শিবুকান্তি দাশ

  ১৫ জুলাই, ২০১৭

পায়েলের পরিবেশ ভাবনা

পায়েলদের বাড়ি পটিয়া উপজেলা সদরে। বাড়িটি যে এলাকায় তার নাম খাস্তগীরপাড়া। বাড়ির পরে বাড়ি। ছায়াঘেরা, পাখি ডাকা সুন্দর মনোরম পরিবেশ। প্রতিটি বাড়ির চারপাশে গাছপালা, লতাপাতায় মোড়ানো। জঙ্গলের মতো মনে হয়। রাতের বেলা কেমন ভয় ভয় লাগে। পারতপক্ষে পায়েল আর তার ভাইবোনরা কেউ রাতের বেলা ঘর থেকে বেরোতে চায় না। অথচ কী সুন্দর জোনাক পোকার ওড়াওড়ি। রাতের আঁধার ঠেলে জোনাকিরা আলো জ্বেলে জ্বেলে চলে। দূর থেকে দেখলে পায়েলদের বাড়িটাকে ছোটখাটো পাহাড়ের টিলার মতো মনে হয়। সকাল হলেই হরেক পাখির কলতানে মুখরিত হয়ে ওঠে। শুধু কি তাই? আমের দিনে আম, জামের দিনে জাম। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে আম-কাঁঠালের গন্ধে ম ম করত। মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে পায়েল তার বন্ধুদের সঙ্গে আম-জাম কুড়াতে যেত। শীতের দিনের সকাল মানে ছিল নানা পিঠা-পুলির উৎসব। খেজুর রসে ভাপা পিঠা খাওয়ার মজাই ছিল অন্যরকম, যা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। সকালে হিম হিম ঠা-ায় উঠোনের এক পাশে মা পিঠা বানাতেন। ঠাম্মা, পায়েল ও তার ছোট বোন পল্লী ও ভাই স¤্রাটকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতেন। ঠাম্মা বলতেন, ওঠ ওঠ, পিঠা ঠা-া হয়ে যাচ্ছে। বলতে বলতে গায়ের কাঁথাটা টেনে নিতেন। আর কি ঘুমে থাকা যায়? হিম হিম ঠা-ায় পায়ে পায়ে পুকুরে গিয়ে মুখ ধুয়ে এসে মায়ের কাছে গিয়ে বসত আর রসে ভিজিয়ে পিঠা খেত। তখন টুকরো টুকরো রোদ এসে গায়ে লাগত আর কী যে ভালো লাগত। কিন্তু এ কয়েক বছরে গ্রামটি যেন মরুভূমি হয়ে আছে। কোথাও কোনো গাছপালা নেই। সবাই গাছ কেটে কেটে বাড়ি বানাচ্ছে, নয়ত জ্বালানির কাঠের জন্য গাছ কেটে সাবাড় করছে। খাস্তগীরদের বাড়ির পেছনে ছিল ছোটখাটো খালের মতো ‘খাই’। বর্ষাকালে আশপাশের কয়েকটি বাড়ির পানি নিষ্কাশন হতো এ খাই দিয়ে। কিন্তু এখন সেই খাই ভরাট করে ৫-৭ তলা বাড়ি বানানো হয়েছে। যা কখনো কেউ কল্পনাই করেনি। এখন বর্ষাকালে একটু বৃষ্টি হলেই পাশের ব্রাহ্মণপাড়ায় হাঁটুপানিতে ডুবে থাকে। পানি যাবার রাস্তাটা সরু হয়ে যাওয়াতে প্রতি বর্ষায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে লোকজনকে। অন্যদিকে সারাবছর পানির সমস্যা। খাস্তগীরপাড়ার বড় বড় কয়েকটি পুকুর ভরাট হয়ে গেছে।

পায়েল অনেক দিন পর মামা বাড়িতে এসে এসব কথা ভাবছিল। পায়েল লক্ষ করল মামাবাড়িতে কয়েক বছর আগে বেড়াতে এসে তার ভালো লাগেনি। বাড়িটা কেমন মরা মরা। কোনো গাছপালা নেই। পাখি নেই, ফুল নেই। শীতের দিনে কুয়াশা দেখা যেত না। শীতকাল মনেই হতো না। সব সময় রোদের দাপাদাপি। আর কয়েক বছরে কেমন পাল্টে গেল। এর রহস্য বের করতে গিয়ে দেখল তার ছোট মামা নির্মলই এসব জাদুর মতো কেমন পাল্টে দিয়েছেন। পায়েল ছোট মামার ঘরে গিয়ে দেখে সব আঁকা ছবি। বিশ্ব পরিবেশ দিবসে পায়েলের মতো স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এঁকেছে এসব ছবি। সব ছবি প্রকৃতির। গাছপালা, ফুল-পাখির ছবি। পায়েলের মামা এসব ছবি তার ঘরে এনে টাঙ্গিয়ে দিয়েছে। মামা এসব ছবি কে এঁকেছে? পায়েল জানতে চায়। তোমাদের মতো ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। মামা জবাব দেয়। কেন এঁকেছে মামা। প্রতি বছর ৫ জুন হচ্ছে বিশ্ব পরিবেশ দিবস। এবার বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আমরা ছোটদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলাম। কারণ প্রতিদিন আমাদের পরিবেশকে আমরা ধ্বংস করছি। আর পরিবেশ ধ্বংস করে আমরা আমাদের বিপদকে ডেকে আনছি। এক দিন দেখবে পরিবেশ ধ্বংস হয়ে আমাদের দেশ বসবাসের উপযোগিতা হারাবে। পায়েল জানতে চায়, কিভাবে? মামা বলল, আমরা যে হারে গাছ কাটছি প্রতিদিন সেভাবে কি কেউ গাছ লাগাচ্ছি। পুকুর-নদী-খাল-বিল-জলাশয় ভরাট করে বাড়ি বানানো হচ্ছে। এসব পরিবেশের জন্য বিরাট ঝুঁকি। পায়েল মাথা নাড়ে। মামা এবার তার পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সব কথা খুলে বলল। মামা বলল, দেখ আমাদের বাড়িতে আগে কোনো গাছপালা ছিল না বলে ঘরগুলো সব সময় গরম হয়ে থাকত। আবার শীতের দিনে খুব ঠা-া হয়ে থাকত। ফলে প্রতিনিয়ত সবার রোগব্যাধি লেগেই থাকত। সরকার প্রতিবছর বর্ষাকালে গাছের চারা বিনামূল্যে বিতরণ করে থাকে। আমরা তা কখনো খেয়াল করিনি। কিন্তু চার বছর থেকে আমরা এলাকার সব তরুণ ছেলেমেয়ে মিলে উপজেলা কৃষি অফিস থেকে বিনামূল্যে গাছের চারা এনে রোপণ করে আসছি। আর আগের যা গাছপালা ছিল কাউকে তা কাটতে দিচ্ছি না। ফলে এ কয়েক বছরে আমাদের এলাকায় রাস্তার ধারে বাড়িঘরের আঙিনায় ফুল-ফলের গাছ লাগিয়ে পরিবেশকে উন্নত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এখন আমাদের গ্রামে সকাল হলে পাখি ডাকে। নানা ফুল ফলের গন্ধে মন ভরে যায়।

এবার পায়েল তার নিজের বাড়ি ও পাড়ার কথাটা বলতে শুরু করে মামার কাছে। কেন এখন পাখি ডাকে না। আম-জাম ধরে না গাছে। বৃষ্টি কম হয়। শীতের দিনে কুয়াশা পড়ে না বলে শীত লাগে না গায়ে। যে কারণে খেজুর রসও মেলে না। মামা সব কথা শুনে বলল, আমাদের পরিবেশকে আমরা বাঁচিয়ে না রাখলে কে রাখবে। মানুষের স্বার্থে মানুষকে পরিবেশ ঠিক রাখতে হবে। পরিবেশ বিপর্যয় হলে মানুষের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে। পায়েল বুঝতে পারে, এখন তাদের গ্রামেও নতুন করে গাছের চারা রোপণ করতে হবে। ফুল ফল ও ঔষধি গাছ লাগাতে হবে বেশি করে। পায়েল ভাবছিল বেশ কয়েকটি দিন মামা বাড়ি বেড়াবে। মামাত ভাইবোনদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু মামার কথা শুনে তার মাথায় আসে অনেক পরিকল্পনা। পায়েল বাড়িতে এসে তার স্কুলের সব বন্ধুর সঙ্গে টিফিনের ছুটিতে কথা বলে। তারা সিদ্ধান্ত নেয়, তাদের স্কুলের আশপাশের রাস্তায় ও মাঠের চারধারে এবার পরিবেশ দিবসে গাছের চারা লাগাবে। সেদিন থেকে তাদের বৃক্ষ রোপণ অভিযান শুরুর ঘোষণা দেওয়া হবে। প্রত্যেকে নিজ নিজ বাড়িতে দুটি করে ফলদ ও দুটি বনজ গাছের চারা রোপণ করবে। আর গ্রামের প্রতিটি রাস্তার ধারে উপজেলা কৃষি অফিস থেকে গাছের চারা এনে রোপণ করবে। কোনো রাস্তা বৃক্ষশূন্য থাকবে না। কোনো বাড়ি বৃক্ষশূন্য থাকতে পারবে না।

যেই কথা সেই কাজ। সবাই টিফিনের টাকা থেকে এক টাকা এক টাকা করে সঞ্চয় করে অনেক টাকা যোগাড় করল। পরিবেশ দিবসের কয়েক দিন আগে প্রধান শিক্ষকের কাছে যায় পায়েলরা।

-স্যার আসতে পারি?

-এসো, ভেতরে এসো। প্রধান শিক্ষক অরুণ বাবু পায়েলদের তার রুমে প্রবেশের অনুমতি দেন। প্রধান শিক্ষক জানতে চান, বলো তোমরা কী জন্য এসেছ।

-স্যার, আমরা এবার পরিবেশ দিবসে আমাদের স্কুলের মাঠের চারধারে এবং স্কুলের ফাঁকা জায়গাগুলোতে গাছের চারা লাগাতে চাই। আমরা টিফিনের টাকা থেকে কয়েক দিন টাকা সঞ্চয় করে ৩০০ টাকা জমিয়েছি। পায়েল ভয়ে ভয়ে কথাগুলো বলে। স্যার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান। পায়েলরা তো ভয় পেয়ে যায়। স্যার তাদের মারধর করে কি না। না, স্যার সবাইকে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, আমিও আছি তোমাদের সঙ্গে। আমি ৫০০ টাকা দেব। স্কুল ফান্ড থেকেও কিছু টাকা দেওয়া হবে তোমাদের। এ টাকা দিয়ে বাঁশের ঘেরা দিতে হবে গাছের চারাগুলোকে, যাতে কেউ গাছের চারার ক্ষতি করতে না পারে। সবার মনের ভয় কেটে গেল। পুরো স্কুলে পায়েলদের প্রশংসা শুরু হয়ে গেল। পায়েলদের ক্লাসের মতো সব ক্লাসের ছেলেমেয়েরা নিজেরা টাকা জমিয়ে স্কুলের পাশের সব রাস্তায় গাছের চারা লাগাতে শুরু করল। এভাবে পুরো গ্রাম ছাড়িয়ে উপজেলার সব ইউনিয়ন ও গ্রামে বৃক্ষ রোপণের আন্দোলন শুরু হয়ে গেল। কয়েক বছরে সারা উপজেলায় বনায়ন হয়ে গেছে। বর্ষাকালে বৃষ্টি হচ্ছে, শীতকালে কুয়াশা ঘেরা হিম হিম ঠা-ায় খেজুর রসের তৃপ্তি, মাঠে মাঠে সবুজ ধান আর নানা ফসলের সমারোহ। কী সুন্দর পরিবেশ। সকাল হলেই হরেক পাখির ডাকাডাকি পায়েলদের বাড়ির চারদিকে। সবাই এখন গাছের যত্ন করছে। গাছ যে মানুষের জীবন। গাছ অক্সিজেন দেয় বলেই তো মানুষ ও অন্য প্রাণীরা অক্সিজেন নিয়ে সুখে বাঁচতে পারছে। পায়েল তার বন্ধুদের নিয়ে প্রতিদিন স্কুল থেকে এসে একবার করে গাছের যতœ নেয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist