আশরাফুল ইসলাম আকাশ

  ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষকের জীবনমান উন্নয়নও জরুরি

এক হাজার টাকার ভাড়া বাসায় থাকেন, পাঁচ শ টাকার চিকিৎসা নেন দেশের ৯৫ ভাগ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই সত্য। এ ছাড়া বর্তমান ঊর্ধ্বমূল্যের বাজারেও সাড়ে ১২ হাজার টাকায় জীবনযাত্রা পরিচালনা করতে হয় মাস্টার্স পাস করা শিক্ষকদের। উৎসবে ভাতা পান ২৫ শতাংশ, যা রীতিমতো হাস্যকর। স্বাধীনতার পাঁচ দশক পরেও বেসরকারি শিক্ষকতার অবস্থা অত্যন্ত লজ্জাজনক। এই বেতন-ভাতায় বদলির সুযোগ না থাকায় দূর-দূরান্তে বাধ্য হয়ে চাকরি করছেন তারা। এত বছরেও বদলির নীতিমালা নেই, যা অমানবিক। শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার জটিলতার কোনো শেষ নেই। এমপিওভুক্তি পেতে পদে পদে হয়রানি, প্রমোশন পলিসি অদ্ভুত ধরনের। অবসর-পরবর্তী সুবিধাগুলো পেতে জুতার তলা ক্ষয় হয় তাদের। এসব নিয়ে শিক্ষকদের ক্ষোভ চরমে। বেতন-ভাতা বাড়ানোর দাবিতে বিভিন্ন সময় আন্দোলনও করতে দেখা গেছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের। এদিকে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন কাঠামোতে তৃতীয় শ্রেণির মর্যাদা। প্রতিদিন ৬ টাকা টিফিন ভাতা নিয়েও ক্ষোভ তাদের। এতসব অসন্তুষ্টির মধ্যেই চলতি শিক্ষাবর্ষে সাত শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পড়ছে নতুন শিক্ষাক্রমের বই। এসব বইয়ের নানা ভুল-অসংগতি নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। রীতিমতো চাপে এনসিটিবি। গত বছর অর্থাৎ ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু হয়। একেবারে নতুন ধাঁচের বই পড়ানো হয় তিনটি শ্রেণির শিক্ষার্থীদের। চলতি বছর দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা পড়ছে নতুন করে লেখা বই। ২০২৫ সালে চতুর্থ, পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে, ২০২৬ সালে একাদশ শ্রেণিতে এবং ২০২৭ সালে দ্বাদশ শ্রেণিতে ধাপে ধাপে চালু হবে নতুন শিক্ষাক্রম। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির চার বইয়ে ১৮৮টি অসংগতি খুঁজে বের করে বিশেষজ্ঞ কমিটি। পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বলছে, নতুন শিক্ষাক্রমের কোনো বই-ই এখনো পূর্ণাঙ্গ নয়। সবই পরীক্ষামূলক সংস্করণ। নতুন বইয়ের উপযোগিতা যাচাই করা হবে। যাচাইকালে যেসব পাঠ্য নিয়ে সমস্যা হবে, তা সংশোধন অথবা বাদ দেওয়াও হতে পারে। মূল্যায়ন শেষে ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে কিছু শ্রেণিতে দেওয়া হবে পরিমার্জিত সংস্করণের বই। নতুন শিক্ষাক্রমের ভুলভ্রান্তি নিয়ে বিস্তর আলোচনা সমালোচনা চলছে বিভিন্ন মহলে, গণমাধ্যমগুলোও খবর প্রকাশ করে যাচ্ছে, তবে সরকার যদি সেগুলো আমলে না নেয়, নিজেদের ভুলভ্রান্তি সংশোধনের সুযোগ না নেয়, তাহলে এমন শিক্ষাক্রমের সাফল্য কতটা পাওয়া যাবে, তা বলা সত্যিই মুশকিল।

নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী বেশির ভাগ বিষয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা হবে শ্রেণিকক্ষে। অর্থাৎ এখানে শিক্ষকদেরই বিশাল ভূমিকা রয়েছে। শিক্ষা-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে মূল ভূমিকায় থাকবেন শিক্ষকরা। অথচ এখন পর্যন্ত দেশে শিক্ষার্থীর বিপরীতে শিক্ষকের সংখ্যা অনেক কম। শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা কম থাকায় মেধাবীরা এ পেশায় আগ্রহী নয়। ফলে দক্ষ শিক্ষকেরও ঘাটতি রয়েছে। তাই যোগ্য শিক্ষকের সংখ্যা যেমন বাড়াতে হবে, তেমনি দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিতে হবে। একই সঙ্গে শিক্ষকের জীবনমান উন্নয়নে আর্থিক এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে শিক্ষার আমূল পরিবর্তন বড় ইস্যু। মেধাবীদের আকর্ষণ করতে হলে অবশ্যই শিক্ষকতা পেশাকে নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে হবে। শিক্ষার মানোন্নয়নের সঙ্গে যেসব মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন জরুরি তা হলো শিক্ষক। প্রতি বছরই শিক্ষকদের আন্দোলন করতে দেখা যায়। কখনো প্রাথমিক, কখনো মাধ্যমিক আবার উচ্চমাধ্যমিকের সরকারি কিংবা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে। শিক্ষকদের রাজপথে নামতে দেখি বেতন বৃদ্ধির জন্য, শিক্ষা জাতীয়করণের (সরকারীকরণ) জন্য, সমণ্ডঅধিকার কিংবা মর্যাদার দাবির জন্য। শিক্ষকদের মান বাড়াতে তাদের সঠিক নিয়োগ ব্যবস্থাপনা যেমন জরুরি তেমনি, মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট করতে লোভনীয় বেতন কাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা প্রদান জরুরি। শিক্ষকদের টিউশনি কিংবা কোচিং ব্যবসায় জড়িত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে সরকার যে দায়িত্ব পালন করতে যায়, সেটি তাদের বেতন কাঠামোর পরিবর্তনেই সম্ভবপর হবে। আমাদের শিক্ষকরা কতটা অভাগা যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারীকরণের জন্য আন্দোলন করতে হয়। অথচ এসব শিক্ষকদের কাঁধে উঠে একই সিলেবাস ও শিক্ষাকাঠামোর দায়িত্ব। শিক্ষকদের মৌলিক চাহিদার একসূত্রকরণ করতে না পারলে শিক্ষার যতই ভালো পরিবর্তন করার উদ্যোগ নেওয়া হোক না কেন, তা অসাড় হয়ে যাবে। তাই শিক্ষকদের যেন আর কোনো আন্দোলনে আসতে না হয়, সেই ব্যবস্থাপনা তৈরি করা সরকারের জন্য নৈতিক চ্যালেঞ্জ বটে। রাষ্ট্র গড়ার প্রধান কারিগর শিক্ষক। এ বাক্যটি রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তি, রাজনীতিবিদসহ সংশ্লিষ্টদের মনেপ্রাণে উপলব্ধি করা প্রয়োজন। অথচ উপলব্ধির পরিবর্তে, তারা শিক্ষকদের এড়িয়ে চলেন।

চাকরি জীবনে একবারও বদলির সুযোগ না পাওয়া এসব শিক্ষক বাধ্য হয়েই পরিবার থেকে দূরে থাকেন। হতভাগা এই শিক্ষকদের প্রধান কাজ শিক্ষার্থীদের জীবন-জীবিকা উপযোগী সুশিক্ষা বিদ্যালয়ে প্রদান করা। নিজ পরিবারের জীবন-জীবিকার চিন্তা মাথার মাঝে ঘুরপাক খাওয়ায় শিক্ষকের আন্তরিক মনমানসিকতা কতটা শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে সফলতা আনতে পারে? কোচিং ও টিউশনি অনেকটা মহাপাপ। একজন আর্থিক সচ্ছলতাহীন শিক্ষক এ কর্ম ছাড়া নিরুপায়। করোনায় বেতন বন্ধ থাকায়, একজন শিক্ষকের ফুটপাতে কলা বিক্রির ঘটনা দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় তুলেছিল। এ নিয়ে রাষ্ট্র, সমাজ ও সংশ্লিষ্টদের কতজনের ভাবনা উদয় হয়েছে? শিক্ষকদের পরিবার অনাহার, অপুষ্টি, শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত হলেও কারো যেন দায় নেই। আজকাল শিক্ষিত, মেধাবীরা এনটিআরসির মাধ্যমে শিক্ষকতা পেশায় এসে থাকেন। হতাশ হয়ে অনেকেই শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে চলে যান। বর্তমান শিক্ষাক্রম প্রশিক্ষণ ভালোভাবে জানা, প্রয়োগের জন্য প্রয়োজন চৌকশ মেধাবী শিক্ষক। শিক্ষা দেশ ও জাতি বিনির্মাণে শ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ। শিক্ষাক্রমের সফল বাস্তবায়ন ও স্মার্ট বাংলাদেশের সমৃদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা গঠনে শিক্ষক সমাজকে অবহেলা করে কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নপূরণ চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়বে। এই প্রেক্ষাপটে সর্বাগ্রে শিক্ষকদের মর্যাদা, আর্থিক সচ্ছলতা আনয়ন, বৈষম্য দূরীকরণসহ শিক্ষার সমস্যাকে রাষ্ট্রের ১ নম্বর সমস্যা হিসেবে গণ্য করা প্রয়োজন। শিক্ষকদের মর্যাদা অভিন্ন ১ম শ্রেণির হওয়া প্রয়োজন। সর্বোচ্চ মেধাবী, চৌকশদের শিক্ষকতা পেশায় নিয়োগ দিতে হবে। এ জন্য বেতন কাঠামোর সর্বোচ্চ স্তর শিক্ষকতা পেশায় দেওয়া প্রয়োজন। তবে কাজের কাঠিন্য বিবেচনা করে শিশুর শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি প্রয়োজন। শিক্ষা গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ান। একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা জাতি আশা করে যে শিক্ষাব্যবস্থা বেকার তৈরি করবে না, উদ্যোক্তা তৈরি করবে। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে প্রাইভেট টিউশনি, কোচিং বা অন্য কোনো বাড়তি কাজের দ্বারা অর্থ উপার্জন করতে গিয়ে নিজ দায়িত্ব পালনে বাধার সম্মুখীন হতে না হয়। শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য অবিলম্বে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি প্রথা বিলুপ্ত করে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুরূপ নিয়মে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে। কোনো বঞ্চনা নয়, করুণা নয়, বরং শিক্ষার গুণগত মান বিকাশে শিক্ষকতা পেশার প্রতি ন্যায়বিচার এবং সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।

এদিকে, শিক্ষক সংকটে ধুঁকছে দেশ। ফলে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন আরো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। শিক্ষক নিয়োগে দীর্ঘসূত্রতা দেখা যায় বরাবরই। সারা দেশের বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসায় শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে থাকে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। দেশের শিক্ষক নিয়োগের বড় অংশ পূরণ হয় এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। ১৬তম নিবন্ধনধারীদের নিবন্ধন প্রক্রিয়া থেকে চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে প্রাথমিক সুপারিশপ্রাপ্তিতে চার বছর অতিবাহিত হয়। ১৭তম নিবন্ধনের প্রার্থীদের ইতিমধ্যে চার বছর পেরিয়েছে। এখন গণবিজ্ঞপ্তির অপেক্ষা তাদের। দেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৬০ হাজারের বেশি পদ শূন্য রয়েছে। শিক্ষকসংকটের কারণে খণ্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে কোনো রকমে জোড়াতালি দিয়ে চলছে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে জটিলতাও দেখা দিয়েছে। কারণ নতুন শিক্ষাক্রমে দলগত নানা কাজ রয়েছে। বিশালসংখ্যক শিক্ষকের পদ খালি রেখে নতুন শ্রেণির ক্লাস শুরু হওয়ায় শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নেও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এমনিতেই শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে নানা ধরনের নেতিবাচক প্রচার রয়েছে। এর পরও যদি শিক্ষকের অভাবে শিক্ষার্থীরা তাদের শিখন কার্যক্রম ঠিকমতো চালাতে না পারে, তাহলে বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হবে।

শিক্ষকতা পেশা সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দাবি রাখলেও অবহেলা ও অবজ্ঞার ফলে শিক্ষকতা পেশা ক্রমেই মেধাবীদের আকর্ষণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। রাষ্ট্র গড়ার কর্ণধার হলেন শিক্ষক সমাজ। তাদের আর্থিক, রাষ্ট্রীয় মর্যাদা অবহেলায় রেখে স্মার্ট বাংলাদেশ গঠন হবে মহা-চ্যালেঞ্জের।

লেখক : কলাম লেখক ও সাবেক সভাপতি

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close