দিলীপ কুমার আগরওয়ালা

  ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

মতামত

টেকসই সমাধান কাম্য

জঙ্গিবাদ দমনের নামে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযানের বদলে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী সাধারণ রোহিঙ্গাদের ওপর চড়াও হওয়ার কারণেই লাখ লাখ রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যার কোনো পক্ষ না হলেও সরকার তথা দেশের মানুষের ওপর চেপে বসেছে শরণার্থী সমস্যা। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভারে কক্সবাজার জেলা ইতোমধ্যে তার আপন বৈশিষ্ট্য হারাতে বসেছে। জেলার বাসিন্দাদের এক বড় অংশই এখন রোহিঙ্গা।

এমনিতেই শরণার্থী হিসেবে এবং পরিচয় গোপন করে আগে থেকেই কয়েক লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারে বসবাস করছে। আগস্টের ২৫ তারিখ থেকে বানের স্রোতের মতো মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের আগমনে এ জেলা কার্যত শরণার্থীদের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে। সবার ওপরে মানুষ সত্য-এই মানবিক তত্ত্বে উদ্বুদ্ধ হয়ে সরকার রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত খুলে দিতে বাধ্য হয়েছে। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়েছে কক্সবাজারের সামাজিক জীবনে। নিত্যপণ্যের দাম এ জেলায় বেড়েছে স্পুটনিক গতিতে। লাখ লাখ শরণার্থীকে ঠাঁই দেওয়ার কারণে উজাড় হচ্ছে পর্যটনের স্বর্গভূমি হিসেবে বিবেচিত কক্সবাজারের বনভূমি, পাহাড়, গাছপালা, লতাগুল্ম। বিপুলসংখ্যক মানুষের আগমনে হুমকির মুখে পড়েছে কক্সবাজারের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।

মিডিয়ার মতে, রোহিঙ্গা স্রোতে মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়েছে টেকনাফের সাবরাংয়ের এক্সক্লুসিভ ট্যুরিস্ট জোন। অনিয়ন্ত্রিতভাবে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যত্রতত্র বসতি গড়ে তোলায় পর্যটন নগর কক্সবাজারের পরিবেশ বিপন্নের আশঙ্কা করা হচ্ছে। শরণার্থীদের পুনর্বাসনে কক্সবাজারের পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের যেন ক্ষতি না হয়, সেদিকে সংশ্লিষ্টদের বিশেষ দৃষ্টি রাখার দাবি তুলেছেন পরিবেশবিদরা। উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, থাইংখালী; টেকনাফের হ্নীলা, হোয়াইক্যং, লেদা, মুছনী; বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির চাকডালা, তুমব্রু, জলপাইতলী, কলাবাগানসহ বিস্তৃত পাহাড় ও বনভূমির বাঁশ-গাছ উজাড় হয়ে পড়ছে। কক্সবাজারে আগে থেকে পাঁচ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার বসবাস। এ জেলার টেকনাফ, উখিয়ার বিস্তীর্ণ পাহাড়ে গত ২০ দিনে আশ্রয় নিয়েছে আরো ৫-৭ লাখ রোহিঙ্গা। বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর আশ্রয়স্থল তথা আবাস তৈরিতে প্রতিদিন প্রয়োজন হচ্ছে লাখ লাখ বাঁশ ও গাছ। এই বাঁশ ও গাছের জোগান দিতে গিয়েই উজাড় হচ্ছে পাহাড়ি বনভূমি। হঠাৎ করে কয়েক লাখ মানুষের বাড়তি চাপ জেলাবাসীর জীবনকে অসহনীয় করে তুলছে। মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান বৃদ্ধির আশঙ্কাও বেড়েছে। শরণার্থীদের কারণে এইডস এবং বি-হেপাটাইটিসের মতো মরণব্যাধির বিস্তার ঘটার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। এ সমস্যা থেকে রেহাই পেতে রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সম্মানজনক পথ উন্মোচনে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়াতে হবে।

আগে থেকে থাকা ৫ লাখ ও নতুন করে আসা ৪ লাখ বিপদাপন্ন মানুষের খাদ্য ও আশ্রয় জোগাতে বাংলাদেশকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিশ্ব সম্প্রদায় রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপারে এ যাবৎ বিবৃতি আর প্রস্তাব নিয়েই তাদের দায়িত্ব সারছে। শরণার্থীদের জন্য এ যাবৎ যে ত্রাণসামগ্রী বিদেশ থেকে পাঠানো হয়েছে তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্যই বলা যায়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বানে বিপন্ন রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত খুলে দিয়ে তাদের আশ্রয় ও খাদ্য জোগাতে বাংলাদেশ নিজেই সংকটাপন্ন অবস্থায় পড়েছে। ভয়াবহ বন্যায় দেশ যখন লাখ লাখ টন চাল আমদানি করে নিজের নাগরিকদের চাহিদা মেটানোর কঠিন সংগ্রামে রত, তখন লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর আগমন পরিস্থিতিকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। এ অবস্থার প্রেক্ষাপটে শরণার্থীদের সহায়তাদানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে যেমন হাত বাড়াতে হবে, তেমনি তাদের সম্মানজনকভাবে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পদক্ষেপও নিতে হবে। বার বার যাতে বাংলাদেশকে প্রতিবেশী দেশের উটকো ঝামেলার শিকার হতে না হয় তা নিশ্চিত করতে স্বদেশে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ অবস্থানের ব্যবস্থাও করা দরকার। বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতির দেশ, দারিদ্র্যের শিকারও এ দেশের অন্তত এক-চতুর্থাংশ মানুষ। প্রতিবেশী দেশের সমস্যায় তাদের জীবন আরো সংকুল হয়ে উঠছে, যা কাম্য হওয়া উচিত নয়। সেহেতু বাংলাদেশও চায় এমন একটি টেকসই সমাধান-যা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে দেবে। এজন্য মিয়ানমারের রাখাইনে নিরাপত্তা জোন গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে। মিয়ানমার সরকার গঠিত কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নেরও আহ্বান জানানো হয়েছে সু চি সরকারের কাছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনে সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়েছে বাংলাদেশ। মিয়ানমার নিজেদের জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ইতিবাচক পদক্ষেপ নেবে-এমনটাই প্রত্যাশা।

লেখক : ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেড

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist