মুফতি জাকারিয়া হারুন

  ০৩ আগস্ট, ২০১৮

হজ

মহাপুণ্যের ঘোষণা

প্রভুপ্রেমের নিদর্শন। বিশ্বমুসলিমের সম্মিলন। ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার মাধ্যম। মহান আল্লাহ সামর্থবান ব্যক্তিদের ওপর হজ ফরজ করেছেন। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘প্রত্যেক সামর্থবান ব্যক্তির ওপর মহান আল্লাহর জন্য বায়তুল্লাহর হজ করা ফরজ, (সুরা- আল ইমরান, আয়াত- ৯৭)।’ হজ আর্থিক ও শারীরিক ইবাদত। হজ পালন ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। আর ভালোবাসায় কষ্ট-ক্লেশ সবই হাসিমুখেই মেনে নেয়। তাই এতে রয়েছে বহু সওয়াব। হজ সর্বোত্তম আমল। এ মর্মে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিতÑ তিনি বলেন, প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলো, সর্বাধিক উত্তম আমল কোনটি? তিনি বললেন, আল্লাহ ও তার রাসুলের ওপর ঈমান আনয়ন করা। পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো, এরপর কোনটি? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করা। পুনরায় জিজ্ঞেস করা হলো, তারপর কোনটি? তিনি বললেন, হজে মাবরুর বা মকবুল হজ, (বুখারি শরিফ, হাদিস : ১৪২৯)।’ হজ আদায়ের জন্য বের হয়ে মারা গেলে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর সে কিয়ামত অবধি হজের সওয়াব লাভ করবে। প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি হজ, ওমরাহ অথবা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের উদ্দেশে বের হয়, অতপর পথিমধ্যে তার মৃত্যু হয়ে যায়, তাহলে আল্লাহ তায়ালা তাকে গাজি, হাজি ও ওমরাকারীর সওয়াব দান করবেন, (মিশকাত শরিফ, হাদিস : ২৫৩৯)।’ হজ মানুষকে পূত-পবিত্র করে নতুন জীবনে ফিরিয়ে আনে। প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনোরূপ অশ্লীল কথা বা গুনাহের কাজে লিপ্ত না হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে হজ সম্পন্ন করে, সে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ঘরে ফিরে আসে, (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৫২১)।’

প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো, কোন আমল সর্বোত্তম? তিনি বললেন, এক আল্লাহ তায়ালার প্রতি ঈমান আনা। তারপর জিহাদ করা। অতপর কবুল হজ অন্যান্য আমল হতে এত উৎকৃষ্ট ও মর্যাদাপূর্ণ যেরূপ সূর্যের উদয়াচল হতে অস্তাচলের ব্যবধান, (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ১৯০১০; মাজমাউয যাওয়াইদ, হাদিস : ৫২৬৩)।’ হাজিগণ আল্লাহর মেহমান। ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহর পথে জিহাদকারী এবং হজ ও ওমরা পালনকারীরা আল্লাহর মেহমান। আল্লাহ তাদের আহ্বান করেছেন, তারা সে আহ্বানে সাড়া দিয়েছে। তারা আল্লাহর কাছে যা চাইছে আল্লাহ তাই তাদের দিয়ে দিচ্ছেন, (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৮৯৩)।’

তিন ব্যক্তি আল্লাহর মেহমান- হাজি, ওমরা পালনকারী ও আল্লাহর পথে জিহাদকারী, (সুনানে নাসাঈ)। হজ জিহাদতুল্য ইবাদাত। হাসান ইবনু আলি (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে আরজ করল, আমি একজন ভীতু ও দুর্বল ব্যক্তি। তখন তিনি তাকে বললেন, তুমি এমন একটি জিহাদে চলো যা কণ্টকাকীর্ণ নয় অর্থাৎ হজ পালন করতে চলো, (তাবারানি)। আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি তো জিহাদকে সর্বোত্তম আমল মনে করেন। আমরা (নারীরা) কি জিহাদ করতে পারব না? উত্তরে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তোমাদের জন্য সর্বোত্তম জিহাদ হলো মাবরুর হজ (কবুল হজ), (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)।’

হজ গুনাহমুক্ত করে দেয়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশে হজ করল এবং অশ্লীল কথাবার্তা ও গুনাহ থেকে বিরত থাকল সে ওই দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে হজ থেকে ফিরে আসবে, যেদিন মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল, (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৫২১)।’ হজ মানুষকে পূত-পবিত্র করে নতুন জীবনে ফিরিয়ে আনে। প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনোরূপ অশ্লীল কথা বা গুনাহর কাজে লিপ্ত না হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে হজ সম্পন্ন করে, সে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসে, (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৫২১)।’ হজরত আমর ইবনুল আসকে প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন, ‘তুমি কি জান না ইসলাম গ্রহণ করলে পূর্বের সব গুনাহ মাফ হয়ে যায়। তদ্রƒপ হিজরতকারীর আগের গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হয় এবং হজ পালনকারীও পূর্বের গুনাহ থেকে মুক্ত হয়ে যায়, (সহিহ মুসলিম : ১২১)।’ হজরত আবদুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা হজ ও ওমরা পালন কর। কেননা হজ ও ওমরা উভয়টি দারিদ্রতা ও পাপরাশিকে দূরিভূত করে যেমনিভাবে রেত স্বর্ণ, রৌপ্য ও লোহার মরিচা দূর করে দেয়। আর মাবরূর হজের বদলা হলো জান্নাত, (জামে তিরমিজি, হাদিস : ৮১০)।’

হজের বিনিময় হবে বেহেশত। হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত। প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘এ (কাবা) ঘর ইসলামের স্তম্ভস্বরূপ। সুতরাং, যে ব্যক্তি হজ কিংবা ওমরা পালনের জন্য এ ঘরের উদ্দেশে বের হবে সে মহান আল্লাহর যিম্মাদারীতে থাকবে। এ পথে তার মৃত্যু হলে আল্লাহ তাকে বেহেশতে প্রবেশ করাবেন। আর বাড়িতে ফিরে আসার তওফিক দিলে তাকে প্রতিদান ও গণিমত দিয়ে প্রত্যার্বতন করাবেন। হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, এক ওমরা থেকে অপর ওমরা পালন করার মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যে হয়ে যাওয়া পাপরাশি এমনিতেই মাফ হয়ে যায়। আর মাবরূর হজের বিনিময় নিশ্চিত জান্নাত, (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৭৭৩)।’

হজে খরচ করার ফজিলত। হজরত বুরাইদা (রা.) হতে বর্ণনা করেন, প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, হজে খরচ করা আল্লাহর পথে (জিহাদে) খরচ করার সমতুল্য সাওয়াব। হজে খরচকৃত সম্পদকে সাতশত গুণ বাড়িয়ে এর প্রতিদান দেয়া হবে, (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ২২৪৯১)। হাজির দোয়া কবুল করা হয়। হজরত জাবির (রা.) বর্ণনা করেন, প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, হজ ও ওমরাকারীগণ আল্লাহর প্রতিনিধিদল। তারা দোয়া করলে তাদের দোয়া কবুল করা হয় এবং তারা কিছু চাইলে তাদেরকে তা দেওয়া হয়, (মুসনাদে বাযযার, হাদিস : ১১৫৩)। হাজরে আসওয়াদ ও রূকনে ইয়ামানি স্পর্শ করার ফজিলত। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, আমি প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘হাজরে আসওয়াদ ও রূকনে ইয়ামানির স্পর্শ পাপসমূহকে মুছে দেয়, (সুনানে তিরমিযি, হাদিস : ৯৫৯)।’ হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস (রা.) হতে বর্ণিত প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, অবশ্যই আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন হাজরে আসওয়াদকে উঠাবেন। তার দুটি চোখ থাকবে, যা দিয়ে সে দেখতে পাবে। একটি জিহ্বা বা মুখ থাকবে, যা দিয়ে সে কথা বলবে এবং যারা তাকে যথার্থভাবে স্পর্শ করেছে তাদের পক্ষে সাক্ষ্য দেবে, (সুনানে তিরমিযি, হাদিস : ৯৬১; মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২২১৫)।’

জানার বিষয় হলো হজ কার উপর ফরজ? এর উত্তর হলো, হজ ফরজ হওয়ার জন্য শর্ত পাঁচটিÑ এক. মুসলিম হওয়া। দুই. বিবেকবান হওয়া, পাগল না হওয়া। তিন. প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া। চার. স্বাধীন হওয়া অর্থাৎ কারো গোলাম বা দাস না হওয়া। পাঁচ. দৈহিক ও আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান হওয়া।

স্মরণ রাখতে হবে যে কারো ওপর জাকাত ফরজ না হয়েও তার ওপর হজ ফরজ হতে পারে। কেননা হজ ও জাকাতের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। হজ ও জাকাতের মধ্যে পার্থক্য হলো, জাকাতের সম্পর্ক নির্ধারিত নিসাবের সঙ্গে। হজের সম্পর্ক মক্কায় আসা-যাওয়ার খরচের সঙ্গে। সুতরাং স্থাবর সম্পত্তির কিছু অংশ বিক্রি করে কেউ যদি হজ আদায় করতে সক্ষম হয় এবং হজ থেকে ফিরে এসে বাকি সম্পত্তি দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে পারে, তাহলে তার ওপরও হজ ফরজ, (ইমদাদুল আহকাম : ২/১৫২; আহসানুল ফাতাওয়া : ৪/৫১৬)। একইভাবে ব্যবসায়ীর দোকানে যে পরিমাণ পণ্য আছে, তার কিছু অংশ বিক্রি করলে যদি হজ করা সম্ভব হয় এবং ফিরে এসে যদি বাকি পণ্য দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা যায়, তাহলে তার ওপরও হজ ফরজ, (ইমদাদুল আহকাম : ২/১৫৩)।

লেখক : মুহাদ্দিস, কাপাসিয়া দারুল উলুম মাদ্রাসা, গাজীপুর

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist