তানজিব রহমান

  ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

মার্কিন সিনেটরদের বিবৃতি ও বিচারিক হস্তক্ষেপ

শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে হয়রানি বন্ধ করার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আহ্বান জানিয়ে খোলা চিঠি লিখেছেন নোবেল বিজয়ীসহ বিশ্বের ২৪২ বিশিষ্ট নাগরিক, যা মার্কিন গণমাধ্যম ওয়াশিংটন পোস্ট বিজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করে। এর কিছুদিন আগেও যুক্তরাষ্ট্রের ১২ জন সিনেটর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি একই আহ্বান জানান। চিঠিতে অধ্যাপক ইউনূসকে বিদ্যমান হয়রানি বন্ধ করার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে সরকারের সমালোচকদের টার্গেট করে বিচারব্যবস্থার যে লঙ্ঘন করা হচ্ছে বিস্তৃতভাবে সেই ধারা বন্ধ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। বাংলাদেশ ইস্যুতে মার্কিন সিনেটরদের নাক গলানোর বিষয়গুলো আমরা এর আগেও লক্ষ করেছি। প্রশ্ন উঠেছে, আইনপ্রণেতারা আইনভঙ্গের সুপারিশ করেন কীভাবে? স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের বিচারব্যবস্থায় তাদের অযাচিত হস্তক্ষেপ প্রশ্ন তুলেছে নানা দিক থেকে।

২৯ জানুয়ারি ২০২৪ ওয়াশিংটন পোস্টের ৭ নম্বর পৃষ্ঠায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপনটি ৫ কলাম ১৯ ইঞ্চি। ওয়াশিংটন পোস্টের বিজ্ঞাপনের হাল দরপ্রতি কলাম ইঞ্চি ৮০৭ ডলার হিসেবে বিশ্বনেতাদের ইউনূসবিষয়ক চিঠি বাবদ ব্যয় ৭৬ হাজার ডলারের বেশি। অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৮৫ লাখ টাকারও বেশি। প্রশ্ন উঠেছে, বিজ্ঞাপনের ব্যয় বহন করল কে? মার্কিন সিনেটরদের বিবৃতির কথা এলেই মার্কিন সিনেটর বব মেনেনডেজ ঘুষ কেলেঙ্কারির কথা মনে পড়ে। যিনি বিবৃতি বা পক্ষে বলার জন্য অবৈধ সোনার বার ও অবৈধ বিপুল অঙ্কের ডলারসহ ধরা পড়েছিলেন গত অক্টোবরে। পরে তাকে স্ত্রীসহ আইনের মুখোমুখি হয়। তারই কাছাকাছি সময়ে আমরা দেখলাম সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতার অপব্যবহার ও জেল-জরিমানার শিকার হন এবং অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় ২০ মিনিটের জন্য কারাবাসও করেন। নিজের দেশের আইনের শাসনে যুক্তরাষ্ট্রে যদি প্রেসিডেন্টকেও হাজতবাস করতে হয়, সিনেটরকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়, তবে অন্য দেশে যথাযথ বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলার রহস্য কী?

বিচার কিংবা আদালত চলে আইনের গতিতে, তা যেমন স্বাভাবিক, তেমনি অভ্যন্তরীণ বিচারিক বিষয়ে বিদেশি রাষ্ট্রের কেউ অযাচিত কথা বলবে, হস্তক্ষেপ করবে, তা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক। এই অস্বাভাবিক বিষয়গুলোর নেপথ্যের গল্প সম্পর্কে জানতে পারা যায় পরে। যেমনটা জানা গিয়েছিল হিলারি ক্লিন্টনের ইমেইল কেলেঙ্কারি বা বব মেনেনডেজ অর্থ কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর। বিদেশিদের চিঠি বা বিজ্ঞাপন একেবারে বেদবাক্য সেটা বলার সুযোগ নেই। কারণ তারাও কখনো কখনো মোটা অঙ্কের ডলার কিংবা বিশেষ কারো উপঢৌকনে টোপ গেলেন। কোনো পিআর ফার্ম বা লবিস্ট কোম্পানি, যা তাদের বলতে বা করতে অনুরোধ করেন তারা তা বলে দেন। পেছনের লেনদেনের খবর পরে গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। বাংলাদেশ ইস্যুতে এমন ঘটনা এর আগে আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম মার্কিন সিনেটর বব মেনেনডেজের ক্ষেত্রে।

অধ্যাপক ইউনূসকে যেন হয়রানি করা না হয়, এ ব্যাপারে বিদেশিরা যে বিবৃতি পাঠিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন, তা নতুন কোনো বিষয় নয়। এমন বিবৃতি অনুরোধ এর আগেও আমরা দেখেছি কিন্তু পরে দেখা গেল ড. ইউনূস জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে বকেয়া কর বাবদ ১২ কোটি ৪৬ লাখ ৭৬ হাজার টাকা পরিশোধ করেছিলেন। তা নিয়ে কি বিবৃতিদাতারা কোনো প্রশ্ন তুলেছিলেন? না তোলেননি। ঘটনার প্রকৃত চিত্র না দেখেই এমন পত্র এখন হর হামেশা চলছে।

প্রশ্ন উঠেছে, নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সিনেটরদের বিবৃতি কী বার্তা দেয়? নতুন ষড়যন্ত্র নাকি দেশকে চাপে রাখার নয়া কৌশল? যাই হোক বিচারিক বিষয়ে আদালত যে রায় বা সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন, তার বাইরে কথা বলার আইনগত ভিত্তি বিদেশিদের নেই।

শ্রমিকদের অধিকার ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে যতটা সোচ্চার দেখা যায় ড. ইউনূস ও তার কোম্পানির বিরুদ্ধে শ্রমিক অধিকার হরণের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি তার একেবারে উল্টো কেন? এর পেছনের রহস্যটা সবার কাছে অধরা কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শ্রমিক অধিকারের কথা বললেও ড. ইউনূস ও তার গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিকদের অর্থ আত্মসাৎ বিষয়ে আশ্চর্যজনক নীরব ভূমিকা পালন করে গেছে সব সময়। এর আগেও আমরা দেখেছি, অধ্যাপক ইউনূসকে জবাবদিহির মুখোমুখি হওয়াকে তারা ‘হয়রানি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যারা সমগ্র বিশ্বে শ্রমিক অধিকার, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, আইনের শাসন ইত্যাদি ফেরি করেন, এখানে এসে তারাও মুখে কুলুপ আঁটেন।

প্রধানমন্ত্রী এক প্রশ্নের জবাবে উল্লেখ করেছিলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিষয়ে বিদেশিরা যেসব বিবৃতি দিচ্ছেন, তাদের তিনি বাংলাদেশে এসে তার কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন এবং তিনি আহ্বান জানান, তারা যেন এক্সপার্ট বা আইনজ্ঞ পাঠান ড. ইউনূসের দুর্নীতির অর্থ, শ্রমিকদের অর্থ আত্মসাৎ, শ্রমিকদের কল্যাণ তহবিল নিয়ে অবৈধ পন্থা অবলম্বন, কর ফাঁকি ইত্যাদি বিষয়ে তদন্ত করে সমস্ত দলিল-দস্তাবেজ যেন তারা খতিয়ে দেখে তারপর বিবৃতি পাঠান। কেননা প্রকৃত ঘটনা না জেনে বিবৃতি দেওয়া সঠিক নয়। 

বাংলাদেশের শ্রম আইন বলছে, লাভের ৫ শতাংশ শ্রমিকদের কল্যাণ তহবিলে দিতে হবে, তা না করায় শ্রমিকরা মামলা করে, শ্রমিকদের কর্তৃপক্ষ চাকরিচ্যুত করে, শ্রমিকরা যাতে মামলা না করে এর জন্য ঘুষ দেওয়া হয় এবং এই ঘুষের টাকার ভাগ কে কত পেল? তাও তদন্তে বেরিয়ে আসে। আর এসব বিষয়ে শ্রম আদালতে মামলা হয়, বিচারে অধ্যাপক ইউনূসসহ গ্রামীণ টেলিকমের ৪ পরিচালক ৬ মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন। ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের এ রায়কে কেন্দ্র করে অপচেষ্টা চালাচ্ছে দেশি-বিদেশি একটি মহল। একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি হস্তক্ষেপ, বিচার বিভাগকে বিতর্কিত করার ষড়যন্ত্র এবং প্রচলিত আইনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা সুশাসন গণতন্ত্র মানবাধিকারের পরিপন্থী। আপাতদৃষ্টিতে শ্রমিকদের মানবাধিকার ও আইনগত সুরক্ষা নিয়ে কেউ বিবৃতি দেয় না, যা তাদের বিবৃতির উদ্দেশ্য এবং এর পেছনের শক্তি নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে।

লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close