মোহাম্মদ আবু নোমান

  ২০ মার্চ, ২০১৯

বিশ্লেষণ

শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদী সন্ত্রাসী

পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভালোবাসা সেটাই, যে অপরকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করেন। তেমনিই হুসনে আরা! নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের আল নুর মসজিদে ঘটনার সময় হুসনে আরা নারীদের জন্য সংরক্ষিত কক্ষে ছিলেন। আকস্মাৎ গুলি আর হইচইয়ের শব্দে তার মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। স্বামী যে কক্ষে নামাজরত সেখানে ১৫ মিনিটব্যাপী চলছে গুলি আর গুলি! হুইলচেয়ারে চলাচলকারী প্রাণপ্রিয় স্বামীর খোঁজে পাগলপারা হয়ে বেরিয়ে আসেন গুলি উপেক্ষা করে। এ সময় অস্ত্রধারী হুসনে আরাকে লক্ষ্য করে গুলি করলে তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান। একটি মানুষ এত ভয়ংকর হতে পারে, তা সত্যিই কল্পনা করা যায়? এই সন্ত্রাসী একবার গুলি করে গিয়ে আবার ফিরে এসে গুলি করেছে।

নিউজিল্যান্ড এমনই শান্তিপূর্ণ দেশ, যেখানে পুলিশ অস্ত্রশস্ত্রই সঙ্গে রাখে না। তাদের প্রধানমন্ত্রীও না কি নিরাপত্তা নেন না। শান্তির দেশেও সরকার ব্রেন্টেনের মতো ভয়ানক অথচ ঠান্ডা মানসিকতার খুনিকে একে ৪৭-এর লাইসেন্স দিয়ে রাখে এবং সে ইচ্ছামতো গুলি কিনতে পারে দোকান থেকে? অস্ত্র নিয়ে গাড়িতে ঘুরে বেড়ানো যায়? অস্ত্র এত সহজলভ্য? বন্দুক হাতে বিনা বাধায় দীর্ঘ সময় ধরে এ রকম হত্যালীলা চালানোর ‘স্বাধীনতা’ দেখে পুরো বিশ্ব হতবাক! কিন্তু সব মৃত্যুই সমান নয়! বন্দুক হাতের লোকটি যদি সাদা না হয়ে কালো বা বাদামি হতো, হতো মুসলমান; তবে তাদের ধর্মোন্মাদ বলায় কোনো কসুর করত না অধিকাংশ পশ্চিমা গণমাধ্যম। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীও হত্যাকারীকে জঙ্গি বর্ণবাদী সন্ত্রাসী বলেননি বটে, তবে আক্রান্ত ব্যক্তিদের আপন করে নিতে চেয়েছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষায় এর দ্বারা শ্বেত উগ্রতাবাদ বিস্তৃত হচ্ছে, সে কথার প্রমাণ হয় না বলে মনে করেন তিনি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এমন একটি জঘন্য ঘটনার পরও তার স্পষ্ট নিন্দা করতে ব্যর্থ হলেন।

নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আরডার্ন বলেছেন, তার দেশের অস্ত্র আইনে পরিবর্তন আনা হবে। আরডার্ন আরো বলেন, ‘হামলাকারীর কাছে ৫টি বন্দুক ও ১টি লাইসেন্স ছিল। তার কাছে পাওয়া অস্ত্রগুলোর মধ্যে দুটি সেমি-অটোমেটিক (স্বয়ংক্রিয় রাইফেল), দুটি শটগান ও লিভার অ্যাকশন ফায়ারআর্ম।’ ইতোপূর্বে নিউজিল্যান্ডে ডেভিড গ্রেনামের এক বন্দুকধারী গুলি চালিয়ে ১৩ জনকে হত্যা করেছিল। শান্ত দেশ হিসেবে পরিচিত নিউজিল্যান্ডে বিভিন্ন মানুষের হাতে থাকা বন্দুকের সংখ্যা প্রায় ১২ লাখ। এ হিসাব দেশটির পুলিশের। এর অর্থ হলো, দেশটির প্রতি তিনজন মানুষের একজনের অস্ত্র আছে! প্রশ্ন হলোÑ একজন অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক নিউজিল্যান্ডে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র পায় কীভাবে?

ক্রাইস্টচার্চের আল নুর মসজিদে গুলির ঘটনার পর শহরতলির লিনউডের মসজিদে দ্বিতীয় দফায় হামলা চালানো হয়। দুই মসজিদে তিন বাংলাদেশিসহ ৫০ জন নিহত হন। হামলার ভিডিও দেখে ধারণা করা হচ্ছে, হামলাকারী নিজেই পুরো ঘটনা লাইভ ভিডিওর প্রস্তুতি হিসেবে তার মাথায় ভিডিও ক্যামেরা বসিয়ে নিয়েছিল। প্রশ্ন আসেÑ ২০ মিনিটব্যাপী হামলা ও ভিডিও চলছিল তখন পুলিশ কী করেছে? ক্রাইস্টচার্চের স্থানীয় গণমাধ্যম দ্য প্রেস ও নিউজিল্যান্ড হেরাল্ডের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় ভয়ংকর চিত্র। ওই প্রত্যক্ষদর্শী অজুর ঘরে বসেই জরুরি সেবায় ফোন করেন। কয়েকবার পুলিশকে ফোন দেন। তবে কাউকেই ফোনে পাননি। শেষে অ্যাম্বুলেন্সসেবায় ফোন দিয়ে বিপদের কথা জানান। তিনি বলেন, ‘এখানে ভয়ংকর হত্যাকান্ড চলছে। দয়াকরে সাহায্য করুন। পুলিশ পাঠান, তারা গুলি করেই যাচ্ছে।’ বন্দুকধারী বলছে, ‘মুসলমান তোদের আজ আমরা খুনই করে ফেলব’।

নিউজিল্যান্ড উন্নত দেশের মধ্যেই পড়ে। ক্রাইস্টচার্চ ছোট্ট একটি শহর। জনসংখ্যাও বেশি নয়। সেখানে একজন খুনি ২০ মিনিট ধরে একটি মসজিদে হামলা করে পরে অপর মসজিদে হামলা করল। পুরো হামলার ঘটনা খুনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভ টেলিকাস্ট করেছে, সারা বিশ্ব সেই লাইভ টেলিকাস্ট দেখেছে অথচ নিউজিল্যান্ডের পুলিশ দেখল না!

ক্রিকেট বিশ্বের হর্তাকর্তারা তাদের কর্তব্য পালনে কতটা যে উদাসীন, নিউজিল্যান্ডের ঘটনায় তার প্রমাণ। অল্পের জন্য ওই হামলা থেকে বেঁচে যান বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্যরা। কোনো দেশের একটি জাতীয় দলকে শূন্য নিরাপত্তায় রাখা যায়? সেখানে বাংলাদেশ দলের জন্য নিরাপত্তার ব্যবস্থা কেন ছিল না বিসিবি ও আইসিসিকে জবাব দিতে হবে। আইসিসি এমন অনিরাপদ ক্রিকেট সফর কেন করে থাকে? বাংলাদেশের জায়গাতে ইন্ডিয়া হলে আজকে আইসিসির ঘাম ছুটে যেত। নিজেদের নিরাপত্তার কথা আমাদের নিজেদেরই ভাবতে হবে। ভবিষ্যতে আমাদের জাতীয় ক্রিকেট দলের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত না করলে আইসিসির কোনো টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করবে না, সেটা বিশ্বকাপ হলেও না। আইসিসি কী নিউজিল্যান্ডকে বিদেশি দলের সফরের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করবে? যে রকম পাকিস্তানের বেলাতেও ঘটেছে।

ভাবা যায়! আজ যদি হামলাকারীর উদ্দেশ্য থাকত আমাদের ক্রিকেটারদের ওপর আক্রমণ করার, তবে কি কেউ বেঁচে ফিরতে পারত? কোনো ধরনের নিরাপত্তা ছাড়া কীভাবে একটা দল অন্য দেশে যেতে পারে? আমাদের দেশে তো আমাদের রাষ্ট্রপ্রতির সমান নিরাপত্তা দেওয়া হয় অন্য দেশের ক্রিকেটারদের। কিন্তু আমাদের বেলায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায় কি বিসিবি, আইসিসি এড়াতে পারবে? নিরাপত্তাকর্মী ছাড়া পুরু টিমের হোটেল থেকে বের হওয়া। তার মানে রাস্তায় এবং শুধু বাসে নয়, হোটেলেও বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল না। ঘটনার পর গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকায় নিরাপত্তাবলয় ছাড়া হেঁটে ড্রেসিং রুমে ফিরে আসাটা তো রীতিমতো ভয়ংকর লাগছে।

পথভ্রষ্ট কোনো মুসলমান দ্বারা একটি খারাপ কাজ ঘটে থাকলে, তাকে যেভাবে ফোকাসে নিয়ে আসা হয়, ঠিক তার উল্টোটি করা হয় পশ্চিমা বা খ্রিস্টানদের বেলায়। ইদানীং কি বৌদ্ধরাও কম যাচ্ছে। কিন্তু মিডিয়াতে এস্টাবলিস্ট করা হয়, মুসলমানরাই জঙ্গি। ৯/১১-এর হামলার সময় টুইন টাওয়ারে কাজ করা সহস্রাধিক ইহুদির কেউই সেসময়ে অফিসে ছিল না। অসংখ্য রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং সন্ত্রাসী কার্যক্রম পর্যবেক্ষক ও গবেষকরা বলেছেন, ৯/১১-এর ঘটনা অমুসলিমদের সাজানো একটি নাটক। এমনকি সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত আইএসও অমুসলিমদের তৈরি!

এফবিআই ডেটাবেইসের একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৯৮০-২০০৫ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে ঘটা মাত্র ৬ শতাংশ সন্ত্রাসী ঘটনায় মুসলিম সন্ত্রাসীরা জড়িত ছিল। এ ছাড়াও ‘গ্লোবাল টেররিজম ইনডেক্স ২০১৮’-এর গবেষণায় এসেছে যুদ্ধাক্রান্ত সিরিয়াকে বাদ দিলে ২০১৬-১৭ সালেও বিশ্বের মোট সন্ত্রাসী ঘটনার বেশির ভাগই ঘটেছে অমুসলিমদের দ্বারা। ২০১১ সালে অ্যান্ডার্স বেহরিং ব্রেইভিক নামের এক ব্যক্তি নরওয়েতে গুলি ও বোমা ফাটিয়ে ৭৭ জনকে হত্যা করে। এর আগে নিজের ব্লগে তিনি মুসলিমবিদ্বেষী কথাবার্তা লেখেন। নরওয়ের মতো নিউজিল্যান্ডও শান্তির দেশ বলে পরিচিত। ব্রেইভিককে জঙ্গি বা সন্ত্রাসী বলেননি সে দেশের আদালত। নিয়মিতভাবে পাখির মতো করে স্কুল-কলেজের বাচ্চাদের হত্যা করা মার্কিন ঘাতকরাও নিতান্তই ‘অসুস্থ’ বলে প্রচারিত হয়ে থাকে।

ভয়ংকর বিষয় হলো, ক্রাইস্টচার্চে হামলাকারী ব্রেন্টন বলছেন, অনেক জাতীয়তাবাদী সংগঠন তাকে সমর্থন করেছে এবং ডোনেট করেছে?। তিনি ইউরোপীয়দের উদ্দেশে বলেছেন, ‘পুরুষরা আবার পুরুষ হও। রাজনৈতিক সমাধানের কথা বাদ দাও। প্ল্যান করো, ট্রেনিং নাও, অস্ত্রসজ্জিত হও, আর হামলা করো।’ এমনতর হামলা তার সঙ্গী-সাথীদের মাধ্যমে নাকি চলমান থাকবে!

বিগত সময়ে বিশ্বজুড়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাঠামোগত ঘৃণাচর্চা ও নির্যাতনের যে রেওয়াজ দেখা যাচ্ছে, তারই আন্তঃমহাদেশীয় সম্প্রসারিত রূপ কি এ হামলা? হামলার ঘটনায় অভিযুক্ত সন্ত্রাসী তার ইশতেহারে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ‘শ্বেত আত্মপরিচয় ও অভিন্ন আদর্শের একটি প্রতীক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। যদি ইতোপূর্বে ট্রাম্পের নিজের কথাতেও অনেক সময় মুসলিমবিদ্বেষ ধরা পড়েছে।

সন্ত্রাসী ব্রেন্টন একজন হোয়াইট সুপ্রেমেসিস্ট। হোয়াইট সুপ্রেমেসিস্টরা মনে করেন, পৃথিবীতে শ্বেতাঙ্গরাই শ্রেষ্ঠ জাতি। তাদেরকে কেউ ডোমিনেট করতে পারে না। অন্যরা বরং তাদেরকে নমস্য মনে করবে। হামলার মাসখানিক আগেই এ শ্বেতাঙ্গ খুনিটি মেনিফেস্টো প্রকাশ করেছিলেন। ৭৪ পৃষ্ঠার এ ইশতেহারে খুনিটি জানিয়েছেন, তিনি সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ। তিনি অস্ট্রেলিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছেন আর তার বাবা-মা স্কটিশ-আইরিশ ইংরেজ। তিনি জেনে বুঝেই এ হামলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং তার সঙ্গে আরো অনেকেই আছেন, তবে শেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীদের জন্য তিনি নতুন ভবিষ্যৎ নির্মাণ করে যেতে চান। প্রায় দুই বছর আগে থেকেই তিনি হামলার প্ল্যান করছেন আর এমনতর হামলা তার সঙ্গী-সাথীদের মাধ্যমে চলমান থাকবে। এটাও জানিয়েছেন, ব্যক্তিগতভাবে তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাপোর্টার।

শ্বেত সন্ত্রাসী ব্রেন্টন আদালতে দাঁড়িয়েও হাতকড়ায় বন্দি হাতের বৃদ্ধাঙ্গুল ও তর্জনী মিলে বৃত্ত তৈরি করেন। এটি দেখতে ‘পি’ আকৃতির, যা পাওয়ার বা শক্তি বুঝিয়ে থাকে। বাকি তিনটি আঙুল এ সময় ‘ডব্লিউ’-এর রূপ নেয়, যা দিয়ে শ্বেতাঙ্গদের বোঝানো হয়। অর্থাৎ হোয়াইটের আদ্যক্ষর। এই প্রতীকের অর্থ দাঁড়ায় সাদা চামড়ার লোকজনই সেরা।

ইসলাম শান্তির ধর্ম। কিন্তু ভোগবিলাসের ধর্ম নয়। এ হামলায় মুসলমান বিচলিত নয়। সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানের পাশাপাশি আরাকান, কাশ্মীর, ফিলিস্তিনকে বহুকাল যাবৎ জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। এসব জ্বলন্ত জনপদ নিয়ে জাতিসংঘসহ মানবাধিকারগোষ্ঠী আজও প্রতিরোধযোগ্য কিছু করতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে মহৎ উদ্দেশ্যহীন পুঁজিবাদী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা যে জনগোষ্ঠী তৈরি করছে, তা অর্থনৈতিক ব্যাপক উন্নয়ন করলেও মানবিক সমাজ সৃষ্টি করছে না। শিক্ষাব্যবস্থায় দক্ষতা, উদ্যোক্তা, কারিগরিবিদ্যা যত বাড়ছে, নৈতিক অনুশীলন তত গুরুত্ব হারাচ্ছে। তাই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বিশ্বের সব শান্তিপ্রিয় নেতাদের উচিত, শ্বেত শ্রেষ্ঠত্ববাদী সন্ত্রাসীদের নিন্দা করা।

লেখক : বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close