এমদাদুল হক
শেকৃবি
১৮ বছরের যৌবনে...
দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীনতম কৃষি বিদ্যাপীঠ শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (শেকৃবি)। কৃষিশিক্ষাকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে ১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বেঙ্গল অ্যাগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট, যেখান থেকেই উপমহাদেশে কৃষিশিক্ষার ভীত্তি স্থাপিত হয়। পরে ২০০১ সালের আজকের এই দিনে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় রূপে যাত্রা শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ১৮ হলেও এর রয়েছে ঐতিহাসিক এক পটভূমি।
ব্রিটিশ রাজকীয় অশ্বারোহী বাহিনীর প্রয়োজনে এই উপমহাদেশে কৃষিশিক্ষার অবির্ভাব ঘটে। অশ্বারোহী বাহিনীর অশ্বের নিরাপদ স্বাস্থ্য ও সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ১৮৮৮ সালে কলকাতার বেলগাছিয়ায় বেঙ্গল ভেটেরিনারি কলেজ স্থাপন করা হয়। ১৮৯৫-৯৬ সালে কলকাতার শিবপুরের প্রকৌশল কলেজে ডিগ্রি পর্যায়ে কৃষি কোর্স চালু করা হয়। ঘটনা পরিক্রমার পর ব্রিটিশরাজরা তা বন্ধ করে দেয়। অন্যদিকে নীল, তুলা, পাট, রেশম, তামাক চাষের জন্য এ দেশের কৃষকদের চাপ দিতে থাকে তারা। মাঝখানে ১৮৭৭ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে পরপর ছয়টি দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। সে জন্য ব্রিটিশরা রয়েল কমিশনের দেওয়া সুপারিশগুলো কৃষকদের বোঝাতে থাকে। ১৯১৯ সালে বিহারের সাবুরে একটি কৃষি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৯২১ সালে তা বন্ধ করে দিয়ে বাঙালিদের সঙ্গে তামাশা করা হয়।
কৃষির উন্নয়নের জন্য ১৯৩৮ সালের ১১ ডিসেম্বর অবিভক্ত বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক অত্র প্রতিষ্ঠানটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। চলতি অর্থবছরের বাজেটেই ৩০০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠানটি নির্মাণের জন্য দেড় লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। নাম রাখা হয় বেঙ্গল অ্যাগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট। ইংল্যান্ডের রেডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি সিলেবাস অনুসারে ১৯৪১ সাল থেকে ইনস্টিটিউটের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন মুসলমান ও ১০ জন হিন্দু ছাত্র নিয়ে বিএসসিএজি কোর্স চালু হয়। তারাই ১৯৪৩ সালে বাংলার প্রথম কৃষি গ্র্যাজুয়েট হিসেবে বের হয়। ১৯৫১ সালে চালু হয় এমজি কোর্স।
পরে দেশভাগের পর প্রতিষ্ঠানটির নাম রাখা হয় পূর্ব পাকিস্তান অ্যাগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নাম রাখা হয় বাংলাদেশ অ্যাগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট। তবে সর্বসাধারণের কাছে কৃষি কলেজ হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। দেশের দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের অন্নের সংস্থান, কৃষিশিক্ষা, কৃষি গবেষণা ও কৃষি সম্প্রসারণের জন্য এ ইনস্টিটিউটের গ্র্যাজুয়েটরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। অথচ এটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত না করে ময়মনসিংহে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে এই ইনস্টিটিউটকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। ২০০১ সালে ৬ জানুয়ারি বাংলাদেশের কৃষি ইনস্টিটিউটের (বিএআই) হীরকজয়ন্তী অনুষ্ঠানে তৎকালীন এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএআইকে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় করার ঘোষণা দেন এবং ৯ জুলাই আইন পাস করে। একই বছরের ১৫ জুলাই প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং প্রফেসর মো. শাদাতউল্লাহকে প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেন।
অতীত ইতিহাস থেকে এ কথা বলা যায়, অত্র প্রতিষ্ঠানটির গ্র্যাজুয়েটরাই দেশের কৃষিকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। তা ছাড়া ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ৬৬-এর ছয় দফা, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান এবং ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। জানা যায়, তৎকালীন সময় পুলিশি হয়রানি থেকে রক্ষা পেতে ঢাকার ছাত্রনেতারা এখানকার হলগুলোয় আশ্রয় নিতেন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শেরেবাংলা হলের একটি কক্ষে মিটিংও করেছেন।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে কৃষি অনুষদ, অ্যানিমেল সায়েন্স ও ভেটেরিনারি অনুষদ, অ্যাগ্রিবিজনেস ম্যানেজমেন্ট অনুষদ, ফিশারিজ ও একোয়াকালচার অনুষদের অধীনে মোট ৩৫টি বিভাগ চালু আছে। স্নাতক ও ন্নাতকোত্তর পর্যায়ে বিদেশিসহ মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩৫৭০ জন। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে মোট শিক্ষকের সংখ্যা ২২৬ জন। ছেলেদের জন্য ৩টি ও মেয়েদের জন্য রয়েছে দুটি হল। তা ছাড়া শিক্ষক-কর্মকর্তাদের জন্য রয়েছে আবাসিকের ব্যবস্থা। শিক্ষার পাশাপাশি গবেষণার জন্য রয়েছে ৫টি খামার। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টির উন্নয়নের জন্য বর্তমানে ৩৫২ কোটি টাকার প্রজেক্ট চলমান।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, গবেষক ও ছাত্ররা রিচার্স সিস্টেম (সাউরেস) এবং ড. ওয়াজেদ মিয়া কেন্দ্রীয় গবেষণাগারের মাধ্যমে নতুন নতুন জাত উদ্ভাবন করে যাচ্ছে। আর শেকৃবি বহিরাঙ্গন বিভাগ কৃষিপ্রযুক্তি কৃষকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে। উদ্ভাবিত প্রযুক্তির মধ্যে সাউ সরিষা-১, সাউ সরিষা-২, সাউ সরিষা-৩, বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযুগী আলু ও পেঁয়াজের বীজ, টমেটো, টমেটিলো, জামারুসান মুলা, সাদা ভুট্টাসহ নানা ধরনের বিদেশি ফুলের সফলতা উল্লেখযোগ্য। তা ছাড়া উচ্চ ফলনশীল ধান বিআর-৩, বিআর-৪, বিআর-১০, বিআর-১১, বিআর-১৪, বিআর-১৯, বিআর-২৩ জাত অবিষ্কার করে শুধু দেশে নয়, প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম এবং পশ্চিম আফ্রিকায় স্বীকৃতি পেয়েছে। কাজী পেয়ারার জনক ড. কাজী বদরুদ্দোজা এ বিশ্ববিদ্যালয়েরই সদস্য। সম্প্রতি সূর্যের আলোছাড়া সবজি চাষ, টর্কি ও মৌমাছির কৃত্তিম প্রজনন করতে সক্ষম হয়েছে শেকৃবির একদল গবেষক। চলছে ছাদ বাগান নিয়ে বিস্তর গবেষণা।
তা ছাড়া কৃষি ক্ষেত্রে নানা অবদানের জন্য এখানকার গ্র্যাজুয়েটরা স্বাধীনতা পুরস্কার, রাষ্ট্রপতি পুরস্কার, বিজ্ঞান একাডেমিক স্বর্ণপদক ও শেরেবাংলা পদকসহ বিভিন্ন ধরনের পদক লাভ করেন। বাংলাদেশের জন্মলগ্নে জনসংখ্যা ৭ কোটি থাকলেও এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ১৭ কোটিতে কিন্তু বাড়েনি আবাদি জমি। বিশাল এ জনগোষ্ঠীর প্রতিদিনের খাদ্যচাহিদা পূরণ করেও দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। যার সবচেয়ে বড় অবদান এ দেশের কৃষিবিদদের।
রাজধানীর ছোট্ট গ্রাম নামে খ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়টি অতীতের মতো ভবিষ্যতেও তার গবেষণা, শিক্ষা, সম্প্রসারণের মাধ্যমে এ দেশের কৃষিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে- প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এই কামনা।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
"