অলোক আচার্য্য
পর্যবেক্ষণ
উন্নয়ন বনাম ভারসাম্যহীনতা
দরিদ্র দেশের তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ ঘটেছে। এটা আমাদের জন্য সত্যিই আনন্দের বিষয়। ক্রমোন্নতির এ ধারায় বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, বাংলাদেশ অবশ্যই উন্নত দেশে পরিণত হবে। একসময় তলাবিহীন এই ঝুড়ির তলা আজ মজবুত। দেশের মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি পেয়ে ১ হাজার ৭৫২ ডলার হয়েছে। বেড়েছে আমাদের গড় আয়ু। এখন আমাদের দেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ বছর। তা ছাড়া প্রবৃদ্ধিও বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ উন্নতির সব কটি ক্ষেত্রেই আমরা এগিয়ে চলেছি। তবে এ এগিয়ে চলা কেবল আর্থিক মাপকাঠিতে হলেই হবে না। আমাদের পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থা আজ ভাবতে বাধ্য করছে যে আজ আমরা সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি কি না। উন্নত দেশের বাসিন্দাদের মনমানসিকতাও উন্নত হতে হবে। সামাজিক ঘটনাগুলো আমাদের এ সাফল্যকে ম্লান করে দিচ্ছে। সমাজে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে সামাজিক আস্থাহীনতা, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব, ধর্ষণ, খুন, হিংসা, লোভ , দুর্নীতি, বেকারত্ব, মাদকাসক্তের সংখ্যা, অবসন্নে ভোগা মানুষের সংখ্যা। মানুষে মানুষে তৈরি হচ্ছে এক ধরনের দূরত্ব। আর এ দূরত্বের ফলে সমাজে বাড়ছে অপরাধের সংখ্যা। বিশ্বাস শব্দটিই আজ মানুষের মাঝ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। আমরা আজ একজন আরেকজনকে চূড়ান্ত অবিশ্বাস করি। এমনকি এ অবস্থা পরিবারের ভেতরেও।
যখন পরিবারের সদস্যদের বন্ধনই হালকা হয়ে যাচ্ছে, তখন সমাজ তো নড়বড়ে হবেই। আর প্রকৃত উন্নয়ন করতে হলে সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গঠনের দিকে নজর দেওয়া আবশ্যক। মুনাফার এ যুগে আমরা সবাই সবাইকে ঠকাতে ব্যস্ত থাকি। সেই ঠকানোর প্রক্রিয়ায় আমরা প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে যুক্ত রয়েছি। প্রত্যেকেই নিজের অবস্থান থেকে ঠকানোর চেষ্টা করছি। নিজেদের আখের গুছিয়ে নিতে বেশির ভাগ সময়ই ব্যস্ত থাকি। এসব করতে গিয়ে সমাজে এক সূক্ষ্ম চিড় ধরেছে। এখন আমরা চাইলেও সেই ক্ষত মুছতে পারছি না। বরং ক্রমেই সেই ক্ষত বড় হচ্ছে। প্রতিদিনের পত্রিকার দিকে চোখ রাখলে আমরা এসব সমাজের কুৎসিত চিত্রের খবর পড়ি। সেই সঙ্গে কয়েক দশক আগের সেই শান্তির জীবন, নিশ্চিন্ত জীবন হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের জীবন থেকে। ব্যস্ততাই যেন নিয়তি। মানুষ কেবলই ছুটছে। যন্ত্রমানবের মতো ছুটছে। কোথায় থামবে তার কোনো ঠিকানা নেই। তাই এভাবে গড় আয় না হয় বাড়ছে, গড় আয়ুও বাড়ছে গড় শান্তির খবর কী? একদিকে বিশ্বায়নের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে উন্নতির চরম শিখরে চড়েছি, অন্যদিকে দুদ- শান্তির খোঁজে নিরন্তর ছুটে চলেছি। এই তো জীবন। পরিসংখ্যানের হিসাবে কত কিছুর ক্ষতিপূরণ খুব সহজেই হিসাব করে দেওয়া যায়।
বিখ্যাত গায়ক নচিকেতার একটা গানে শুনেছি, শুধু বিষ, শুধু বিষই দাও, অমৃত চাই না, অমরত্বের লোভ, করুক বিক্ষোভ... পরিসংখ্যানে মাপে জীবনের ক্ষয়ক্ষতি, এমন প্রগতি চাই না। দুই বাসের প্রতিযোগিতার চিপায় পড়ে এক হাত হারানো রাজীবের জীবন আজ সংকটাপন্ন। এ রকম আরো একজন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তার পায়ে চাপা দেওয়ার ফলে তারও পা-টা থাকবে কি না সন্দেহ। এর জন্য বিচারও হবে আবার হয়তো জরিমানাও আদায় করা হবে। কিন্তু একটা হাত বা একটা পায়ে ভর করে চলার যে আনন্দ তা কি আর ফিরে পাবে। এ ধরনের ঘটনা কিন্তু বেড়েই চলেছে। ইতোমধ্যে রাজীবের মৃত্যু হয়েছে। এত কিছু বাদ দিয়ে যদি বাসগুলোর নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাহলে এ ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। দেশের সব স্থানেই প্রায় প্রতিদিনই বহু দুর্ঘটনা ঘটছে। সরকারি নানা পদক্ষেপেও এ হার কমানো যাচ্ছে না। গাড়িতে উঠলেই যেন এক ধরনের ভয়ে থাকতে হয়। আবার গাড়িতে না চড়লেও তাই। রাস্তার পাশে দাঁড়ানো ব্যক্তিকে কখন পেছন থেকে কোন গাড়ি ধাক্কা দিয়ে যায়! অনেক কারণেই আমাদের দেশে দুর্ঘটনা ঘটে। তার মধ্যে চালকদের অপ্রাপ্ত বয়স, চালকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা, গাড়ির ফিটনেস, আইন মানার প্রবণতা না থাকাসহ অনেক কারণ।
পরকীয়া নামক একটা ব্যাধি সমাজের ওপর ভূতের মতো চেপে বসেছে। পরকীয়া ধ্বংস করে দিচ্ছে বহু পরিবার। এটা এক ধরনের ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে বলা যায়। ভারতীয় সিরিয়ালের কল্যাণে আর পশ্চিমা সংস্কৃতির ছোঁয়ায় বাঙালি সংস্কৃতিই আমরা ভুলতে বসেছি। পরকীয়রা প্রভাবে এতটাই ভয়ংকর যে মা তার সন্তানকে মেরে ফেলতে সামান্যতম দ্বিধা করছে না। একই রকমভাবে বাবাও তার সন্তানকে হত্যা করছে। পরকীয়ায় জড়িয়ে রংপুরে আইনজীবী হত্যা এবং নারায়ণগঞ্জে মায়ের পরকীয়ায় জড়িয়ে সন্তানকে হত্যা এসবই সমাজের পচনের ফল। সমাজ নিয়ে গবেষণা করা বিশেষজ্ঞরাও সমাজের এ অবনতিতে শঙ্কিত। পরকীয়ায় জড়িয়ে একটি পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কখনো শিশুরা মা-বাবার এ ধরনের অনৈতিক কর্মকা-ের শিকার হচ্ছে। এটি এমনভাবে ছড়িয়ে পড়ছে যে অনেক সময় দেখা দিচ্ছে তীব্র সন্দেহ। অতি তুচ্ছ ঘটনায় একজন আরেকজনের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। সেই সন্দেহ থেকে দেখা দেয় মানসিক অশান্তি। এই মানসিক অশান্তি থেকে মুক্তি পেতে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ছে অনেকে। সন্দেহের জেরে সংসার ভেঙে যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন শহরে ডিভোর্সের সংখ্যা বাড়ছে। এসব ভেঙে যাওয়া পরিবারে জন্ম নেওয়া শিশুদের বড় হওয়ার পথে প্রতিকূলতা সৃষ্টি করছে। সমাজের এই নিঃশব্দ ঘুণপোকা সমাজটাকেই খেয়ে ফেলছে।
ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে যা হচ্ছে তা আর ব্যক্তি স্বাধীনাতার পর্যায়ে থাকছে না। পরশ্রীকাতরতা সমাজে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসেছে। কোনোভাবেই এর থেকে মুক্তি পাওয়া যাচ্ছে না। ক্রমাগত পচনধরা সমাজের আর একটি অভিশাপের নাম ধর্ষণ। বিকারগ্রস্ত মানুষরা আমাদের আশপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তারাও মানুষ। আমাদেরই আশপাশে থাকে। তাদের বেশভূষাও ভালো। তবে তাদের কাজ সমাজের এবং জাতির জন্য কলঙ্কজনক। এই দলে এমন কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ নেই যার নাম উল্লেখ করা যায় না। শিক্ষক তার মেয়েসমতুল্য ছাত্রীকে অবলীলায় ধর্ষণ করছে। তার ভেতরে কোনো পরিতাপ হচ্ছে না। এমনকি বাবার কাছেও মেয়ে নিরাপদ নয়। আর ধর্ষণের কোনো বয়সও নেই। কয়েক মাস থেকে শুরু করে সত্তর বছর। কেউ বাদ পড়ছে না। দৈনিক পত্রিকাগুলোর পাতায় পাতায় চোখ রাখলেই প্রতিদিন একাধিক ধর্ষণের খবর চোখে পড়ে। সেই সঙ্গে শিশুর চিৎকার মিশে থাকে। ওরা যেন আমাদের এই সমাজটাকে, সমাজের মানুষগুলোকে প্রতিনিয়ত ধিক্কার জানাচ্ছে।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের এই দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া এই দেশের ঘামে ভেজা মানুষের শ্রম দেশ অনেকদূর এগিয়েছে। আমরা আরো এগিয়ে যাব এ কথাও নিশ্চিত। কিন্তু কেবল অর্থপ্রাপ্তি ঘটলেই সবকিছু হয় না। সামাজিক বিশৃঙ্খলা আমাদের এই উন্নতির প্রধান অন্তরায় হিসেবে দাঁড়িয়েছে। আর্থিক মুক্তির পাশাপাশি প্রয়োজন শান্তির নিশ্চয়তা। আর এ জন্য আইনই যথেষ্ট নয়। নিজেদের বিসর্জন দিতে চলা নৈতিকতাবোধকে জাগাতে হবে। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছে, আমাদের চোখের সামনে কোনো কিছু ঘটতে দেখলে আমরা দর্শকের ভূমিকা পালন করি। খুব বেশি হলে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে ভিডিও করে কষ্ট করে ফেসবুকে পোস্ট করি। সবাই নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত থাকি। কিন্তু ভেবে দেখি না আজ যেটা অন্যের সঙ্গে ঘটছে, কাল তা আমার সঙ্গেও ঘটতে পারে। তাই সমস্যা মোকাবিলায় সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। ঘুণেধরা এ সমাজটাকে রক্ষা করতে হবে। স্বাধীনতার স্বাদ প্রতিটি নাগরিকের জন্য নিশ্চিত করতে হবে। তার জন্য কারো একক প্রচেষ্টা যথেষ্ট নয়। আমাদের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব রয়েছে সেই পরিবেশ নিশ্চিত করার।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
"