অনিন্দ্য আনিস

  ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২

দাদুর প্রতি অভিমান

শরীফ মনে মনে ঠিক করল। দাদুভাইয়ের সঙ্গে আর কখনো কথা বলবে না। কেন-ই বা বলবে? দাদুভাই তো শুধু বকাবকি করে। একটুও ভালোবাসে না। আগে দাদুভাইকে ছাড়া এক মিনিটও থাকতে পারত না। আর দাদুভাইও তাকে ভীষণ ভালোবাসত। হঠাৎ করে কেন দাদুভাইয়ের মধ্যে এমন পরিবর্তন। সে খু-উ-ব চিন্তা করে এই বিষয়টা নিয়ে। রোজ রোজ এই বকাবকি আর ভাল্লাগে না। আমি দূরে কোথাও চলে গেলেই মনে হয় ভালো হয়। কাউকে কিছু না বলে, বাসা থেকে বেরিয়ে শরীফ হন্ হন্ করে হাঁটতে থাকে। দুচোখ যেদিক যায় আজ সেদিকেই চলে যাব। আমি গেলেই বা কী? কেউ তো আর আমাকে নিয়ে ভাবে না! এবার সবাই খুব ভালো থাকবে। আমি আর জ্বালাব না। সেদিনও দাদুভাই আমাকে বকেছে। কেনই বা বকবে? আমি তো কখনো দাদুভাইয়ের কথা অমান্য করি না। আমি তো নিয়মিত পড়াশোনা করি, স্কুলে যাই। প্রাইভেট যাই। তবু কেন দাদুভাই আমাকে বকে? এই প্রশ্নের উত্তর ভাবতে গেলেই মন খারাপ হয়ে যায়।

সেদিন বিকালে দুটো ছড়া লিখতে গিয়ে, একটা বানান ভুল হওয়ায় সেকি ভয়ানক কাণ্ড! এর জন্য আমাকে ছত্রিশবার কান ধরিয়ে ওঠবস করিয়েছে। কাকার ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়ে মুখ চেপে হেসেছিল আমার কানে ধরানো দেখে। লজ্জায় আমি মাথা উঁচু করতে পারিনি। তারপর আবার দাদুভাই ওই বানান দুটো খাতায় বিশবার করে লেখা চাই বলে হুকুম করেছিল। হাঁটে আর এসব ঘটনা শরীফ মনে করে ভীষণ কষ্ট পায়।

শরীফ হাঁটতে হাঁটতে কোথায় জানি চলে এসেছে। সেটা বুঝে উঠতে পারেনি। চারদিকে শুধু গাছ আর গাছ। কোথাও কোনো ঘরবাড়ি নেই। ভয়ে দাঁড়িয়ে যায়। মাঝেমধ্যে অদ্ভুত আওয়াজ কানে ভেসে আসে। ভাবছে বাড়িতে কি ফিরে যাব? এসে কি তবে ভুল করেছি? যখনই দাদুভাইয়ের কথা মনে পড়ে তখনই রেগে বলে, ‘না, আমি আর কখনো বাড়িতে যাব না। যা হওয়ার হবে। আমি দূরে কোথাও চলে যাব। এই যা, বাড়ি থেকে তো কিছু খেয়ে আসিনি। এখন হবে কী? এদিকে খিদায় পেটটা আর্তনাদ করছে। বলছে ভাই তুমি যেখানে যাওয়ার যাও, কিন্তু আমাকে কেন এভাবে উপোস রেখে কষ্ট দিচ্ছো? তোমার নিজের প্রতি বুঝলাম মায়া নেই। তাই বলে তোমার জন্য আমি কেন মরতে যাব? শরীফ লজ্জায় তার কথায় সায় দেয় না।

কিছুক্ষণ সময়ের জন্য শান্তি পায়। গাছের ছায়ায় গিয়ে বসল। সেখানে গিয়েও বেশিক্ষণ থাকতে পারেনি, লাল পিঁপড়া দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল। গাছের ডালে যেই বসতে গেল দুষ্টু কাকের দল কোথায় থেকে এসে মাথায় কয়েকটা ঠোকর বসিয়ে দিল। দাদুভাইয়ের কথা ভীষণ মনে পড়ছে। পানির পিপাসায় প্রাণটা বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। মনে পড়ল ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা পানি এনে দাদুভাই টেবিলের ওপরে রেখেছিল। ইশ্ বাড়িতে থাকলে এখন ঠাণ্ডা পানি খেতে পারতাম। আবার ভাবে বেশ করেছি, চলে এসেছি এখন তো আর দাদুভাই বকাবকি করছে না।

শরীফ নদীর পাড়ে এসে দাঁড়াল। ওয়াও! নদীর পানি একদম স্বচ্ছ। মাছেদের খেলাও দেখা যাচ্ছে। নদীতে পাল তোলা কী সুন্দর হরেক নৌকা! দেখে মন জুড়িয়ে যায়। যেই প্যান্টটা হাঁটুতে তুলে পানিতে গিয়ে হাত ডোবাল। ওমনি এক জলপরী ভেসে উঠল। শরীফ খুব সাহসী ছেলে একটুও ভয় পায়নি। বরং বলছে অ্যাই তুমি কি জলপরী? আমার ক্লাস ফোরের বাংলা বইয়ে তোমার মতো একটা পরী দেখেছিলাম। পরী বলল, ‘বাহ! তুমি তো ভারী মিষ্টি ছেলে। বুদ্ধিও আছে বটে। আর মিষ্টিই হবে না কেন? তোমার গায়ের রং আকাশের মতো ফকফকা। এই অবেলা কোথায় থেকে এলে? তোমার ভয় নেই? এই ঘন-জঙ্গলে গত সাতাশ বছর কেউ আসেনি। তুমি কেমন করে এলে? আর কেনই বা এলে?

ঘরের কথা কী আর কাউকে বলা যায়? শরীফ মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। সে দাদুভাইয়ের সম্পর্কে অপরিচিত কারো কাছে কিছু বলতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। জলপরী বলল, ‘আমি তোমার বন্ধু, আমাকে তুমি সবকিছু বলতে পারো। শেষে শরীফ সবকিছু খুলে বলল। জলপরী হাহাহা হিহিহি করে হেসে উঠল। বলল, ‘তুমি ভীষণ বোকা ছেলে? কেউ দাদুভাইয়ের প্রতি রাগ করে এত দূর আসে? আর তুমি কি জানো না? বড়রা যা করে সর্বদা ছোটদের ভালোর জন্য করে। তোমার দাদুভাই তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে বলেই তোমার প্রতি সে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিচ্ছে। যাতে তুমি ছোট থেকেই পড়াশোনায় ভালো হয়ে উঠো, সেজন্য তোমার প্রতি এ রকম করে।

এটা ব্যাপার না শরীফ। যাও সন্ধ্যা হওয়ার আগেই বাসায় ফিরে যাও। নয়তো দাদুভাই চিন্তা করবে। জলপরীর কথা শুনে শরীফ নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত। দাদুভাইয়ের কথা মনে করে হু-হু করে কেঁদে উঠল। জলপরী জল থেকে ডাঙায় উঠে এলো। জলপরী বলল, ‘শরীফ তুমি কি জান? আমি জলপরী না? কী করে জানবেই বলো? তোমাকে তো এখনো বলা হয়নি। আমি আসলে মেঘপরী। এক রাক্ষসীর অভিশাপে সাতাশ বছর এই পানিতে জলপরী হয়ে কাটিয়েছি। তোমার স্পর্শে আমি আগের রূপ ফিরে পেয়েছি। ওহ তাই, এই বলে শরীফ খুশিতে আত্মহারা।

মেঘপরী বলল, ‘আমার পিঠে এসে বসো তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি। শরীফ মেঘপরীর পিঠে গিয়ে বসল। মেঘপরী তুলতুলে আকাশের বুকের ওপর নিয়ে গেল। সেখানে রূপকথার রাজ্য, মেঘপরীদের রাজ্য। স্বপ্নে দেখা ইরাবতীর রাজ্য দূর থেকে দেখিয়ে এলো। মেঘপরী কথা দিয়েছে অন্য এক দিন সবগুলো রাজ্য দেখাতে নিয়ে যাবে। মেঘপরী শরীফকে বাসায় রেখে চলে গেল। শরীফ বিড়বিড় করে বলছে, মেঘপরী তুমি যেও না আমকে ছেড়ে, তোমার সঙ্গে নিয়ে যাও। এই বলতে না বলতে খাট থেকে মাটিতে পড়ে গেল।

এতক্ষণে হুঁশ ফিরল, দাদুভাই বলল, ‘কী হয়েছে দাদুভাই এতক্ষণ একা একা কীসব বলছিলে? আর মেঘপরী কোথায় থেকে পেলে? একা কোথায় থেকেই বা আসবে? শরীফ বুঝতে পারল এতক্ষণ সে স্বপ্ন দেখছিল। তাই লজ্জায় মুখ কাঁথায় ঢেকে নিল। দাদুভাই হাসছে আর বলছে পাগল একটা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close