মো. মাঈন উদ্দিন

  ১৪ জুলাই, ২০১৮

মতামত

কোর্ট ম্যারেজ ও কাবিনবিহীন বিয়ে

কয়েক দিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকে ‘কাবিনবিহীন বিয়ে ও কোর্ট ম্যারেজ’ প্রসঙ্গে একটি বিশেষ প্রতিবেদন দেখতে পাই। বিষয়টি জনগুরুত্বসম্পন্ন বিধায় সবাইকে জানানোর জন্য আমার আজকের এই প্রয়াস। ‘কাবিন নিবন্ধনের পরিবর্তে কোর্ট ম্যারেজ অধিকতর শক্তিশালী’- এ ভুল ধারণার ফাঁদে পড়ে কোমলপ্রাণ অনেক নারী তাদের দাম্পত্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ‘কোর্ট ম্যারেজের কোনো বৈধতা নেই, এমনকি এর কোনো অস্তিত্বও নেই। এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য আমরা অনেকেই জানি না।

একটি ছেলে ও একটি মেয়ে। একে অন্যকে গভীরভাবে ভালোবাসে। ভালোবাসাকে বাস্তবে রূপ দিতে তারা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু পরিবার বিয়ের পথে বাদ সাধে। এরূপ পরিস্থিতিতে পরিবারের অমতে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তারা। এমন ঘটনা অহরহই হচ্ছে এ দেশে। অনেকে প্রেমের টানে ঘর ছাড়ে এবং কোর্টে উকিলের মাধ্যমে বিয়ে করে। সুযোগসন্ধানী একশ্রেণির উকিলও এ কাজে সহায়তা করে থাকেন। আদালতের নোটারি পাবলিকের কার্যালয়ে গিয়ে ‘কোর্ট ম্যারেজ’ করে। কিন্তু বিয়ের কাবিন রেজিস্ট্রি করে না। কিন্তু নির্মম সত্য হলো, যখন দাম্পত্য জীবনে কলহ শুরু হয়; তখন এমনও দেখা যায়, স্বামী বিয়ের কথা পুরোপুরি অস্বীকার করে। আর স্ত্রীর মোহরানা, খোরপোষ ও দাম্পত্য অধিকার দিতেও রাজি হয় না। প্রকারান্তে বিষয়টি আদালতে গড়ালে বিয়েটা প্রমাণ করতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় স্ত্রীকে। এটাই হলো বাস্তবতা।

এবার আসুন, বাংলাদেশে মুসলিম ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের বিবাহ আইন নিয়ে কথা বলা যাক। যতদূর জানা যায়, ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের বিধান অনুযায়ী প্রতিটি মুসলিম বিয়ে রেজিস্ট্রি করা বাধ্যতামূলক। বিয়ে রেজিস্ট্রি না করলে স্বামীর সম্পত্তির উত্তরাধিকার, মৃতের সন্তানদের উত্তরাধিকার, খোরপোষ ও মোহরানার অধিকার থেকে ওই নারীকে বঞ্চিত হতে হয়। এ ছাড়া স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করলে বা প্রথম স্ত্রীর বিনা অনুমতিতে বিয়ে করার উদ্যোগ নিলে স্ত্রী আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন বিয়ে যদি রেজিস্ট্রি করা হয়। সুতরাং বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে একজন নারী তার দাম্পত্য জীবনের অনেক জটিলতা থেকে পরিত্রাণ পেতে পারেন এবং অসহায়ত্ব থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন।

অন্যদিকে ১৯৭৪ সালের মুসলিম বিয়ে ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইনে (সংশোধিত ৮ মার্চ, ২০০৫) বলা হয়েছে যে, যদি কেউ বিয়ে রেজিস্ট্র্রি না করেন, তাহলে তিনি এ আইনের অধীনে অপরাধ করেছেন বলে বিবেচিত হবেন এবং এ অপরাধের জন্য আইন কর্তৃক নির্ধারিত শাস্তি হচ্ছে দুই বছর বিনাশ্রম কারাদ- অথবা আর্থিক জরিমানা; যা তিন হাজার টাকা পযর্ন্ত হতে পারে অথবা উভয় ধরনের শাস্তিই হতে পারে। পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, বিয়ের আইন সম্পর্কে না জানার কারণে কাবিন রেজিস্ট্রির পরিবর্তে কোর্ট ম্যারেজ অধিকতর শক্তিশালী এ ভুল ধারণার ফাঁদে পড়ে অনেক নারী তাদের দাম্পত্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অথচ আশ্চর্যের বিষয় হলো, বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে ‘কোর্ট ম্যারেজের কোনো বৈধতা নেই, এমনকি এর কোনো অস্তিত্বও নেই। ২০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে নোটারি পাবলিকের কার্যালয়ে কিংবা জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের কার্যালয়ে গিয়ে হলফনামা করাকে বিয়ে বলে অভিহিত করা হয়। অথচ এফিডেভিট বা হলফনামা শুধুই একটি ঘোষণাপত্র। আইন অনুযায়ী কাবিন রেজিস্ট্রি সম্পন্ন করেই কেবল ঘোষণার জন্য এফিডেভিট করা যাবে। বিশেষ কয়েক শ্রেণির নারী-পুরুষের মধ্যে এরকম বিয়ের প্রবণতা বেশি দেখা যায়। তন্মধ্যে গামের্ন্ট শ্রমিক, যৌনকর্মী এবং বিশেষ প্রেমঘটিত তরুণ-তরুণী। আবেগঘন সিদ্ধান্ত নিয়ে অনেক তরুণ-তরুণীর ভুল ধারণা হয় যে, শুধু এফিডেভিট করে বিয়ে করলে বন্ধন শক্ত হয়। কাজী অফিসে বিয়ের জন্য বিরাট অঙ্কের ফিস দিতে হয় বলে কোর্ট ম্যারেজকে তুলনামূলক ভালো মনে করে নিম্নবিত্ত শ্রেণির নারী-পুরুষ। অন্যদিকে যৌনকর্মীরা অনেক সময় ঠিকানা বদল করে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে অবস্থানের সুবিধার কথা বিবেচনা করে কোর্ট ম্যারেজে উৎসাহ হয় অধিক। অনেকে এফিডেভিটের মাধ্যমে বিয়ে সম্পাদন করে একাধিক বিয়ের কথা গোপন করার জন্য। কোনো মেয়ের অভিভাবককে জিম্মি করে টাকা আদায় কিংবা সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্যও অনেক সময় এফিডেভিটের মাধ্যমে ভুয়া বিয়ের দলিল তৈরি করা হয়। এ দলিল তৈরি করা খুব সহজেই সম্ভব এবং এসব ক্ষেত্রে হলফনামা প্রার্থীকে নোটারি পাবলিকের কাছে হাজির হতে হয় না। এর ফলে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের ক্ষেত্রে বয়স বাড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকে। এ ছাড়া নারী ও শিশু নিযার্তন মামলা থেকে রক্ষার জন্য আসামিপক্ষের এ রকম হলফনামা তৈরির প্রবণতা দেখা যায়। মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার এক কেস স্টাডিতে দেখা যায়, সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী একটি ছেলে ও একটি মেয়ে এফিডেভিটের মাধ্যমে বিয়ে সম্পাদন করে। তাদের সংসারে একটি কন্যাসন্তানও রয়েছে। কিন্তু ঘটনা পরস্পর তাদের দাম্পত্যজীবন বেশিদূর এগোয়নি। পরে তারা স্বেচ্ছায় বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটাতে নোটারি পাবলিকের কার্যালয়ে একটি হলফনামা সম্পাদন করেন। হলফনামাটি একটি সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে নিবন্ধন করে। কিন্তু বিয়ে বিচ্ছেদের এ ধরনের দলিল রেজিস্ট্রি করা ও এফিডেভিট করা সম্পূর্ণ বেআইনি। হিন্দু আইনে বিয়ে বিচ্ছেদ বলে কিছু নেই। সঙ্গত কারণে বিয়ে বিচ্ছেদ চাইতে হবে পারিবারিক আদালতে। খ্রিস্টান আইনেও বিয়ে একটি চুক্তি, যা ভঙ্গ করা যায় না। ১৮৬৯-এর বিয়ে বিচ্ছেদ আইন অনুযায়ী খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা বিয়ে বিচ্ছেদের জন্য আদালতে যেতে পারেন। বিয়ে রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে সরকারের নির্ধারিত ফরমে লিখিত বর ও কনের বিয়ে-সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্যাবলি সম্পকের্ আইনগত দলিল, যা কাজী অফিসে সংরক্ষিত থাকে। সরকার কাজীদের বিয়ে রেজিস্ট্রি করার জন্য অনুমতি বা লাইসেন্স দিয়ে থাকেন। আইন অনুযায়ী বিয়ের আসরেই বিয়ে রেজিস্ট্রি করতে হয়। বিয়ের আসরে সম্ভব না হলে বিয়ে অনুষ্ঠানের দিন থেকে ১৫ দিনের মধ্যে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি করতে হয়। কাজীকে বাড়িতে ডেকে এনে অথবা কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে রেজিস্ট্রি করা যায়। এ ছাড়া কাবিননামার সব কলাম পূরণ করার পর বর, কনে, উকিল, সাক্ষী ও অন্য ব্যক্তিদের স্বাক্ষর দিতে হয়। ইসলাম ধর্মে বিয়ে নিবন্ধন আইন থাকলেও হিন্দু ধমার্বলম্বীদের ক্ষেত্রে বিয়ে নিবন্ধন আইন ছিল না। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিয়ে নিবন্ধনের বিধান ঐচ্ছিক রেখে হিন্দু বিয়ে নিবন্ধন আইন তৈরি হওয়ায় এখানেও অনেক জটিলতা দেখা দিয়েছে। বতর্মানে বিদেশ ভ্রমণ, অভিবাসন, চাকরি, বদলি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিয়ে সম্পর্কিত দালিলিক প্রমাণ একটি অপরিহার্য বিষয়। প্রতারণার সুযোগ বন্ধ করা এবং হিন্দু নারীদের সামাজিক ও আইনি সুরক্ষা সৃষ্টির লক্ষ্যে হিন্দু বিয়ে আইন ঐচ্ছিক না রেখে বাধ্যতামূলক করা সমীচীন।

প্রিয় পাঠক, এবার আসুন প্রতিবেদনে পাওয়া কাবিনবিহীন বিয়ে প্রমাণে একটি কেইস স্টাডি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি : মমতাজ বেগম ও আনোয়ার হোসেন একে অন্যকে ভালোবাসেন। সে সূত্র ধরে দুজন স্বামী-স্ত্রী হিসেবে ঘর-সংসার করতে শুরু করেন। কিন্তু তাদের মধ্যে বিয়ের কোনো কাবিননামা রেজিস্ট্রি হয়নি। একপর্যায়ে লোভী আনোয়ার হোসেন মমতাজ বেগমের কাছে যৌতুক দাবি করে নির্যাতন করে এবং যৌতুক না পাওয়ায় মমতাজ বেগমকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। মমতাজ বেগম তার ভরণপোষণ এবং দেনমোহর চেয়ে পারিবারিক আদালতে মামলা ঠুকে দেন। কিন্তু বিধিবাম! আনোয়ার হোসেন মমতাজ বেগমের সঙ্গে তার বিয়েকে অস্বীকার করে আদালতে জবাব দাখিল করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এদিকে মমতাজ বেগম দাবি করেন, তাদের মধ্যে মুসলিম আইন অনুযায়ী বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে এবং তারা দীর্ঘদিন স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই একত্রে বসবাস করছেন এবং স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই পরিচয় দিয়েছেন। মামলার সাক্ষ্য-প্রমাণ শেষে পারিবারিক আদালত আদেশ দেন, তাদের মধ্যে বিয়ের অস্তিত্ব বিদ্যমান রয়েছে। পারিবারিক আদালতের এ আদেশের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ আনোয়ার হোসেন ১৯৯৬ সালে হাইকোর্ট বিভাগে রিভিশন দায়ের করেন। হাইকোর্ট বিভাগের একটি একক বেঞ্চ ১৯৯৯ সালে পারিবারিক আদালতের আদেশটি খারিজ করে দেন। হাইকোর্ট বিভাগ তার রায়ে বলেন, তাদের মধ্যে কোনো প্রকার কাবিননামা সম্পন্ন হয়নি, যা বিয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং মমতাজ বেগম তা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। হাইকোর্ট বিভাগের এ রায়ের বিরুদ্ধে মমতাজ বেগম লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি) দায়ের করেন এবং আপিল মঞ্জুর হয়। আপিল বিভাগে মমতাজ বেগমের পক্ষে ২০০৩ সালে আপিলটি করেন আইনজীবী ব্যারিস্টার রাবেয়া ভূঁইয়া। সিভিল আপিল নাম্ব^ার-১৩৯/২০০৩। তিনি আপিলে দাবি করেন, কাবিননামার অনুপস্থিতিতে বিয়ের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যাবে না এই মর্মে হাইকোর্ট বিভাগের বিবেচনা যুক্তিসঙ্গত নয় এবং তা আইনের সঠিক মর্ম নয়। অবশেষে ৩১ জুলাই ২০১১ তারিখে আপিল বিভাগ মমতাজ বেগমের পক্ষে রায় দেয়। মমতাজ বেগম বনাম আনোয়ার হোসেন মামলায় আপিল বিভাগের রায়ে বিচারপতি এসকে সিনহা মন্তব্য করেছেন, মুসলিম নর ও নারী যদি স্বামী ও স্ত্রীর পরিচয়ে দীর্ঘদিন বসবাস করেন এবং তাদের মধ্যে যদি রেজিস্ট্রিকৃত কাবিননামা না-ও হয়ে থাকে, তাহলেও এখানে বৈধ বিয়ের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকতে পারে। তারা উভয়ে স্বামী-স্ত্রী এবং তাদের মধ্যে মুসলিম আইন অনুযায়ী বৈধ বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে বলেও গণ্য হতে পারে।

এই কেস স্টাডি থেকে আমরা জানলাম, কাবিননামা ছাড়া স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বসবাস করলে বৈধ বিয়ের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকতে পারে। তবে বিষয়টি আমার মতে, ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ এহেন কাবিনবিহীন বিয়ে প্রমাণে গ্রাম্য সহজ-সরল মানুষকে পড়তে হবে নানা ঝক্কি-ঝামেলায়। সুতরাং, আমরা ঝুঁকিপূর্ণ পথে না হেঁটে বরং নিরাপদ পথে হাঁটব। তাই কোর্ট ম্যারেজ নয়, কাবিন নিবন্ধন করে বিয়ে সম্পন্ন করে সুন্দর ও নিরাপদ দাম্পত্য জীবন গড়তে আসুন সবাই সাহায্য করি এ দেশের প্রত্যেক যুবক-যুবতীকে।

লেখক : কথাসাহিত্যিক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা

কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist