কবির কাঞ্চন

  ০৬ জানুয়ারি, ২০১৮

রাগ

তুলি, তোমার আম্মুকে তাড়াতাড়ি চা দিতে বলো। টাইটা পরতে পরতে ব্যস্ত গলায় বললেন জেসান মাহমুদ। ‘জি বাবা’ বলে রান্নাঘরের দিকে চলে যায় তুলি। তুলি জেসান মাহমুদের একমাত্র মেয়ে। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। বাবাকে কাছে পেলে ওর খুব ভালো লাগে। তবু ভয়ে ভয়ে চলে। মনের কথা মুখে বলা হয় না। ও দেখে বাবা রোজ অফিস থেকে দেরি করে বাসায় ফেরেন। সব সময় গম্ভীর থাকেন। সারাদিনের অনেক কথাই বাবাকে বলতে তার মন চায়। স্কুলের বন্ধুরা যখন ওদের বাবাকে নিয়ে মজার মজার গল্প করতে থাকে তখন সে গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকে। তারপর ইনিয়ে-বিনিয়ে বাবাকে নিয়ে গল্পে মাতে। তুলির মা রান্নাঘরে স্বামীর আর মেয়ের টিফিনের নাস্তা তৈরিতে ব্যস্ত। আগ বাড়িয়ে তুলির হাতে এককাপ চা তুলে দিয়ে বললেন,

Ñতোমার বাবাকে দাও। আমি তোমার নাস্তা রেডি করে আসছি। ‘আচ্ছা’ বলে চা নিয়ে বাবার কাছে আসে তুলি।

জেসান মাহমুদ ড্রেসিং টেবিলে চুল আঁচড়ানো শেষ করে পেছনে ফিরতেই তুলির হাতের চায়ের কাপের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। অমনি তুলির হাত থেকে চায়ের কাপটা ছিটকে পড়ে। এতে তার পোশাকেও সামান্য দাগ পড়ে যায়। তুলির পায়ে পড়লে সে ‘উহ!’ করে চিৎকার দেয়। জেসান মাহমুদ উত্তেজিত হয়ে ওর গালে একটা চড় বসিয়ে দেন। তুলি চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। তার চিৎকার শুনে মা রান্নাঘর থেকে ছুটে আসেন। ততক্ষণে জেসান মাহমুদ তড়িগড়ি করে অফিসের উদ্দেশে বের হয়ে যান। অফিসে প্রবেশ করতেই তার চোখে পড়ে কাস্টমারের লম্বা লাইন। হাতঘড়িটার দিকে একনজর তাকিয়ে মাথা নিচু করে চেয়ারে এসে বসেন। ব্যাগ থেকে ল্যাপটপটা বের করতেই চিন্তিত হয়ে পড়েন। উত্তেজিত মাথায় তড়িগড়ি করে বের হতে গিয়ে ভুল করে ল্যাপটপটা আনা হয়নি। এখন কীভাবে কাজ করবেন। এ নিয়ে তিনি বেশ চিন্তায় পড়ে গেলেন। ওদিকে কাস্টমাররাও হইচই শুরু করে দিয়েছেন। ব্যাংকের মধ্যে হইচই শব্দ শুনে ম্যানেজার এগিয়ে আসেন। তারপর কাস্টমারদের শান্ত করে জেসান মাহমুদকে সরিয়ে আরেকজন অফিসারকে তার চেয়ারে বসিয়ে দেন। এরপর জেসান মাহমুদকে সঙ্গে করে ম্যানেজার নিজ কক্ষে প্রবেশ করেন।

জেসান মাহমুদ মাথা নিচু করে বসে থাকেন। ম্যানেজার জেসান মাহমুদকে জিজ্ঞেস করলেন,

Ñজেসান সাহেব, বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি আপনি অফিসে দেরি করে আসছেন। কাস্টমারের সঙ্গেও কথায় কথায় রেগে যাচ্ছেন। কিন্তু কেন?

Ñস্যার, আর এমনটি হবে না।

Ñব্যাংক আপনাকে চাকরিতে নিয়েছে কাস্টমারকে সর্বোত্তম সেবা দেওয়ার জন্য। যদি তা না পারেন, চাকরি ছেড়ে দিতে পারেন। অসন্তোষের মধ্যে কাজ করার চেয়ে না করাই ভালো। প্রয়োজনে ছুটি নিয়ে কোথাও থেকে ঘুরে আসুন। এভাবে চাকরি করতে পারবেন না। আপনাদের সবার কর্মকা-ের ওপর নিয়মিত আমাকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে রিপোর্ট করতে হয়। আপনার ব্যাপারে এত দিন আমি সফট রিপোর্ট দিয়েছি। এরপর থেকে আমি জেনুইন রিপোর্ট দিয়ে দেব। আজ আর কাজ করতে হবে না। আপনি মাহবুব সাহেবের চেয়ারে গিয়ে বসেন। ছুটির সময় আবার দেখা করবেন। কাল থেকে নিয়মিত অফিস করবেন। আর হ্যাঁ, এই চিঠিটা নিন।

এই কথা বলে কাজে অমনোযোগ ও বিলম্বে অফিসে আসবার কারণ দেখিয়ে কারণ দর্শানো নোটিস ধরিয়ে দেন। মন খারাপ অবস্থায় ম্যানেজারের কক্ষ থেকে বের হতে দেখে তার সহকর্মী মিলাদ হোসেন কাছে ডেকে পাশের চেয়ারে বসতে দেন।

কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর মিলাদ হোসেন বললেন,

Ñজেসান ভাই, ম্যানেজার স্যার কী বলেছেন? জেসান মাহমুদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, স্যার আমাকে কারণ দর্শানো নোটিস ধরিয়ে দিয়েছেন।

Ñদেখুন জেসান সাহেব, সেই প্রথম থেকে দেখে আসছি আপনি যেকোনো সামান্য বিষয়েও সিরিয়াস থাকেন। কারণে-অকারণে রেগে যান। এমনকি কাস্টমারের সঙ্গেও। আজকের যুগে যেখানে ব্যাংক চায় কাস্টমারদের সঙ্গে সুন্দর ব্যবহার ও অনুপম সেবা দেওয়া। সেখানে এমন অভ্যাস ছাড়তে না পারলে প্রতি পদে পদে অসম্মানে পড়তে হবে। কথায় আছে ‘রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন।’

জেসান মাহমুদ একটু সময় নিয়ে বললেন,

Ñমিলাদ ভাই, আপনি একদম সঠিক কথা বলেছেন। আমি কোনো অনিয়ম পছন্দ করি না। সব ঠিকঠাকমতো চললে মেনে নিই। সেই ছেলেবেলা থেকেই কোনো কিছু আমার মনের মতো না হলে রেগে যায়।

Ñএখানেই আপনার ভুল। আপনি শুধু আপনাকে বুঝতে পারবেন। কিন্তু অন্য সবাই যে যার মতো। নানা মুনির নানা মত। কেউ আপনাকে বুঝতে পারে। আবার কেউ নাও বুঝতে পারে। তাই অন্যের ভাল লাগা আর খারাপ লাগার কথাও আপনাকে ভাবতে হবে।

এবার বলুন, আজ অফিসে আসতে দেরি হলো কেন?

Ñসকালে রেডি হয়ে অফিসে আসার সময় আমার মেয়ে তুলি চা নিয়ে আসে। তখন আমি ড্রেসিং টেবিলে চুল আঁচড়িয়ে পেছনে ফিরছি মাত্র। এমন সময় তুলির হাতে থাকা চায়ের কাপের সঙ্গে আমার ধাক্কা লাগে। ওর হাত খসে চায়ের কাপটা পড়ে যায়। আমার শার্ট-প্যান্টে চায়ের দাগ লাগে। মুহূর্তে আমার মাথা গরম হয়ে যায়। রাগের মাথায় ওর গালে কষে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিই। তারপর তড়িগড়ি করে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ি। অফিসে এসে দেখি আমার কাস্টমারের লম্বা লাইন। ব্যাগে হাত দিয়ে দেখি ভুল করে ল্যাপটপটা আনা হয়নি। ওদিকে কাস্টমাররাও উত্তেজিত হয়ে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে। তার পরের সব তো আপনার জানা আছে।

মিলাদ হোসেন মাথা নেড়ে বললেন,

Ñএটা আপনি ঠিক করেননি। তুলি ছোট মানুষ। ওকে থাপ্পড় দেওয়াটা একদম ঠিক হয়নি। বরং সান্ত¡না দেওয়া যেত। এতে ও ভবিষ্যতে আরো সাবধান হতো। কিন্তু এ রকমের পরিস্থিতিতে মারলে বাচ্চাকাচ্চার আত্মবিকাশ কমে যায়। ও যে আপনার জন্য চা নিয়ে এসেছিল তার জন্য ওকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত ছিল।

Ñহ্যাঁ, আপনি ঠিক বলেছেন। কিন্তু সে সময় হঠাৎ মাথাটা গরম হয়ে গিয়েছিল।

Ñআপনার একজনের একটিমাত্র ভুলে আজ পরিবারের সব সদস্যের মধ্যে অসন্তোষ বিরাজ করছে। আপনি অফিসে স্বাভাবিক কাজ করতে পারছেন না। আবার বাসায় গেলে হয়তো দেখবেন ভাবিরও মন খারাপ। স্বভাবত মেয়ের কান্নায় মায়ের মন খারাপ হবেই। তুলি আবার রাগ করে স্কুলে নাও যেতে পারে। তার মানে সবকিছু এলোমেলো। তাই বলছি, মনের মধ্যে রাগ বেশি হলে কষ্ট করে হলেও নীরব থাকবার চেষ্টা করুন। যেকোনো জটিল সমস্যা সামনে এলে ঘাবড়ে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। ভেবেচিন্তে তা বুদ্ধিমত্তার সাথে মোকাবিলা করতে হবে। কোনো কিছু মনের মতো না হলে রেগে নয় ভালোবেসে সমাধান করার চেষ্টা করুন। দেখবেন পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে গেছে।

জেসান মাহমুদ ঘাড় নেড়ে বললেন, এরপর থেকে আপনার এই কথাগুলো আমি মেনে চলব।

Ñজেসান ভাই, স্যার আর কী বলেছেন?

Ñস্যার বলেছেন, মাহবুব সাহেবের চেয়ারে বসে থাকতে।

Ñঠিক আছে। আর কোনো চিন্তা করবেন না। ছুটির পর দেরি না করে সোজা বাসায় ফিরে যাবেন। ভাবি আর বাচ্চার সঙ্গে সুন্দর করে কথা বলবেন। দেখবেন আপনার একটু আদর পেলে তাদের মনের ব্যথা দূর হবে। আগামীকাল থেকে ঠিকমতো অফিসে আসবেন।

Ñধন্যবাদ, মিলাদ ভাই। এই বলে জেসান মাহমুদ পাশের চেয়ারে বসলেন।

অফিস শেষে তুলির পছন্দের লাড্ডু নিয়ে বাসায় ফিরেন জেসান মাহমুদ। তুলির মা দরজা খুলে ঘোমড়ামুখো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। তুলিও মন খারাপ করে ছলছল চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। জেসান মাহমুদ দুচোখের জল ছেড়ে দিয়ে মেয়ের দিকে দুই হাত বাড়িয়ে দিলেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist