সাদিক আল আমিন

  ২৬ অক্টোবর, ২০১৯

মুমতাহা ও পিচ্চি ভূতছানা

নানুর বাড়িতে প্রায়ই যাওয়া হয় মুমতাহার। নানুবাড়ি যাওয়াটা ওর কাছে অনেক আনন্দের। আনন্দের না হয়ে মন খারাপের হবেইবা কেন? সেখানে কি মন খারাপ হওয়ার কোনো ফুসরত আছে? ফাইজা, আফরীন আর তন্নী আছে না? চার বান্ধবী মিলে জম্পেশ মজা করা যায় নানুবাড়ি গেলে। মুমতাহার তো ইচ্ছে করে যেন ওখানে থেকেই যায়। কিন্তু আব্বু আম্মু থাকতে দেয় না। বাড়িতে এসে নাকি স্কুলে যেতে হবে, কোচিং করতে হবে। এত কি আর ভালো লাগে! ওর তিন বান্ধবী তো ওখানেই পড়ালেখা করে। একবার আম্মুকে আবদার করে বলেছিল, আম্মু, ফাইজা, আফরীনদের মতো আমাকেও নানুবাড়ির ওখানকার স্কুলে ভর্তি করিয়ে দাও। আমি সেখান থেকে পড়াশোনা করব। কিন্তু সেই বলাই ছিল শেষ বলা। আম্মু এত কড়া ধমক দিয়েছিল যে ও পরেরবার আর কিছু বলার সাহস পায়নি। আম্মু বলেছিল, সেখানে ভর্তি করিয়ে দিলে তো পড়ার নামটাও মুখে নেবে না। দিন-রাত শুধু খেলা খেলা করবে। আম্মু ঠিকই বলেছে। নানুর বাড়িতে গেলে ওর তিনটে বান্ধবী ছাড়া আর কিছুই বোঝে না মেয়েটা।

মুমতাহা যখন কয়েক দিন নানুবাড়িতে থেকে বাসায় ফেরত আসে, তখন ওর খুব মন খারাপ হয়। আর কটা দিন থেকে গেলে কি হতো? তন্নী যে ওকে একটা ভূতের ছানা দেখাতে চেয়েছিল!

‘জানিস মুমতাহা, আমারা তিনজনে মিলে একটা ভূতের বাড়িতে গিয়েছিলাম। ভূতের বাড়িতে অনেকগুল ভূতের ছানা আছে। তার মধ্যে একটা দেখতে খুব কিউট আর খুব বদমাইশ। সেদিন তো ফাইজার বেণি ধরে দিল টান। হাহাহা বলেই খিলখিল করে হাসতে ধরেছিল তন্নী। সেসব কথা মনে করে মনটা আরো খারাপ হয়ে যায় ওর। ইশ! কেন যে আম্মুটা আর দুটো দিন থাকল না! ভূতের বাড়ি আর ওই কিউট ভূতছানাকে ঘিরে কৌতূহল বাড়তে থাকে মুমতাহার। এসব ভাবতে ভাবতেই চেয়ারে বসে ঘুমিয়ে পড়ে।

পরদিন সকালে ঘড়ির অ্যালার্মে ঘুম ভাঙে। ৭ টা বেজে গেছে। ৮ টায় স্কুল। তাড়াতাড়ি করে স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হতে লাগল মুমতাহা। বাথরুম থেকে ফিরে ড্রেস হাতে নিয়েছে, এমন সময় আম্মু বলল, আজ স্কুলে যেতে হবে না। মুমতাহা কিছুটা ভয় পেল। সে উল্টোপাল্টা কেনো কিছু করে বসেনি তো! তাহলে কেন আম্মু স্কুলে যেতে না করছে? আম্মু আবার বলল, নতুন কাপড়গুল পরো। তোমার নানুবাড়ি যাব। মুমতাহা আম্মুর কথা হঠাৎ করে বুঝতে পারল না। যখন বুঝতে পারল যে আম্মু আজ নানুবাড়ি যাবে, সঙ্গে সেও যাবে, তখন ইচ্ছে হচ্ছিল দে এক লাফ। কিন্তু আম্মুর সামনে নিজেকে সংবরণ করল। আম্মু বলল, যাও রেডি হয়ে আসো। তোমার নানু এবার কোরবানিতে বিরাট বড় একটা গরু কিনেছে। পাড়াসুদ্ধ সব লোক নাকি দেখতে আসছে। আমরাইবা আর বাদ পড়ব কেন? তাই ভাবলাম, গিয়ে দেখে আসি। আজ গিয়ে কালই চলে আসব। তোমার আবার স্কুল আছে। মুমতাহার যেমন মন ভালো হয়েছিল, তেমনি আবার মন খারাপও হলো। মাত্র এক দিন! তাহলে তো কোনোকিছুই ভালোভাবে হবে না। তবু নাই মামার চেয়ে কানা মামাই ভালো। প্রবাদে নিজেকে সন্তুষ্ট করে রেডি হতে যায় মুমতাহা।

মুমতাহা বরাবারের মতোই বাসে জানালার পাশে বসে। নানুবাড়ি যাওয়ার আনন্দ যেন ওর বুকে আর ধরে না। বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। হাওয়ায় ওড়ে ওর ছোট ছোট সিল্কি চুল। বাইরের মাঠঘাট দেখতে দেখতে ভাবে, আজ যে করেই হোক ফাইজা, তন্নী আর আফরীনকে সঙ্গে নিয়ে ভূতের বাড়িতে যেতে হবে। পিচ্চি ভূতের কারসাজি দেখার উত্তেজনা যেন তার শেষ হয় না। আম্মু তো আগেই বলে দিয়েছে, কালই চলে আসবে। সুতরাং আজকেই শেষ সময়।

নানুবাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তাদের বিকাল লেগে যায়। চার ঘণ্টা ধরে জার্নি করে আম্মু আর মুমতাহা দুজনেই এখন ক্লান্ত। নানুর কেনা বিশাল গরুটাকে দেখে, নাদুসনুদুস গরুটার প্রশংসা করে আম্মু গেল রেস্ট করতে। মুমতাহাকে তার সঙ্গে শুতে বললে ও বলল, ‘আম্মু, আমি গরুটাকে আরেকটু দেখি তারপর শুতে যাব। আম্মু ওকে অনুমতি দিল। আবার সাবধানও করে দিল, যাতে কোথাও না যায়।

কিন্তু মুমতাহার মনে তো অন্য ফন্দি। আম্মু শুয়ে পড়তেই ও দৌড় দিল তন্নীর বাড়ি। তন্নীকে ডেকে বাকি দুজন বান্ধবীর বাড়িতে গেল তাদের ডাকতে। সবাইকে ডেকে এনে একসঙ্গে মিলিত হলো চার বান্ধবী। তখন সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। মুমতাহার নানুবাড়ির চারপাশজুড়ে জঙ্গল, সন্ধ্যা পড়তে না পড়তেই অন্ধকার নেমে আসে। কিন্তু চার খুদে বান্ধবীর সেদিকে খেয়াল নেই। তারা ভূতের বাড়িতে যাওযার জন্য ব্যস্ত। ঠিক সেভাবেই প্ল্যান তৈরি করে ফেলল তারা। যেহেতু আগেরবার মুমতাহার অনুপস্থিতিতে ওরা তিনজনই কেবল গিয়েছিল, সেহেতু মুমতাহা ঠিক করল এবারে দলনেত্রী হবে সে। তার পিছে পিছে আসবে বাকিরা। এটা ওর দাবি। আফরীন একটু অন্য সুর করে বলল, সন্ধ্যা হয়ে গেলরে। এখন যাবি? যদি ভূত ঘাড় মটকে দেয়? তন্নী এক ধমকে থামিয়ে দিল আফরীনকে, ধুর তুই চুপ কর তো। যে না পুঁচকি কটা ভূত, তাদের আবার ঘাড় মটকানো! বোতলে পুরে নিয়ে আসব সবকটাকে এবার দেখিস। সেবার ফাইজার চুলের বেণি ধরে টেনেছিল না? ওই যে বদমাইশ পুঁচকে ভূতটা? ওকে তো বোতলে পুরবই। তারপর সবাই মিলে ভূত পোষব। মানুষ বিড়াল, কুকুর পোষে। আমরা পোষব ভূত। হাহাহা। ফাইজা বলে, এহ দেমাগ কত। দেখা যাবে কে কাকে পোষে। এখন চল। সবাই ভূতবাড়ির উদ্দেশে রওনা হয়।

মুমতাহা বড় বড় কথা বললেও ওর কিছুটা ভয় করতে থাকে। কিন্তু দলনেত্রী হয়ে ভয় করলে তো মানায় না। সে হাঁটতে থাকে কোনো রকম সংকোচ না করে। তন্নী তার পাশাপাশি হাঁটে, রাস্তা দেখায়। কেননা মুমতাহা এর আগে যায়নি বলে রাস্তা চেনে না। পেছন থেকে ফাইজা ভেংচি কেটে বলে, রাস্তা চেনেনা আবার দলনেত্রী! মুমতাহা সেদিকে কান দেয় না। সন্ধ্যা গড়িয়ে তখন রাত ঘনিয়ে আসছে। টর্চ মেরে রাস্তা দেখে ওরা।

১০ মিনিটের মধ্যে অনেক বছরের পুরোনো, পরিত্যক্ত একটা বাড়িতে এসে পৌঁছে। ভাঙা জানালা, দরজা নেই, দোতলা বাড়িটার দেয়ালগুলো শ্যাওলায় ভরে কালো কুচকুচে হয়ে গেছে। জায়গাটা এত অন্ধকার যে টর্চলাইটও ভালোভাবে কাজ করে না। আফরীন বলল, চল যাওয়া যাক। দেখি তোদের কেমন বুকের পাটা। মুমতাহার যেতে ইচ্ছে করছিল না বাড়িটা দেখে। বইয়ে পড়া ভূতের গল্পগুলো মতো মনে হয়। যেন সে-ই এখন গল্পের মূল চরিত্র।

টর্চ হাতে ওরা সবাই খোলা ঘরে ঢুকে। মুমতাহার হাত ভয়ে মৃদু কাঁপছে। ফাইজা বলল, কিরে চল। দাঁড়িয়ে আছিস কেন? দোতলায় উঠতে হবে। ওখানে ভূতের ছানাগুল আছে। আফরীন বুঝতে পারে যে মুমতাহার ভয় করছে। তাছাড়া এমন জায়গায় ও আগে কখনো আসেনি। ওরা তিনজন আগে এসেছিল বলে ওদের তেমন ভয় করছিল না। তিন বান্ধবীর জোরাজুরিতে মুমতাহাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও দোতলায় উঠতে হলো। সে এখন আর দলকে নেতৃত্ব দিতে পারছে না। ভয়ে একদম আড়ষ্ট হয়ে গেছে। ওর জায়গা নিল তন্নী। মুমতাহার হাত থেকে লাইটটা নিয়ে বলল, আয় আমার সঙ্গে।

দোতলায় উঠতে গিয়ে মুমতাহা লক্ষ করল, বাড়িটার যেমন পুরোনো তেমনি সিঁড়িগুলো পুরোনো। কাঠের সিঁড়ি সবগুলো। তারপর আবার ভাঙা। একটার পর একটা সিঁড়ি বেয়ে খুব সাবধানে উঠতে লাগল ওরা। মুমতাহা মনে মনে ভাবে, না জানি দোতলায় কী অপেক্ষা করছে তার জন্য! নিচতলায় দেখা দুটো মানুষের কঙ্কাল আর একটা ভাঙা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি দেখে ওর মনে ভয় জেগেছে। কাঠের সিঁড়ির ওপর পা ফেলে ধীরে ধীরে কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই দোতলায় উঠে আসে। মুমতাহা চোখ প্রায় বন্ধুই করে ফেলেছিল ভয়ের তোড়ে। ফাইজার চিমটিতে চোখ খুলল। দেখেই মাথায় হাত! রেডিয়ামের মতো সবুজ রঙের অনেকগুলো পিচ্চি ভূতের ছানা সবাই একসঙ্গে খেলছে। অদ্ভুত তাদের খেলার ধরন। মানুষের বাচ্চারা যেমন খেলে, তেমন খেলা না। একদম ভিন্নধর্মী খেলা। মুমতাহা বুঝতে পারে না কি খেলা খেলছে ওরা। কিন্তু ওদের উৎসাহ দেখে মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই সেটা অনেক মজার খেলা।

‘ওই দেখ, ওই যে বদমাইশ ভূতছানাটা। বলে জোরে চেঁচিয়ে উঠল তন্নী। মুমতাহা তাকাল সেদিকে। দেখল, অন্যান্য ভূতের তুলনায় অনেক ছোট সেই ভূত; আর গায়ের সবুজ রঙের বিকিরণ যেন ঠিকরে পড়ছে। অনেক উজ্জ্বল দেখাচ্ছে ভূতের বাচ্চাটাকে। অনেক কিউট আর আদুরে। এসব দেখে মুমতাহার ভয় অজান্তেই হারিয়ে যায়। ভূতছানাটা দেখে যে সেদিনকার তিনজন মেয়ে আবার তাকে ক্ষ্যাপাতে এসেছে। সেবার তো একজনের চুলের বেণি টেনে ধরেছিল, এবার বেশি বাড়াবাড়ি করলে দিতে হবে এক ধাক্কা দিয়ে ফেলে। পিচ্চি ভূতছানা দেখল, একটা নতুন মেয়ে এসেছে ওদের সঙ্গে। এটা আবার কে!

ততক্ষণে চার বান্ধবী ভূতছানাটার কাছে এসে গেছে। তন্নী ভূতটার গাল টেনে বলল, কিরে কিউট ভূত, কী খবর? তোকে বিরক্ত করার জন্য আরেকজনকে নিয়ে এসেছি। এবার চারজন মিলে তোকে ক্ষ্যাপাব। ভূতছানাটা তার গোলমুখে ভেংচি কেটে বলল, দেখা যাবে কে কাকে ক্ষ্যাপায়। মুুমতাহা ভূতছানাটাকে বলল, আমার সঙ্গে খেলবে? ভূতছানা কিছুটা সময় নিল ভাবার। তারপর সম্মতি জানালে সবাই মিলে মজা করে খেলতে লাগল। মুমতাহা ভূতছানাকে জিজ্ঞেস করল, এই খেলা তোমরা কোথায় শিখলে? আমরা তো কখনো এ রকম খেলা খেলিনি। ভূতছানা বলল, আমার বাবার শেখানো খেলা এটা। সবাই বই পড়ার ভঙ্গিতে খেলবে। বই পড়তে পড়তে খেলা আবার খেলতে খেলতে বই পড়া। যেমন ধরো বইয়ে পড়া মুখস্থ করার সময় কোথাও কোনো খেলার নাম পেলে, ধরো লেখা আছে কানামাছির কথা। তখনি আমরা সবাই একযোগে কানামাছি খেলা শুরু করি। কিছুক্ষণ খেলে আবার পড়তে বসি। আবার কোনো পৃষ্ঠায় খেলার কথা থাকলে খেলি। পড়াশোনার সঙ্গে খেলাও একসঙ্গে হয়। আমরা একসঙ্গে দুটো কাজ করি। মুমতাহা ওদের খেলাপড়ার ধরন দেখে মজা পায়। ভালোই তো। আম্মুর কাছে আর খেলার জন্য বকা খেতে হবে না। আম্মু নিশ্চয়ই এই পদ্ধতিটা পছন্দ করবে।

মুমতাহার চোখ হঠাৎ করে ওর হাতঘড়িতে পড়ে। দেখে রাত ৮টা বেজে গেছে। সর্বনাশ! এখন কী হবে! আম্মু নিশ্চয়ই এতক্ষণে জেগে গেছে আর তাকে খোঁজাখুঁজি করছে। মুমতাহা তন্নী, ফাইজা আর আফরীনকে বলল, চল চল বাড়ি চল জলদি। ৮টা বেজে গেছে। বকা খেতে হবে আজ নিশ্চিত। আমাদের জন্য চিন্তা করছে মনে হয়। তন্নী বলল, হ্যাঁ জলদি চল। অনেক রাত হয়ে গেছে। পিচ্চি ভূতছানাকে বিদায় দিয়ে চার বান্ধবী বাড়িতে ফিরে এলো। মুমতাহা আম্মুর ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল আম্মু এখনো শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। আহ্ বাঁচল যেন।

পরদিন সকালে ট্রেনে করে বাড়ি ফিরে এলো মুমতাহা আর আম্মু। গত রাতের কথা খুব মনে পড়তে লাগল ওর। ভূতছানার সঙ্গে তো ভালোভাবে কথাই বলা হলো না। ওরা আরো কী কী মজার খেলা খেলে, সেসব তো জানা হলো না। খুব ভালো হতো যদি ভূতছানাটাকে সঙ্গে আনতে পারত। কিন্তু ওরও যে বাবা-মা আছে, কীভাবে আসবে! মুমতাহার খুব ইচ্ছা করছিল আরো কটা দিন থেকে যেতে। কিন্তু আম্মু একদমই থাকতে দিল না। পরেরবার নানুর বাড়িতে গেলে পিচ্চি ভূতছানাটার সঙ্গে অনেক মজা করে খেলা যাবে; ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল সে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখল, ওই ভূতছানাটার সঙ্গে সে পড়াখেলা খেলছে। পড়তে পড়তে খেলা আর খেলতে খেলতে পড়া। ঘুমের ঘোরে হাসতে লাগল মুমতাহা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close