রায়হান আহমেদ তপাদার

  ১৫ জানুয়ারি, ২০১৮

বিশ্লেষণ

মৃত্যুঝুঁকিতে রোহিঙ্গা শিশু

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রায় ৩ লাখ ৪০ হাজার শিশু মানবেতর পরিস্থিতিতে রয়েছে বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ। সংস্থাটি জানায়, শিশুরা পর্যাপ্ত খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও চিকিৎসাসেবার সংকটে রয়েছে। এপি এবং রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি সপ্তাহে ১২ হাজার শিশু শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিচ্ছে। ক্ষুধা ও সহিংসতা থেকে পালিয়ে আসা বেশির ভাগ শিশুই এখনো মানসিকভাবে বিভীষিকা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যে সহিংসতার পর মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর নিধনযজ্ঞ চালানো শুরু করে। প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় ছয় লাখ রোহিঙ্গা।

ইউনিসেফের কর্মকর্তা সাইমন ইনগ্রাম জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এই সংকট স্বল্পমেয়াদি নয় এবং খুব তাড়াতাড়ি এর সমাধান হবে না। তিনি বলেন, তাই সীমান্ত খুলে দিয়ে যাদের আশ্রয় দেওয়া হচ্ছে তাদের জন্য বাংলাদেশি শিশুদের মতো সব সুবিধা নিশ্চিত করা খুব কঠিন। মিয়ানমারের বেশির ভাগ রোহিঙ্গারই নাগরিকত্ব নেই। কোনো রকম বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই তারা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়, কোনো রকম পরিচয় ছাড়া সমাজে বাস করাটা খুবই কঠিন। রাখাইনে সহিংসতা সৃষ্টির পর থেকে কমপক্ষে ৬ লাখ ৫৫ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে। আন্তর্জাতিক সহায়তাবিষয়ক সংগঠন সেভ দ্য চিলড্রেনের মতে, বেশির ভাগই হলো স্বল্প বয়সী শিশু-কিশোর। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে শতকরা কমপক্ষে ৩০ ভাগেরই বয়স হলো পাঁচ বছরের নিচে। বাংলাদেশের আশ্রয়শিবিরের সর্বত্রই শিশু-কিশোর। তারা সহায়তা পাওয়ার জন্য লড়াই করছে।

শিশুরা লাইনে ছোটাছুটি করছে। জগভর্তি পানি নিয়ে শরীরে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছে। অথবা তাদের মাথার ওপর আঁটি বাঁধা জ্বালানি কাঠ। দান করা কাপড় পরে আছে তাদের কেউ কেউ। তাদের এই পোশাক অদ্ভুত। পরনে আছে জ্যাকেট। আরো রয়েছে বাস্কেটবল খেলার শর্টস। অনেকের পরনে কিছুই নেই। ধুলাবালিতে একাকার তারা। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় শিবিরগুলোয় অন্য কিছু শোনা যাক বা না যাক, শিশুদের কাশির তীব্র শব্দ পাওয়া যাবে। এসব বাচ্চা শরণার্থীর অবস্থা খুবই শোচনীয়। সেভ দ্য চিলড্রেনের মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক উপদেষ্টা লালু রোট্রাপ হোলডট বলেছেন, এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি শিশুদের মধ্যে ভয়াবহ মানসিক স্বাস্থ্য সংক বিস্তার লাভ করছে। তাদের মনে রয়েছে বিশাল ক্ষত। তারা চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পায় নৃশংস হত্যাকা-। দেখতে পায় কিছু না নিয়ে একেবারে খালিহাতে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করা হচ্ছে। লালু রোট্রাপ হোলডট বলেন, এদের মধ্যে আপনি পাবেন ক্ষুধার্ত শিশু। পুষ্টিহীন। এটা একটি পুরো সম্প্রদায়ের জন্য চরম বিপর্যয়কর। জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ বলে একটা সনদ আছে, যেটিতে সোমালিয়া ছাড়া পৃথিবীর সব দেশ স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশ স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় এ সনদ। ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরে আন্তর্জাতিক আইনের একটি অংশে পরিণত হয় এটি। সনদের ২২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে শরণার্থী শিশু বা শরণার্থীর মর্যাদাপ্রাপ্ত শিশুদের বিশেষভাবে রক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। সরকার এসব শিশুর জন্য এ সনদে এবং আন্তর্জাতিক শরণার্থী আইনে উল্লিখিত অধিকারগুলো নিশ্চিত করবে।

শিশুর মা-বাবাকে খুঁজে বের করা ও শিশুকে তাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া এর অন্তর্ভুক্ত। যদি শিশুর মা-বাবা অথবা পরিবারের কাউকে খুঁজে না পাওয়া যায়, তাহলে সরকার তার লালন-পালন ও সুরক্ষার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। যেসব সংস্থা শরণার্থী শিশুদের রক্ষার দায়িত্ব নেবে, তাদের সাহায্য ও সহযোগিতা করা রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব। শিশুদের তথাকথিত নিরাপদ হোমে রাখা রাষ্ট্রের প্রথম কাজ নয়। শিশু অধিকার সনদের ৩৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, যেসব শিশু সশস্ত্র সংঘাত, অত্যাচার, অবহেলা, বিনাচিকিৎসা বা শোষণের শিকার, তাদের শারীরিক সুস্থতা ফিরিয়ে আনতে এবং তাদের সমাজে পুনর্বাসিত করার লক্ষ্যে রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে, যেন ভবিষ্যতে তারা সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। বাংলাদেশ বিষয়গুলো পালনে যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু বিশ্ব সম্প্রদায়কে আরো এগিয়ে আসতে হবে এসব নারী ও শিশুকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে এবং তাদের সমাজে পুনর্বাসিত করার লক্ষ্যে রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে, যেন ভবিষ্যতে তারা সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে। বাংলাদেশ বিষয়গুলো পালনে যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু বিশ্ব সম্প্রদায়কে আরো এগিয়ে আসতে হবে এসব নারী ও শিশুকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে। শিশুদের জরুরি ভিত্তিতে খুঁজে বের করে নিবন্ধন করতে হবে। দেখতে হবে কোন শরণার্থী মায়ের সঙ্গে সে থাকতে চায়। যার সঙ্গে থাকতে চাইবে, তাকে শিশুটি রাখার দায়িত্ব দিতে হবে। এমন হতেই পারে যে, কিছুদিন পর শিশুটির দায়িত্ব নেওয়া মা আর শিশুটিকে রাখতে চাইলেন না বা শিশুটি নানা যন্ত্রণার শিকার হচ্ছে, তখন অন্য কোনো পরিবারের সঙ্গে তার থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে দুজনকে নিয়ে বসতে হবে। কেস ম্যানেজমেন্টে যারা দক্ষ, তাদের বিষয়টি দেখতে হবে।

মানসিক সংকটে থাকা শরণার্থী শিশুদের শৈশবকালীন কর্মকা- যেমন খেলাধুলা, ছোটাছুটি করা, পড়ালেখা, ছবি আঁকা, গান গাওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। শিশুদের নিয়ে যারা কাজ করতে চায়, তাদের শিশু সুরক্ষা নীতিমালা মেনে চলতে হবে। প্রয়োজনে কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। শিশুদের প্রতি বড়দের আচরণবিধির সুষ্ঠু প্রয়োগ থাকতে হবে। তা না হলে এসব নিঃশব্দ শিশুদের ভয়ংকর কোনো কাজে লিপ্ত করার জন্য দালাল ও মুনাফাখোররা তৎপর হয়ে উঠবে। বহির্গমন ও পাসপোর্ট অধিদফতর উখিয়া এবং টেকনাফে ছয়টি কেন্দ্রে রোহিঙ্গা নিবন্ধন অব্যাহত রেখেছে। হাজার হাজার নারী, শিশু ও পুরুষ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়ে নিবন্ধন করছে। শিশুদের জন্য নিরাপদ পৃথিবী আমরা কীভাবে নিশ্চিত করব, যদি বিশ্বব্যাপী এভাবে নিষ্ঠুরতা চলতে থাকে? জাতিসংঘ কর্তৃক স্পষ্টভাবে ঘোষিত হতে হবেÑ ‘যেকোনো সংঘাত, যেকোনো যুদ্ধ কিংবা কোনো ধরনের দ্বন্দ্ব-বিবাদের সময় কেউই নারী ও শিশুর ওপর কোনো ধরনের শক্তি প্রয়োগ করতে পারবে না।’ যদি করা হয়, তাহলে তথাকথিত নিন্দা জ্ঞাপন আর কূটনৈতিক চাপ নয়, সরাসরি ওই দেশ, সরকার বা সংস্থার ওপর বলপ্রয়োগ করার নিয়ম ও শক্তি অর্জন করতে হবে জাতিসংঘকে। বর্তমানের জাতিসংঘ দিয়ে দুর্বলদের রক্ষা করা, নারী ও শিশুদের মানবিক অধিকার রক্ষা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সেভ দ্য চিলড্রেনসহ পাঁচটি সংস্থার তৈরি করা এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, সেভ দ্য চিলড্রেনসহ পাঁচটি সংস্থার করা পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সহিংসতার কারণে পালিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া এক চতুর্থাংশ রোহিঙ্গা শিশুই দুই মাস ধরে তীব্র পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। তীব্র পুষ্টিহীনতার শিকার ওই এক-চতুর্থাংশ শিশুর মধ্যে আবার এক-তৃতীয়াংশই চরম অপুষ্টির শিকার।

অর্থাৎ যেকোনো সুস্থ শিশুর চেয়ে অপুষ্টিতে ভোগা ওই শিশুরা নয় গুণ বেশি মৃত্যুঝুঁকিতে রয়েছে। এ ধরনের শিশুরা ডায়রিয়া বা বুকের সংক্রমণের মতো রোগেও দ্রুত আক্রান্ত হয়। শিশুদের এই পরিস্থিতি আশঙ্কার চেয়েও অনেক খারাপ মন্তব্য করে কক্সবাজারে নিযুক্ত সেভ দ্য চিল্ড্রেনের পুষ্টি পরামর্শক নিকি কনেল গণমাধ্যমকে বলেন, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শিশুরা আগেই থেকেই অপুষ্টিতে ভুগছিল। এর মধ্যে বাংলাদেশে এসে এমনই এক পরিস্থিতিতে পড়েছে যে, খাদ্যের জন্য তাদের ত্রাণের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। যেখানে নেই স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, নেই প্রয়োজনীয় খাবার পানি। ফলে প্রচুর মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। অপুষ্টিতে ভোগা এসব শিশুকে নিয়ে বড় সমস্যায় পড়তে হবে মন্তব্য করে নিকি কনেল আরো বলেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে যদি এই শিশুদের জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা না করা যায়, তবে এসব শিশুদের বড় একটি অংশকে আর বাঁচানো যাবে না। এর আগে গত ২৩ অক্টোবর জেনেভায় অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে ইউনিসেফের পক্ষ থেকে বলা হয়, বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রায় ১৭ হাজার শিশুর পুষ্টির চিকিৎসা প্রয়োজন এবং ১ লাখ ২০ হাজার গর্ভবতী ও অসুস্থ নারীর পুষ্টিকর খাদ্যের প্রয়োজন। যাদের মধ্যে অপ্রতুল শৌচাগার ও অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতির কারণে কলেরা, ডায়রিয়ায় হাজারো মানুষের মৃত্যু ঘটতে পারে।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist