মো. মাঈন উদ্দিন

  ০১ আগস্ট, ২০১৮

নারী

চোখের জলে ভাসছে বিবেক

দারিদ্র্য থেকে মুক্তি কে না চায়? এই দারিদ্র্য নামক প্রেতাত্মা থেকে মুক্তি ও আর্থিক সচ্ছলতার আশায় আমাদের দেশের অনেক নারী নিজের পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও দেশ ছেড়ে কাজের খোঁজে ভিনদেশে পাড়ি জমায় অনেক স্বপ্ন নিয়ে। এ স্বপ্নের দেশ সৌদি আরব, ইরাক, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের আরো কিছু রাষ্ট্র। ধনী দেশ। সামান্য কাজ পেলে টাকার কোনো অভাব থাকবে না, দালালরা এমন মিথ্যা প্ররোচনা আর আর্থিক সুবিধার লোভ দেখিয়ে আমাদের দেশের নারীদের বিদেশ পাঠায়। যতটা না ব্যয়, তার চেয়ে বেশি খরচ তারা হাতিয়ে নেয় নিজের বিবেককে বিসর্জন দিয়ে শুধু ব্যক্তিগত স্বার্থে। জমিজমা বিক্রি করে কিংবা ঋণের টাকা দিয়ে বিদেশে যাচ্ছে আমাদের সহজ-সরল নারীরা। কিন্তু কিছুদিন পর চরম বাস্তবতার সঙ্গে পরাজিত হয়ে সব স্বপ্নকে মরুভূমিতে বালিচাপা দিয়ে সবকিছু হারিয়ে ফিরে আসে তারা। তাদের হারানোর করুণ গল্প আর শেষ হয় না যেন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার হিসাবে মধ্যপ্রাচ্যে গৃহকর্মীর সংখ্যা প্রায় ২১ লাখ। আর বাংলাদেশের প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, সাত লাখের বেশি নারীকর্মী বিদেশে কাজের জন্য আছে। যার মধ্যে প্রায় আড়াই লাখ সৌদি আরবে নারীকর্মী হিসেবে কর্মরত আছে।

বাংলাদেশের নারীকর্মীদের ভয়াবহ নির্যাতনের কথা এখন আমরা সবাই প্রতিদিন শুনতে পাই। শারীরিক নির্যাতন, যেমন : গরম কিছু দিয়ে ছ্যাঁকা দেওয়া, বৈদ্যুতিক শক দেওয়া, গৃহকর্মীদের দ্বারা অতিরিক্ত সময় কাজ করিয়ে নেওয়া, পাসপোর্ট রেখে দেওয়া, খাবার খেতে না দেওয়া, যৌন নির্যাতন করার পাশাপাশি মানসিক নির্যাতন তো একটা নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে নিয়োগকর্তার অনুমতি ছাড়া চাকরি ছাড়াও যাবে না আবার দেশেও ফেরত আসা যাবে না। নিয়োগদাতার অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও কাজ করতে গেলে জরিমানা থেকে শুরু করে এমনকি গৃহকর্মীর নিজ দেশেও পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এসব কারণে নির্যাতনের মাত্রা অনেক। তা ছাড়া কর্মী-মালিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিল করতে গেলে কর্মীর বিরুদ্ধে তখন চুরির দায়ে মামলা করা হয়। গৃহকর্তারা যখন নির্যাতন করে, তখন আসলে সেসব নির্যাতনের রেকর্ড রাখাটা খুবই কঠিন। কারণ এগুলোর বেশির ভাগই ব্যক্তিমালিকানাধীন বাড়িতে করা হয়ে থাকে। ২০১৮ সালের মে মাসে মিডল ইস্ট আই নামক এক অনলাইন নিউজপোর্টালে বাংলাদেশি নারীদের সৌদি আরবে নির্যাতনের বিষয়ে এক রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়, যেখানে ছবিসহ নারী নির্যাতনের ঘটনা বর্ণনা করা হয়। সিএনএন, বিবিসি, হাফিংটোন পোস্ট, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো মানবাধিকার সংস্থাগুলো নিয়মিত রিপোর্ট করে যাচ্ছে সৌদির গৃহকর্মীদের এই নির্যাতনের কথা নিয়ে; কিন্তু এতে তেমন কাজ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।

এখন প্রতি মাসে বাংলাদেশে শত শত নির্যাতিত নারী ফেরত আসছে। এ বিষয়টি আসলে এখন নারী নির্যাতনের সীমা ছাড়িয়ে দেশের জন্যও অপমানজনক হয়ে গেছে। সৌদিরা জানে, আইনগতভাবে কিছু করা যাবে না তাদের বিরুদ্ধে। আমাদের দেশটাকেও এ ধরনের আচরণের দ্বারা তারা যথেষ্ট অপমান করে যাচ্ছে। তবে নির্যাতন বাড়ার ফলে যে নারীশ্রমিক যাওয়ার সংখ্যা কমবে, সেটা হয়তো না। কারণ অনেক নারীশ্রমিক এসব নির্যাতনের কথা জানে না। মিডিয়াতে যেভাবে প্রচার হচ্ছে, সেটা নারীশ্রমিক পর্যন্ত যে পৌঁছাবে, সেটা খুব সহজভাবে বলা যাবে না। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দিক থেকে বলা হচ্ছে, তারা খাপ খাওয়াতে পারছে না অথবা অধিকাংশই দেশে এসে গল্প বানাচ্ছে। তবে এ কথা ঠিক, খাপ খাওয়ার বিষয়টা অনেকটাই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা বিভিন্ন দেশের কাজের সাংস্কৃতিক বিষয়গুলো ভিন্নরকম। আমাদের দেশের নারীশ্রমিকরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয় অল্পশিক্ষিত। তবে এটা অজুহাত হতে পারে না। খাপ খাওয়াতে না পারার মানেই কি নির্যাতন সহ্য করা? মোটেও না।

এ বছরের ৩১ মে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সৌদি গৃহকর্মীর ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে এক সংবাদ সম্মেলনে ভয়াবহ নির্যাতনের বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়। অনেক সুপারিশ বাস্তবায়নের কথা বলা হয়; কিন্তু যে জিনিসটা খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং সবচেয়ে ভয়ানক সেটা হচ্ছে, ফেরত আসা নারীদের তাদের পরিবার গ্রহণ করছে নাÑএ রকম খবর পত্রপত্রিকায় আসছে। এই ভয়াবহ সমস্যার সমাধান কী? অথচ চাকরি করে কিছু টাকা আয় করার মাধ্যমে পরিবারের সচ্ছলতা এনে দেওয়ার জন্য যে নারী তার দেশ-পরিবার ছেড়ে অচেনা এক দেশে পাড়ি দিয়েছিল, আজ তার সেই পরিবারেই তাকে নিগৃহীত হতে হচ্ছে। এর চেয়ে ভয়ংকর আর কী হতে পারে! একজন নারী হিসেবে আমাদের সমাজে এমনিতেই অনেক ধরনের কষ্ট, বৈষম্য, সুযোগের অভাবের মধ্যে যেতে হয়। তার মধ্যে আবার এ ধরনের ঘটনা তাদের বেঁচে থাকার জন্যই হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, দেশে আসার পরও তারা পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নই থেকে যাচ্ছে। সৌদি-ফেরত নারীদের কষ্টের শেষ কোথায়? দেশে এলেই কি কষ্ট শেষ হয়ে যাচ্ছে? এত সব নির্যাতন সহ্য করে যখন শান্তির জন্য যুদ্ধ করে নিজ পরিবারে ফেরত আসে, তখন এ ধরনের অনিরাপত্তা বাঁচার শেষ আশাটুকুও কেড়ে নেয়।

নির্যাতিত নারীরা যখন বাংলাদেশের বিমানবন্দরে আসে, তখন আবার তাদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়, যেটা আবার ভিডিওতে ধারণ করে বিভিন্ন যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করা হয়। আর এ ধরনের প্রচারণা একদিকে যেমন ভুক্তভোগীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ভঙ্গ করছে, ঠিক অন্যদিকে বিভিন্ন সামাজিক ও পারিবারিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। তাই এ ধরনের প্রচারণার ক্ষেত্রে আমাদের আরো সচেতন হওয়া দরকার। রেমিট্যান্স আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা সব সময় রাখছে; কিন্তু সেটা কি আত্মসম্মান বিসর্জনের মাধ্যমে হতে হবে? রেমিট্যান্স আসার কারণে নারীদের আমরা এভাবে ঠেলে দিতে পারি না। যদি মনে করা হয়, এ ঘটনাগুলো সম্পর্কে চুপচাপ থেকে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে মেনে নেওয়ার মাধ্যমে যে অন্যায় করা হচ্ছে, সেটা মেনে নেওয়া যায় না। সব হারানো নারীদের চিৎকারে ভেসে যাচ্ছে বিবেক যত নদী।

সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক মুসলিম দেশ আমাদের দেশের মানুষের জন্য বিভিন্ন সময় অনেক ধরনের উপহার পাঠায়। কিন্তু আমরা চাই না আমাদের নারীকর্মীরা সৌদি আরবে চাকরি করার জন্য সারা জীবনের কান্না উপহার হিসেবে গ্রহণ করুক। তাই এসব নারীর কান্না থামাতে রাষ্ট্রকেই তার সম্মান ধরে রাখার কাজ করতে হবে।

লেখক : প্রশাসনিক কর্মকর্তা

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist