑ ‘সতর্ক সংকেত উপেক্ষা করে বেপরোয়াভাবে চলাচল করায় তাদের কোস্টগার্ড গুলি চালিয়ে ইউক্রেনের জাহাজগুলো আটক করতে বাধ্য হয়েছে।’ ইতিমধ্যে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যকার উত্তেজনা মারাত্মক আকার ধারন করেছে। আবার ইউক্রেনের পক্ষে এই ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছে আমেরিকা, ইউরোপ ও ন্যাটো। ফলে আবারো কৃষ্ণ সাগরীয় এলাকায় যুদ্ধের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

ষোলো শ শতক থেকেই ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার সার্বভৌম আধিপত্য প্রতিষ্টিত হয়। বিভিন্ন পরিক্রমায় রুশ বিপ্লব উত্তর এই অঞ্চলটি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠে। আবার ১৯৯১ সালে সোভিয়েত বিলুপ্তির পর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ইউক্রেন। তখন থেকেই ইউক্রেন আন্তর্জাতিক রাজনীতির মনোযোগ আকর্ষণ করে মূলত দুটি কারনে। প্রথমত- ইউক্রেনে অবস্থিত তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মজুদ পরমানু অস্ত্রশস্ত্র এবং বিদ্যমান অবকাঠামোর ভবিষ্যৎ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক উৎকণ্ঠা। ২য় কারণটি ক্রিমিয়া অঞ্চলের সার্বভৌমতব সংক্রান্ত। দুটি বিষয়ই রাশিয়ার কাছে অত্যন্ত স্পর্শকাতর। যদিও পরমাণু অস্ত্রশস্ত্র সংক্রান্ত বিষয়ে আমেরিকা, ইউরোপ ও ন্যাটোর সমান উদ্বেক বিরাজমান ছিল। ফলে গুরুত্বপূর্ণ ওই সকল পক্ষের মধ্যে বিস্তর আলোচনা শেষে বেশ কিছু শর্তসাপেক্ষে ক্রিমিয়া ইউক্রেনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে কিয়েভের অঙ্গীভূত হয়। অন্যদিকে ইউক্রেন এই মর্মে তার হাতে থাকা সকল পরমাণু অস্ত্রসমূহ রাশিয়ার কাছে ফেরত দিতে সম্মত হয় যে- ভবিষ্যতে ইউক্রেনের নিরাপত্তা সংকট দেখা দিলে এবং অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণে আমেরিকা, ন্যাটো ও ইইউ এর সঙ্গে আলোচনা করতে পারবে কিয়েভ ।

বিশাল দেশ রাশিয়ার বেশির ভাগ সামুদ্রিক অঞ্চল বছরের উল্লেখযোগ্য সময় বরফ আচ্ছাদিত থাকায় সেগুলো অপেক্ষাকৃত কম ব্যবহার উপযোগী। যে কারণে ইতিহাসের উল্লেখযোগ্য সময় থেকেই রাশিয়ার কাছে কৃষ্ণসাগর, আজভ সাগর, আজিয়ান সাগর ও বাল্টিক সাগর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে ক্রিমিয়ায় রুশ নেভির বিশাল উপস্থিতি অবস্থিত স্মরণযোগ্য। ব্লাক সি ফ্লিট নামের এই নৌঘাঁটি রাশিয়ার জাতীয় সক্ষমতার প্রধানতম অনুষঙ্গ। এ ক্ষেত্রে ২০১৪ সালের আগে ইউক্রেনের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রুশ বিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। এদিকে ২০১০ সালে ক্রিমিয়ায় রুশ নেভীর উপস্থিতির মেয়াদ অবসান হওয়ার প্রাক্কালে তা নবায়ন করা না করা সংক্রান্ত বিষয়ে একধরনের অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। এ পর্যায়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ইয়েশ্চেংকু পরবর্তী ৩৫ বছরের জন্য আবারো ক্রিমিয়ায় রুশ উপাস্থিতি সংক্রান্ত লীজের নবায়ন করলে পরিস্থিতি দ্রুতই পাল্টে যায়। ওই সব ঘটনাকে কেন্দ্র করে পদচ্যুত হন প্রেসিডেন্ট ইয়েশ্চেংকু। এক্ষেত্রে ইউক্রেনের তিনটি অঞ্চল ক্রিমিয়া, লোহানস্ক, দোনেতসক প্রজাতন্ত্র মস্কোর প্রত্যক্ষ মদদে একযোগে স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এ পর্যায়ে ক্রিমিয়ার জনগণ এক গণভোটের মাধ্যমে ১৯৫৪ সালের পর আবারো মূল ভূখন্ড রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়। কিন্তু ইউক্রেন, আমেরিকা, ইউরোপ ক্রিমিয়ার গণভোটের বৈধতা নিয়ে আপত্তি তুলে। তারা এটিকে রাশিয়ার আগ্রাসন হিসেবে অভিহিত করে মস্কোর উপর নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করে। এধরনের প্রেক্ষাপটেই ন্যাটো গত তিন বছরে পূর্ব ইউরোপ ব্যাপকভিত্তিক সামরিক মোতায়েনের মাধ্যমে রাশিয়াকে চ্যালেঞ্জ জানায়। উল্লেখ্য ২০১৪ সালে ইয়েশ্চেংকুর ক্ষমতাচ্যুতির পর কিয়েভের ক্ষমতা দখল করে পশিমাপন্থী একদল রাজনীতিক। যারা রাশিয়ার পরিবর্তে ইইউ, আমেরিকা ও ন্যাটোর সঙ্গে সম্পর্ক জোড়দার করতে সচেষ্ট। এদিকে চলমান উত্তেজনা প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোকে আরও সতর্ক হওইয়ার আহ্বান জানিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। তিনি জি-২০ সম্মেলনে সরাসরি বলেন যে- ইউক্রেনের ক্ষমতার দৃশ্যপট থেকে পশ্চিমাপন্থীরা সরে না গেলে আঞ্চলিক অস্থিরতা অব্যাহত থাকবে।

এখন গুরুতবপুর্ন প্রশ্ন হচ্ছে রুশ- ইউক্রেন সংকটের বাস্তবতায় আঞ্চলিক পরিসরে কি প্রতিক্রিয়ার অবতারনা করবে। ন্যাটো কিংবা আমেরিকা খুব ভালো ভাবেই উপলদ্ধি করতে সক্ষম যে- এই অঞ্চলে রাশিয়া তার সবার্থকে কোন কারনেই জলাঞ্জলি দিবেনা। এক্ষেত্রে তাদের বিবেচনায় আরও যে বিষয়টি অগ্রাধিকার পায় সেটি হচ্ছে ইউক্রেনের মোট জনসংখ্যার ২৪ ভাগই রুশ বংশদোভুত। যারা রিতিমতো রাশিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল। এই বাস্তবতা ইউক্রেনের আভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সংক্রান্ত নানা সম্ভাবনাকে সামনে আনে। সেগুলো আমলে নিলে যা প্রতীয়মান হবে তা হচ্ছে অদূর ভবিশ্যতে কিয়েভের ক্ষমতার দৃশ্যপটে ফিরে আসতে পারে রুশপন্থীরা। সেক্ষেত্রে ইউক্রেনের সঙ্গে পশ্চিমাদের সম্পর্কের উষ্ণতা ভাটা পরতে পারে। যেকারনে পশ্চিমারা বর্তমান প্রেসিডেন্ট পেরোশেংকো ও তার সঙ্গীদের দিয়ে রাশিয়াকে ডিস্টার্ব করে নিজেদের অবস্থান সংহত করছে। পক্ষান্তরে রাশিয়া ইউক্রেনের পক্ষ থেকে আসা উসকানিগুলোকে সামরিক কায়দায় মোকাবেলা করে ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। এখানে লক্ষনীয় যে ২৫শে নভেম্বরের ঘটনার পরপরই মস্কো তার অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে কৃষ্ণ সাগরীয় এলাকায় ব্যপক সামরিক মহড়া শুরু করেছে। অন্যদিকে ইউক্রেন এই সুযোগে আজভ সাগরে তার আইনগত অধিকারের প্রশ্নে ন্যাটোর সাহায্য প্রত্যাশা করে বিবৃতি দিয়েছে। খুব সাধারনভাবেই আমরা উপলদ্ধি করছি ইউক্রেনের দাবীর প্রেক্ষিতে ন্যাটো কিছু একটা করবে। এক্ষেত্রে ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা হবে প্রধান বিবেচনা। যে প্রক্রিয়ায় আঞ্চলিক পরিস্থিতিতে ন্যাটো রাশিয়ার মুখোমুখী লড়াই আরও সম্প্রসারিত হবে। আর ইউক্রেনকে ঘিরে এ ধরেনের তৎপরতা অব্যাহত থাকলে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা স্থায়ীরূপ নেবে; যা যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়াতেই থাকবে।

লেখক : আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close