প্রশান্ত কুমার বর্মণ

  ৩০ মার্চ, ২০২৪

মুক্তমত

স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে গ্রন্থাগারের ভূমিকা

বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির এ বিশ্বে জ্ঞানের প্রাচুর্যতা অনেক বেশি। সময়ের আবর্তনে তথ্য হয়ে উঠেছে বহুল গুরুত্বপূর্ণ। জ্ঞানীদের বিভিন্ন রকম তথ্য, উপদেশ কিংবা বিভিন্ন নির্দেশনাবলি সোনালি ভবিষ্যৎ হিসেবে লিপিবদ্ধ থাকে একটি বইয়ে। অন্তহীন জ্ঞানের এ উৎস হলো বই। আর এ বই সুরক্ষিত ও সুশৃঙ্খল রাখার অর্থাৎ জ্ঞানের বিচরণ ও আবাস্থল হলো গ্রন্থাগার। গ্রন্থাগার হলো অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতে মিলনের জন্য নির্মিত এক সেতু, যার ভেতর ভিন্ন ভিন্ন গ্রন্থ নদীর স্রোতের মাধ্যমে প্রবাহিত হয় আর এ স্রোতের ধারায় অমৃত নামক জ্ঞানকুঞ্জ লিপিবদ্ধ থাকে। বিখ্যাত লেখক দেকার্তে বলেছেন, ‘বই পড়া মানে বিগত কয়েক দশকের সেসব পণ্ডিতদের সঙ্গে কথা বলা।’ বর্তমানের এই সৃজনশীলতার বিশ্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জনই যথেষ্ট নয়। জ্ঞানের পরিধি সুদূরপ্রসারী করতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি আমাদের পাঠ্যবহির্ভূত বই পড়ায় অভ্যস্ত হতে হবে।

মানুষের রুচি, বয়স ও চাহিদা অনুসারে বই সরবরাহ করে একটি গ্রন্থাগার। তাই তো সমাজের অস্তিত্বের প্রসার ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে সহায়ক হিসেবে গ্রন্থাগারের জুড়ি মেলা ভার। এজন্য বিখ্যাত লেখক প্রমথ চৌধুরী বলেছেন, ‘লাইব্রেরির গুরুত্ব হাসপাতালের চেয়েও অনেকটা বেশি।’

বুকস্টলকে আমরা অনেকে আবার লাইব্রেরি কিংবা গ্রন্থাগার বলে ভুল করি। বুকস্টল হলো বই বিক্রয়ের স্থান যেখানে শুধু বিভিন্ন রকমের নিত্যনতুন বই ক্রয়-বিক্রয় করা হয় আর লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার হলো এমন একটি স্থান বা জ্ঞান আহরণের স্থান যেখানে আমরা বয়স, চাহিদামাফিক বিভিন্ন তথ্য জানার পাশাপাশি বিভিন্ন অভিজ্ঞতা লাভ করে থাকি, পুরো জগৎটাকে পরিভ্রমণ করতে পারি নিমেষেই। আর বুকস্টল থেকে শুধু ক্রেতারা পছন্দসই বই কেনাবেচা করতে পারে। এখানে থাকে না জ্ঞান আহরণ কিংবা চিন্তাশক্তির সমৃদ্ধি ঘটানোর সুযোগ।

জ্ঞানের প্রায়োগিক বিচার-বিবেচনা ও চিন্তাশক্তির উন্মেষ এবং চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এখানে। তাই তো এই জ্ঞানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলছে বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থাগার নির্মাণও। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। জাতীয় গ্রন্থাগারের পাশাপাশি আছে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারও। তা ছাড়াও দেশের সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণের সুযোগ হিসেবে এবং শক্তিশালী মানসিকতা ও জ্ঞানের অপার সম্ভাবনা হিসেবে তৈরি করতে সরকার দেশের ৬৪ জেলায় সরকারি গণগ্রন্থাগার স্থাপন করেছে। এসব গণগ্রন্থাগারের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং স্কুল-কলেজে অনেক গ্রন্থাগার তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু এগুলোর শক্তিশালী অবকাঠামো কিংবা ভিত্তি এখনো যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। অদক্ষ জনবলদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এসব গ্রন্থাগার। তাই গ্রন্থাগারের সুষ্ঠু পরিকল্পনা, সঠিক চিন্তা-চেতনা ও বিকাশে দক্ষ লোকবল নেওয়ার সুবিধার্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইনফরমেশন সায়েন্স অ্যান্ড লাইব্রেরি মেনেজমেন্ট নামক ডিপার্টমেন্ট খোলা হয়েছে, যাদের গ্রন্থাগার ছাড়াও কম্পিউটার তথা অনেক আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ ও চাহিদা অনুসারে এই ডিপার্টমেন্ট এখন অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েও পড়ানো হচ্ছে।

বিজ্ঞানের মৌলিক গবেষণার মানুষের কল্পনা সূত্র চিন্তাকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে বিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থ মানুষকে সহায়তা করে। এ ক্ষেত্রে গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত সব ধরনরে বিজ্ঞানবিষয়ক তথ্য নব নব আবিষ্কারে সহায়তা করবে এবং বিজ্ঞানের এই যাত্রায় অবদান রাখবে। তাহলে আমরা সহজেই জ্ঞানের পরিধি বাড়িয়ে তা যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারব। গ্রন্থাগারে গ্রন্থের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের সাময়িকী, পুস্তিকা, ম্যাগাজিন, সংবাদপত্র প্রভৃতি থাকে। গ্রন্থাগার চার ধরনের হয়ে থাকে। একাডেমি, বিশেষ, পাবলিক ও জাতীয় লাইব্রেরি।

কল্পনাশক্তির পাশাপাশি প্রয়োজন বাস্তব অভিজ্ঞতা ও ব্যাপক অধ্যয়ন ও অনুশীলন। প্রাচীনকালে উপমহাদেশে বিভিন্ন গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। বই পড়ার আগ্রহ ও আকর্ষণ থেকেই গ্রন্থাগারের উৎপত্তি। প্রাচীনকাল থেকেই কিছু পুরোনো গ্রন্থাগার বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে আছে আজও কিন্তু কালের বিবর্তনে সেগুলোর কিছু আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত আর কিছুসংখ্যক অক্ষত অবস্থায় পড়ে রয়েছে এখনো। তাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হলো- নালন্দা গ্রন্থাগার, আলেকজান্ড্রিয়ার গ্রন্থাগার, পারগামাম গ্রন্থাগার, আসুরবানী পাল ও কর্ডোভা গ্রন্থাগার।

অন্যান্য দেশের দিকে দৃষ্টি দিলে সহজেই উপলব্ধি করতে পারি যে, তাদের দেশে গ্রন্থাগার সর্বোচ্চ সম্মানে দাঁড়িয়ে আছেন। কারণ এর যথার্থ উপলব্ধি তারা করতে পেরেছেন বা জ্ঞানের মর্মকথা তাদের মস্তিষ্কের সন্নিকটে। কারণ যে দেশের শিক্ষিতদের হার যত বেশি, সেই দেশ তত বেশি উন্নত। তাদের কাছে শিক্ষার মাপকাঠিস্বরূপ পুঞ্জীভূত জ্ঞানের আধার গ্রন্থাগারের অবদান অনস্বীকার্য। এটির মাধ্যমে মানুষ জ্ঞানসমুদ্রে অবগাহন করে জ্ঞানের মণিমুক্তা সংগ্রহের সুবর্ণ সুযোগ পায়। গ্রন্থাগার শুধু সমাজ সংস্করণের কাজই করে না বরং তা সমাজের সামগ্রিক বিকাশ ও পরিবর্তনে সহায়তা করে। বুদ্ধি ও মননের অনুশীলনের প্রয়োজনে মানুষ জ্ঞান আহরণ করতে পারে দুটি মাধ্যমে। একটি ভ্রমণ ও অপরটি গ্রন্থপাঠ। তাই এটি জ্ঞানপিপাসুদের তৃপ্তীদায়ক অমৃত সরোবর হিসেবে পরিশীলিত। আমরা জাতি হিসেবে এখন অনেকটা উন্নয়নশীল। উন্নত দেশের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানোর অভিপ্রায় হেঁটে চলছে দেশটি। সুপ্রাচীনকাল থেকে তথ্যকে বিভিন্নভাবে আহরণের চেষ্টা থেকেই পরে তা গ্রন্থাগারে রূপ নিয়েছে। আধুনিক থেকে অত্যাধুনিক হচ্ছে প্রতিনিয়তই। মননশীল ও সৃজনশীল সমাজ গঠনের পাশাপাশি জুতসই মানসিকতা তৈরিতে এটি সিদ্ধহস্ত। তাই একটি জাতির ইতিহাস- ঐতিহ্য, সংস্কৃতির ধারণ, বাহন ও জ্ঞান উন্নয়নের পরিচায়ক হিসেবে গ্রন্থাগারের ভূমিকা অপরিসীম।

লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

proshantokumar2002@gmail

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close